তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

আমি কেমন মেয়ে ? ভাল মেয়ে। খুব ভাল মেয়ে। আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে হাসছেন। ভাবছেন এই মেয়েটা এমন ছেলেমানুষি করছে কেন? আমি তাে আসলে ছেলে মানুষই। ২৩ বছর তাে এমন কোনও বয়স না তাই না? তবে আমি কিন্তু আসলেই ভাল মেয়ে। 

তন্দ্রাবিলাসদূর ছাই লেখার এই ধরনটা আমার ভাল লাগছে না। আমি বরং ধারাবাহিক ভাবে শুরু করি। পড়তে পড়তে আমার সম্পর্কে আপনার ধীরে ধীরে একটা ধারণা তৈরি হবে। তখন আর আমাকে বলতে হবে না যে আমি ভাল মেয়ে। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। 

খুব অল্প বয়সে রােড অ্যাকসিডেন্টে আমার মা মারা যান। বান্দরবান থেকে একটা জীপে করে আমরা আসছিলাম। আমার বাবা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বাবার পাশে মা বসেছিলেন। মা’র কোলে আমি। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা ছাগল পড়ল। বাবা সেই ছাগল বাচাতে গিয়ে গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে গেলেন। মা তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। আমার এবং বাবার কিছু হল না। বান্দরবানের রাস্তাগুলি খুব নির্জন থাকে। অ্যাকসিডেন্টের অনেক পড়ে লােকজন এসে আমাদের উদ্ধার করল। আমার তখন বয়স মাত্র দেড় বছর। আমার কিচ্ছু মনে নেই।

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

আমার বাবা পরে আবার বিয়ে করেন। সেই বিয়ে সুখের হয়নি। ছােট মা’র মেজাজ খুব খারাপ ছিল। তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন। তার আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। বাবার সঙ্গে রাগারাগি হলেই বলতেন, সুইসাইড করব। শেষ পর্যন্ত মা 

সুইসাইড করেন। এই নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। মা পক্ষের লােকজন মামলা করেন। তারা বলার চেষ্টা করেন মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যাই হােক মামলায় প্রমাণিত হয়, মা মানসিক রােগী ছিলেন। ছােট মা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। গায়ের রঙ অবশ্যি শ্যামলা ছিল। কিন্তু তার চেহারা এতই মিষ্টি ছিল—শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করত।। 

আপনি বুঝতেই পারছেন আমার শৈশবটা সুখের ছিল না। একটা বিরাট বাড়িতে আমি প্রায় একা একাই মানুষ হই। আমাদের বাড়িটা ছিল টু ইউনিট। একতলায় রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর, স্টাডি আর দোতলায় শুধুই শােবার ঘর আর ফ্যামিলি লাউঞ্জ। কাজের লােকদের দোতলায় ওঠা নিষেধ ছিল। তারা সবাই 

বাবাকে ভয় পেত বলে দোতলায় উঠত না। আমি স্কুল থেকে ফিরে একা একাই দোতলায় খেলতাম। আমার মত বাচ্চারা মনে মনে একজন খেলার সাথি তৈরি করে নেয়, তার সঙ্গেই খেলে। আমিও তাই করলাম। একজন খেলার সাথি বানিয়ে নিলাম। সেই খেলার সাথি হল আমার মা। আমার ছােট মা। আমার আসল মাকে তাে আমি দেখিনি, কাজেই তার সম্পর্কে আমার কোন মমতা বা ভালবাসা কিছুই ছিল না। ছােট মা আমাকে খুবই আদর করতেন। সেই আদরের একটা ছােট্ট নমনা দিলেই আপনি বুঝবেন। যেমন মনে করুন তিনি আমাকে ডাকছেন—চিত্রা খেতে এস। চিত্রা বলার আগে তিনি একগাদা আদরের নাম অতি দ্রুত বলে যাবেন। তারপর বলবেন খেতে এস। তার আদরের নাম গুলি হল 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

ভিটভিটি খিটখিটি, মিটমিটি ফিটফিটি 

ভুভুন খুনখুন। 

সুনসুন ঝুনঝুন। এ্যাং বেঙ ঝেং, টেঙ টেঙ। 

আদরের নাম ছাড়াও তার নিজের কিছু কিছু বিচিত্র ছড়াও ছিল। ননসেন্স রাইমের মত কোনও অর্থ নেই, কোনও মানে নেই। সেই সব ছড়া তিনি গানের সুরে বলতেন। সব সুর এক রকম। যেমন ধরুন— 

ফানিম্যান হাসে তার 

রং টং হাসি। জানা কথা যে জানে না 

শুনে সে বাশি। 

এইসব বিচিত্র ছড়া বলে তিনি খিলখিল করে হাসতেন। আমার খুবই মজা লাগত। মনে হত আহ কি আনন্দময় আমার জীবন। 

অতি আদরের একজন মানুষ আমার খেলার সাথি হবে এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজের মনে পুতুল খেলতাম, রান্নাবাটি খেলতাম এবং ক্রমাগত ছােট মায়ের সাথে কথা বলতাম, প্রশ্ন করতাম, ছােট মা উত্তর দিতেন। উত্তর তাে আসলে দিতেন 

আমি উত্তরটা কল্পনা করে নিতাম। তখন আমার বয়স সাত। সাত বছরের বাচ্চারা এই ধরনের খেলা খেলে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু একদিন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটল। সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। বাবা গেছেন ঢাকার বাইরে। আমি সারাদিন একা একা খেলেছি। 

সন্ধ্যাবেলা আমার শরীর খারাপ করল। গা কেঁপে জ্বর এল। আমি চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছি। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। খাট থেকে একটু দূরে আমার পড়ার টেবিল। টেবিলে বাবার এনে দেয়া মােটা একটা ইংরেজি ছবির বই। শুয়ে শুয়ে ছবি দেখতে ইচ্ছা করল। বিছানা থেকে নেমে যে ছবির বইটা আনব সেই ইচ্ছা করছে না। আমি অভ্যাস মত বললাম, ছােট মা বইটা এনে দাও। কল্পনার খেলার সাথি মাকে এই জাতীয় অনুরােধ আমি প্রায়ই করি। সেই অনুরােধ আমি নিজেই পালন করি। তারপর বলি, থ্যাংক ইউ ছােট মা । ছােট মা’র হয়ে আমি প্রায়ই বলি, ইউ আর ওয়েল কাম।

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

 সেদিন সন্ধ্যায় অন্য ব্যাপার হল। অবাক হয়ে দেখলাম ছােট মা টেবিলের দিকে যাচ্ছেন। বইটা হাতে নিয়ে বিছানার দিকে ফিরছেন। বইটা আমার দিকে ধরে আছেন। আমি এতই অবাক হয়েছি যে হাত বাড়িয়ে বইটা নিতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। ছােট মা আমার বিছানার পাশে বইটা রেখে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। খােলা দরজাটা হাত দিয়ে ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। ভয়ে আমার চিৎকার করে ওঠা উচিত ছিল। আমি চিৎকার করলাম না। ভয়ের চেয়ে বিস্ময়বােধই আমার প্রবল ছিল। চোখে ভুল দেখেছি এই জাতীয় চিন্তা আমার একবারও মনে আসে নি। বরং মনে হয়েছে আমি যা দেখছি ঠিকই দেখছি। ছােট মা আমাকে দেখতে এসেছেন। আমার শরীর ভাল না তাে এই জন্যে আমাকে দেখতে এসেছেন। 

নিঃসঙ্গ শিশুরা তার চার পাশের জগৎ সম্পর্কে অনেক ব্যাখ্যা নিজেরা দাড় করায়। আমিও একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে ফেললাম। এই ব্যাখ্যায় অসুস্থ শিশুকে দেখতে মৃত মানুষ ফিরে আসতে পারেন। 

যদিও আমি নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাড় করালাম তারপরেও আমার মনে হল এই ব্যাখ্যায় কিছু ফাকি আছে। ফাকির ব্যাপারটা আমি নিজে জানতে চাচ্ছিলাম 

কাজেই মাকে দেখতে পাওয়ার কথাটা কাউকে বললাম না। আমার মনে হল পুরাে ব্যাপারটায় এক ধরনের গােপনীয়তা আছে। কেউ জেনে ফেললে মা রাগ করবেন, তিনি আর আসবেন না।।

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

 সেই রাতে আমার জ্বর খুব বাড়ল। মাথায় পানি দেওয়া হল। তাতে কাজ হল না। বাথটাবে বরফ মেশান ঠাণ্ডা পানিতে আমাকে ডুবিয়ে রাখা হল। ডাক্তার 

ডাকা হল। চিটাগাং-এ আমার বাবাকে জরুরি খবর পাঠান হল। আমার খুব ভাল লাগতে লাগল এই ভেবে যে, যেহেতু আমার শরীর খুব খারাপ করেছে আমার ছােট মা নিশ্চয়ই আবারও আমাকে দেখতে আসবেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তার জন্যে 

অপেক্ষা করতে লাগলাম । ছােট মা অবশ্যি এলেন না। 

আমার এই ঘটনা শুনে আপনি কি ভাবছেন তা আমি জানি। আপনি ভাবছেন হেলুসিনেশন। একটি নিঃসঙ্গ শিশু তার নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্যে নিজের মধ্যে একটি জগৎ সৃষ্টি করেছে। হেলুসিনেশনের জন্ম সেই জগতে। আপনারা সাইকিয়াট্রিস্টরা খুব সহজেই সব কিছু ব্যাখ্যা করে ফেলেন। আপনাদের কাছে রহস্য বলে কিছু নেই। আইনস্টাইন যখন বলেন সৃষ্টি রহস্যময়, সব রহস্যের জট এই মুহূর্তে খােলা সম্ভব না তখন আপনারা বলেন, ব্যাখ্যাতীত বলে কিছু নেই।

সব কিছু ব্যাখ্যা করা যায়। আমার এক জীবনে আমাকে অনেক সাইকো এনালিসিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি এই সব ব্যাপার খুব ভাল জানি। আপনাদের মত মনােবিদ্যা বিশারদদের দেখলে আমার সত্যিকার অর্থেই হাসি পায়। আপনারা একেকজন কি গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলেন, যেন পৃথিবীর সব কিছু জেনে বসে আছেন। অল্প বিদ্যা ভয়ংকর হয়। আপনাদের বিদ্যা শুধু যে অল্প তাই না, শূন্য বিদ্যা। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

আপনি কি রাগ করছেন? 

দয়া করে রাগ করবেন না। আমি জানি আপনি অন্যদের মত না। আপনি আপনার সীমারেখা জানে। প্রকৃতি মানুষের চারদিকে একটা গডি একে দিয়ে বলে দেয়-এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। তােমার অতি উন্নত জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়েও তােমাকে থাকতে হবে এই গড়ির ভেতর। এই সত্য আপনার জানা আছে। আপনি গন্ডি ভেতর থেকেও গন্ডি অতিক্রম করতে চেষ্টা করেন। এই খানেই আপনার বাহাদুরি। বড় বড় কথা বলছি ? হয়ত বলছি। তবে এগুলি আমার নিজের কথা না। অন্য একজনের কথা। সেই অন্য একজন প্রচুর জ্ঞানের কথা বলেন এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন। তিনি যে জ্ঞানের কথা বলছেন তা তখন মনে হয় না। একটু চিন্তা করলেই মনে হয় ওরে বাবারে— এ তাে অসম্ভব জ্ঞানের কথা। এই প্রসঙ্গে আমি পরে বলব। তবে আপনি হচ্ছেন মিসির আলি, কে জানে ইতিমধ্যে হয়ত অনেক কিছু বুঝে ফেলেছেন।। 

আপনি কি ভাবে চিন্তা ভাবনা করে একটা সমস্যার সমাধানের দিকে এগােন তা আমার জানতে ইচ্ছা করে। চিন্তা শক্তি আমার নিজের খুবই কম। সহজ রহস্যই ধরতে পারি না। আমাদের স্কুলে একবার একজন ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাতে 

এসেছিলেন। বেচারী খুবই আনাড়ী ধরনের। যে ম্যাজিকই দেখান সবাই ধরে ফেলে। একমাত্র আমিই ধরতে পারি না। তিনি যা দেখান তাতেই আমি মুগ্ধ হই। আপনার সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিও হয়ত ম্যাজিকের মত। সেই ম্যাজিক দেখে মুগ্ধ হতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা এই এতগুলি পাতা যে পড়লেন এরমধ্যে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনফরমেশন দিয়ে দিয়েছি। বলুন তাে ইনফরমেশনটা কি? যদি বলতে পারেন তা হলে বুঝব আপনার সত্যি বুদ্ধি আছে। বলতে না পারলে তেত্রিশ পৃষ্ঠায় দেখুন । 

মিসির আলি পড়া বন্ধ করলেন। তেত্রিশ পৃষ্ঠা না দেখে মেয়েটির সম্পর্কে বিশেষ কি বলা হয়েছে বের করার চেষ্টা করলেন। যা বলা হয়েছে তার বাইরে কি কিছু আছে? হ্যা আছে, মেয়েটা তার আসল নাম বলেছে। তার আসল নাম ফারজানা। ফানিম্যান ছড়াটির প্রতি লাইনের প্রথম অক্ষর নিলে ফারজানা নামটা পাওয়া যায়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *