এখন বাজছে সকাল ১১টা। কিছুক্ষণ আগে আমি নাস্তা খেয়ে লিখতে বসেছি। সকালের চা এখনও খাওয়া হয়নি। চা দিয়ে গেছে। চায়ের কাপ থেকে ধোয়া উড়ছে। আমার চায়ের কাপের ধোয়া দেখতে খুব ভাল লাগে।
মিসির আলি সাহেব আপনার কি চায়ের কাপের ধোয়া দেখতে ভাল লাগে ? মানুষের ভাললাগাগুলি একরকম হয়। না কেন বলুন তাে? মানুষকে তাে নানান ভাবে ভাগ করা হয়। তাদের ভাললাগা, মন্দলাগা নিয়ে তাদের ভাগ করা হয় না কেন? আপনারা সাইকিয়াট্রিস্টরা সে রকম ভাগ করতে পারেন না ?
যেমন ধরুন যে সব মানুষ – ক) চায়ের কাপের ধােয়া ভালবাসেন। খ) বেলী ফুলের গন্ধ ভালবাসেন। গ) চাঁপা রঙ ভালবাসেন।
তাদের মানসিকতা এক ধরনের। (আমার মত।) তাদের চিন্তা ভাবনায় খুব মিল থাকবে।
আচ্ছা আপনি কি আমার জ্ঞানী টাইপ কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন ?
থাক আর বিরক্ত হতে হবে না এখন আমি মূল গল্পে ফিরে যাই। এখন যে চ্যাপ্টারটা বলব সেই চ্যাপ্টারের নাম— নীতু আন্টি।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-৭
আমি ঘুমুচ্ছিলাম— রাত দশটা টশটা হবে। আমার ঘরের দরজা খােলা। ছােট মানুষ তাে কাজেই দরজা খােলা থাকত। যাতে রাতে-বিরাতে বাবা এসে আমাকে দেখে যেতে পারতেন। এই কাজটা বাবা করতেন— রাতে খুব কম করে হলেও দু’বার এসে দেখে যেতেন। তখন ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আমি ঘুমিয়ে থাকার ভান করতাম। কারণ কি জানেন? কারণ হচ্ছে আমি যখন জেগে থাকতাম তখন বাবা আমাকে আদর করতেন না। ঘুমন্ত অবস্থাতেই শুধু আদর করতেন। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতেন। হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতেন। এমন কি মাঝে মাঝে ঘুম পাড়ানি গানও গাইতেন। যদিও আমি তখন বড় হয়ে গেছি। ঘুম পাড়ানি গান শােনার কাল শেষ হয়েছে। ঘুমন্ত মানুষকে গান শুনানাে খুব মজার ব্যাপার না? আমার বাবা আসলেই বেশ মজার মানুষ। ভালবাসার প্রকাশকে তিনি দুর্বলতা বলে ভাবেন। (আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে, বাবা হয়ত আমাকে ভালবাসতেন না। ভালবাসার ভান করতেন। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে ভান করা যায় না বলেই আমি যখন ঘুমূতাম তখন ভান করতেন।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-৭
নীতু আন্টির মধ্যেও এই ব্যাপার ছিল। ভালবাসার প্রকাশকে তিনিও দুর্বলতা মনে করতেন। তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল কেউ যেন তাঁর দুর্বলতা ধরে না ফেলে। তিনি শুরু থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর দুর্বলতা আমি যেন ধরতে না পারি এটা নিয়ে সব সময় অস্থির থাকতেন।
তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখার গল্পটা শুনুন। আমি শুয়ে আছি। ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল। দেখি কে একজন আমার চুলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথম ভাবলাম ছােট মা। তারপরই মনে হল, না ছােট মা না— ইনার গায়ের গন্ধ অন্যরকম। বেলী ফুলের গন্ধের মত গন্ধ। আমি চোখ মেললাম। তিনি হাত সরিয়ে নিয়ে শুকনাে গলায় বললেন, ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফেললাম?
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তিনি আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, “শােন মেয়ে আমি এখন থেকে তােমাদের বাড়িতে থাকব। তােমার বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে।” আমি তাকিয়ে রইলাম। কিছু বললাম না। তিনি আগের মতই শুকনাে গলায় বললেন,
দু’জনকে মা ডেকে ফেলছ। আমাকে মা ডাকার দরকার নেই। আমাকে আন্টি ডাকতে পার। অসুবিধা নেই। আমার নাম নীতা। তুমি ইচ্ছে করলে নীতু আন্টিও ডাকতে পার।।
জ্বি আচ্ছা।
ঘর এত নােংরা কেন? চারদিকে খেলনা। কাল সকালেই ঘর পরিষ্কার করবে।
জি আচ্ছা।
শােবার ঘরে স্যান্ডেল কেন ? স্যান্ডেল থাকবে শােবার ঘরের বাইরে। শােবার ঘরটা থাকবে ঝকঝকে তকতকে, একদানা বালিও সেখানে থাকবে না। বুঝতে পারছ ?
তমি তাে হামমে)
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-৭
এখন থেকে শােবার আগে চুল বেঁধে শােবে। এতদিন তাে চুল বাঁধার কেউ ছিল না। এখন থেকে আমি বেঁধে দেব। আরেকটা কথা শুনে রাখ— আমি কিন্তু আহ্লাদ পছন্দ করি না। আমার সাথে কখনাে আহ্লাদী করবে না। না ডাকলে আমাকে এসে বিরক্ত করবে না। মনে থাকবে?
থাকবে। বাহ তােমার চুল তাে খুব সুন্দর। সিল্কি চুল।
এই বলে তিনি আমার মাথার চুল নিয়ে খেলা করতে লাগলেন। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললাম—ইনি—চমৎকার একজন মহিলা। ইনার সঙ্গে সব রকম আহ্লাদ করা যাবে। এবং আহ্লাদ করলেও তিনি রাগ করবেন না। আমি আরও বুঝলাম এই মহিলার ভেতরও অনেক ধরনের আহ্লাদীপনা আছে।।
নীতু আন্টি খুব সুন্দর ছিলেন। তাঁর মুখ ছিল গােলাকার। চোখ বড় বড়। তবে বেশির ভাগ সময়ই চোখ ছােট করে ভুরু কুঁচকে তাকাতেন। ভাবটা এরকম যে তিনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন।
তিনি বাড়িতে এসেই বাড়ির কিছু নিয়মকানুন পাল্টে দিলেন যেমন আগে একতলা থেকে কাজের মানুষরা কেউ দোতলায় আসতে পারত না। এখন থেকে পারবে। শুধু যে পারবে তাই না— একটা কাজের মেয়ে রাখা হল, যার একমাত্র কাজ আমার ঘর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা এবং রাতে আমার ঘরেই ঘুমান। তার জন্যে একটা ক্যাম্প খাটের ব্যবস্থা করা হল।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-৭
সে ঘুমুতে যাবার আগে আগে আমার শােবার ঘরে সেই ক্যাম্প খাট পাতা হত। কাজের মেয়েটার নাম শরিফা। পনের ষােল বছর বয়স। ভারী শরীর। দেখতে খুব মায়া কাড়া। তার ছিল কথা বলা রােগ। অন্যদের সামনে সে চুপ করে থাকত। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় যখন আমি ছাড়া আর কেউ থাকত না তখন সে শুরু করত গল্প | ভয়ংকর সব গল্প সে অবলীলায় বলত। গল্প শেষ করে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘুমুতে যেত। বাকি রাতটা আমার ঘুম হত ।
ভয়ংকর গল্পগুলি কি আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন। আপনার ধারণা ভয়ংকর গল্প মানে ভূত প্রেতের গল্প। আসলে তা না। ভয়ংকর গল্প মানে নারী পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গল্প। আমার কাছে ভয়ংকর লাগত কারণ এই ব্যাপারটা অস্পষ্ট ভাবে জানতাম। আমার কাছে তা নােংরা, অরুচিকর এবং কুৎসিত মনে হত। আমি শরিফার গল্পের একটা নমুনা দিচ্ছি। আপনি আমার মানসিক অবস্থা। ধরার চেষ্টা করছেন বলেই দিচ্ছি। অন্য কাউকে এ ধরনের গল্প আমি কখনও বলব না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। শরিফার যে গল্পটি আমি বলছি তা হচ্ছে তার কাছ থেকে শােনা সবচে ভদ্র গল্প। আমি শরিফার ভাষাতেই বলার চেষ্টা করি।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-৭
“বুঝছেন আফা—আমরা তাে গরীব মানুষ—আমরার গেরামের বাড়িত টাট্টিখানা নাই। টাট্টিখানা বুঝেন আফা? পাইখানারে আমরা কই টাট্টিখানা। উজান দেশে কয় টাট্টি ঘর। তখন সইন্ধা রাইত—আমার ধরছে‘পেসাব’ । বাড়ির পিছনে রওনা হইছি হঠাৎ কে জানি আমার মুখ চাইপ্যা ধরছে। চিক্কুর দিমু হেই উপায় নাই। আন্ধাইরে পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। খালি বুজতাছি দুইটা গুন্ডা কিসিমের লােক আমারে টাইন্যা লইয়া যাইতাছে। আমি ছাড়া পাওনের জন্যে হাত পাও মুচড়াইতাছি। কোনও লাভ নাই। এরা আমারে নিয়া গেল ইস্কুল ঘরে। এরার মতলবটা তাে আফা আমি বুঝতে পারতাছি। আমার কইলজা গেছে শুকাইয়া। এক মনে দোয়া ইউনুস পড়তাছি। এর মধ্যে ওরা আমারে শুয়াইয়া ফেলছে। একজনে টান দিয়া শাড়ি খুইল্যা ফেলছে।
গল্পের বাকি অংশ আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আপনি অনুমান করে নিন। এ জাতীয় গল্প রােজ রাতে আমি শুনতাম। আমার শরীর ঝিম ঝিম করত | সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অনুভূতি। যার সঙ্গে আমি পরিচিত না। তখন আমার বয়স – মাত্র তের।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-৭
মিসির আলি সাহেব শরিফার গল্প শােনার জন্যে আমি অপেক্ষা করতাম। ‘ভয়ংকর’ ভাল লাগত। আপনি লক্ষ্য করুন আমি ভাল শব্দের আগে ‘ভয়ংকর বিশেষণ ব্যবহার করেছি।
নীতু আন্টিও আমাকে গল্প বলতেন। সুন্দর সুন্দর সব গল্প । তার কিশােরী বয়সের সব গল্প। একান্নবর্তি পরিবারে মানুষ হয়েছেন। চাচাত বােন ভাই সব মিলিয়ে বাড়িতে অনেকগুলি মানুষ। সারাদিন কোথাও না কোথাও মজার কিছু হচ্ছে নীত আন্টির এক বােন আবার প্রানচেট করা জানত। সে রােজই আত্মা নিয়ে আসত। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মা— রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শেকসপীয়ার, আইনস্টাইন, এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসতেন খুব ঘন ঘন। প্লানচেট করলেই তিনি চলে আসতেন। দু’লাইন, চার লাইনের কবিতা লিখে যেতেন। সে সব কবিতা খুব উচ্চমানের হত
কে জানে কবিরা হয়ত মৃত্যুর পর তাদের কাব্য শক্তি হারিয়ে ফেলেন।