জাফর সাহেব বললেন, আমি ভাত খাব না। ঐ গাধাটাকে খাইয়ে দে। ‘গাধা বলছ কেন ? ………‘শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। স্কুল স্যাংশান করিয়ে সে গ্রামে মেয়েদের হাইস্কুল দেবে। সেই না–কি হাইস্কুলের হেড মাস্টার।
তুমি বেশি রেগে যাচ্ছ, বাবা। এসাে তুমি তােমার ঘরে শুয়ে থাক। শুয়ে শুয়ে তােমার Self control বইটা পড়।
‘তাের মা টেলিফোন করেছিল? ‘না। আমি টেলিফোন করব?’ ..‘কোন দরকার নেই। লেট দেম গাে টু হেল। তাের মা’র ব্যাপারে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি।
‘আমার কি মনে হয় জান বাবা? আমার মনে হয় তােমারই উচিত মা‘কে টেলিফোন কর। রাগারাগি তুমি করেছ, মা করেনি।
‘টেলিফোন করে কি বলব – আই এ্যাম সরি ?”
“কিচ্ছু বলতে হবে না। টেলিফোন করলেই মা’র রাগ পড়ে যাবে। তারপর যখন শুনবে – রাশেদা চলে গেছে। বাসায় একজন অতিথি — তখন সব সামলাবার জন্যে নিজেই আসবেন। করব টেলিফোন?”
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
জাফর সাহেব কিছু বললেন না। তিথি টেলিফোন সেট বাবার সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। মা’র সঙ্গে কথা বলার সময় যেন বাবা শুনতে না পান। শায়লা টেলিফোন ধরলেন। তিথি বলল, কেমন আছ মা?
শায়লা ভারী গলায় বললেন, ভাল । “রাগ কমেছে ?”
“রাগ কমাকমির এর মধ্যে কি আছে! বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি যখন। পুরােপুরিই এসেছি। তুই কি ভেবেছিস সুরসুর করে ফিরে আসব? তুই ভেবেছিস কি? তাের বাবা এক মাইল দূর থেকে ক্রলিং করে এসে আমার পায়ে ধরলেও লাভ হবে না।
তােমার রাগ তাে কমে নি মা, বরং বেড়েছে। এদিকে বাবা পুরােপুরি ঠাণ্ডা। মুখ শুকনাে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তােমার সঙ্গে কমপ্রমাইজে আসতে চান। আমাকে বললেন, তাের মাকে টেলিফোন কর। আমি নিজের ইচ্ছেয় টেলিফোন করিনি, মা। বাবা করালাে। | তুই তাের বাবাকে বল, আমি কোনদিনও তার ঐ সাধের ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকবো না। কতবড় সাহস, আমার মেয়েদের সামনে আমাকে বলে ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার !” ‘ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলা বাবার মুদ্রাদোষ।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
রাশেদাকেও বাবা ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেছেন। এবং রাশেদাও বিদেয় হয়ে গেছে। মা আমরা দারুণ বিপদে পড়েছি। এদিকে গোদের উপর ক্যানসারের মত অতিথপুর থেকে এক অতিথি এসে উপস্থিত। উনার হবি হচ্ছে মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলা। উনি জানিয়েছেন ঢাকার সব মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে উনি বিদেয় হবেন না।
‘চুপ কর। খামাখা বক বক করিস না। শুধু শুধু এত কথা বলিস কেন?” ‘বাবার সঙ্গে সত্যি কথা বলবে না, মা ?
‘মা, একটা কথা বলি, শােন। তুমি কি একটু ওভার রিএক্ট করছ না? তুমি পঁচিশ বছর ধরে বাবার সঙ্গে আছ, তুমি তাে জান চট করে রেগে যাওয়া বাবার স্বভাব। রেগে যায়, আবার রাগ চলেও যায়। কখনাে রাগ পুষে রাখে না। রাগ পুষে রাখার ব্যাপারটা কর তুমি।।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
“তুই আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস?‘ ‘উপদেশ দিচ্ছি না, মা। আর উপদেশ দিলেও তুমি সেই উপদেশ শােনার পাত্র । বাবা তােমাকে ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলাতে তুমি বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেলে — বাবা তো কোন কারণ ছাড়া হঠাৎ রেগে গিয়ে তােমাকে ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেনি ... সব মিলিয়ে বিচার করে দেখ নিশ্চয়ই তুমি এমন কিছু করেছ যেখান থেকে বাবার ধারণা হয়েছে ...‘
‘তুই আমাকে বিচার করা শেখাচ্ছিস! তাের এতবড় সাহস! তুই আমাকে...
‘এত চেঁচাচ্ছ কেন, মা? আমি তাে চেঁচাচ্ছি না। ঠিক আছে মা, তুমি বেশি রেগে যাচ্ছ। আমি রাখি, পরে কথা বলব।”
‘খবর্দার ! টেলিফোন রাখবি না। টেলিফোন ধরে থাক।
‘আচ্ছা মা, টেলিফোন ধরে আছি। বল কি বলবে। শান্তভাবে বল, মা।
মামারা কি মনে করবে!
তিথি টেলিফোন ধরে রইল। শায়লা বললেন, খবর্দার, কোনদিন তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না। কোনদিন না।
“আচ্ছা বলব না।”
“আর তুই তাের বাবাকে বলবি তাকে আমি শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দেব। মাথা কামিয়ে তাকে আমার সামনে আসতে হবে। কতবড় সাহস আমাকে চাকর বাকরের সামনে অপমান করে। আমাকে ‘স্টুপিড‘ বলে। ষ্টুপিড পানিতে গুলে তাকে খাইয়ে দেব।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
শায়লা ঘটাং করে টেলিফোন রাখলেন।
তিথি বাবার ঘরে ঢুকল। জাফর সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। হাতে সত্যি সত্যি ‘self control‘–এর বই। তিথিকে ঢুকতে দেখেই আগ্রহ নিয়ে বললেন, কথা। হয়েছে তাের মার সঙ্গে ?
“হ্যাঁ হয়েছে।‘ “কি বলল?
‘তিথি ইতস্তত করে বলল, তেমন কিছু বলেনি। তবে মনে হয় তাঁর নিজের আচার–আচরণে খানিকটা লজ্জিত। এখন লজ্জায় পড়ে টেলিফোনও করতে পারছে । ফিরেও আসতে পারছে না। তুমি বরং কাল নিজে গিয়ে নিয়ে এসাে। প্রথমে হয়ত খানিকক্ষণ মিথ্যা রাগ দেখিয়ে চেঁচামেচি করবে। তুমি পাত্তা দিও না।
তিথি লক্ষ্য করল তার বাবার মুখ থেকে অন্ধকার অনেকখানি সরে গেছে। বাবার অনন্দিত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া লাগছে। মা কেন যে এই মানুষটার উপর রাগ করে !
জাফর সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, ইরা আর মীর ওরা কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল ?
“হ্যাঁ বাবা, চাচ্ছিল। আমিই তােমাকে দেইনি। মা‘র সঙ্গে কথা না বলে ওদের সঙ্গে কথা বললে – মা রেগে যাবে। তুমি যেমন ফট করে রেগে যাও, মাও তাে সে রকম রাগে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
‘দ্যাটস টু। তুই যা, ঐ ছেলেটার ঘর দেখিয়ে দে। তিথি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রওনা হল।
নুরুজ্জামান লুঙ্গি পরে সােফার এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে। তিথিকে দেখে আগের মত লাফ দিয়ে দাঁড়াল। তিথি বলল, আসুন, আপনাকে আপনার থাকার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। সরি, অনেকক্ষণ একা একা বসিয়ে রেখেছি।
নুরুজ্জামান মেয়েটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ একা একা বসিয়ে রেখেছি’ – কি সুন্দর করে কথাগুলি বলল। বলার কোন দরকার ছিল না। তাকে তাে একা একাই বসিয়ে রাখবে। তার সঙ্গে গল্প করার কার এমন দায় পড়েছে। নুরুজ্জামান বলল, ডিমগুলাে কি করব। এখানে সতেরােটা ডিম আছে। আঠারােটা দিয়েছিলেন একটা ভেঙ্গে গেছে। ‘ডিমের ব্যবস্থা আমি করব আপনি আসুন। নুরুজ্জামান উঠে এল।
‘এটা আপনার ঘর। সঙ্গে এটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমের একটা জিনিস আপনাকে দেখিয়ে দি। এটা গরম পানির, এটা ঠাণ্ডা পানির কল। গোসলের সময় ঠাণ্ডা–গরম দুরকম মিশিয়ে নেবেন। শুধু গরম পানির কল ছাড়লে কিন্তু বিপদে। পড়বেন। খুব গরম পানি আসে। একেবারে বয়েলিং ওয়াটার। মশারি নেই। মশারির দরকারও নেই। নতলা পর্যন্ত মশা উঠতে পারে না। কাবার্ডে দুটা কম্বল আছে। জানালাটানালা বন্ধ থাকলে শীত আসে না। একটা কম্বলেও শীত মানার কথা, তারপরেও যদি শীত না মানে ...। ভাত দিতে একটু দেরি হবে, আপনার কি খুব। খিদে পেয়েছে?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
নুরুজ্জামান বলল, জ্বি।
‘তাহলে আমি বরং এক কাপ চা আর বিসকিট দিয়ে যাই। আধঘণ্টার মধ্যে ভাত দিয়ে দেব?”
“জি আচ্ছা।।
তিথি রান্নাঘরের দিক রওনা হল। তার মায়া লাগছে। খিদে লেগেছে কি–না। জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। কেউ বলে না। বলার নিয়ম নেই। সভ্য সমাজের নিয়ম হচ্ছে ভদ্রতা করে বলতে হয়, খিদে নেই।