তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৬) হুমায়ূন আহমেদ

তেতুল  উনাকে কিছু উপহার দিব এই সামর্থ আমার নাইআপনার জন্যে কিছু পাকা তেতুল আনলামআমার গাছে হয়েছেনবনী বলেছিলগাছ থেকে পেড়ে এনেছেন

জ্বি। গাছে কি এখনাে তেতুল ঝুলছে ? 

জ্বি। 

এইগুলাে আপনি নিয়ে যানআমি গাছে উঠে নিজের হাতে পাকা তেতুল পাড়ব

তেঁতুল বনে জোছনা 

ইমাম সাহেব খুবই লজ্জিত গলায় বলেছেনএটা সম্ভব নামসজিদের কাছে গাছসেই গাছে মেয়েছেলে উঠে তেতুল পাড়বেএটা ঠিক না। 

নবনী তেজি গলায় বলেছিল, ঠিক না কেন? আল্লাহ রাগ করবেন ? তার উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছেন, আল্লাহপাক এত সহজে রাগ করেন কিন্তু মানুষ রাগ করেআমরা এমন যে মানুষের রাগটাকেই বেশি ভয় পাই। 

ইমাম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছেতিনি মেঝেতে পাটির ওপর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছেনশীতল পাটি বমিতে মাখামাখিতিনি বমির মধ্যেই শুয়ে আছেনকিছুক্ষণ পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছেনতার মনে হয় এজমা আছেযতবারই নিঃশ্বাস নিচ্ছেন বুকের ভেতর থেকে শো শো শব্দ আসছেঘরে কটু গন্ধ। 

মতি বলল, ইমাম সাব জাগনা আছেন ? ডাক্তার সাব আসছেন। 

ইমাম সাহেব মাথা তুলে তাকালেনআবার মাথা নামিয়ে ফেললেনতাকে দেখে মনে হলাে না তিনি কাউকে চিনতে পেরেছেন। 

আনিস বলল, মতি উনাকে গােসল দেয়া দরকারগােসল করাতে পারবে

মতি বলল, আপনে বললে পারব। 

আনিস বলল, বালতিতে করে পানি আনসাবান আনদুজনে মিলে গােসল দিয়ে দেই। 

মতি বলল, আপনার এত ঠেকা কী ডাক্তার সাব! ডাক্তার বিরক্ত গলায় বলল, সে একজন রােগীএই জন্যেই আমার ঠেকা। 

মতি ডাক্তারকে হাত দিতে দিল নানিজেই সাবান দিয়ে ডলে গােসল দিলশরীর মুছে শুকনাে কাপড় পরিয়ে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিলইমাম সাহেবের গায়ে জ্বর নেইজ্বর ছাড়াই তিনি কাঁপছেনআনিস বলল, আপনি রাতে কিছু খেয়েছেন

ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জ্বি নাআপনার খাবার কে বেঁধে দেয় ? আমি নিজে রাব্ধি ডাক্তার সাব। 

আমি আপনার জন্যে এক গ্লাস দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছিখেয়ে শুয়ে থাকুনদুটা ট্যাবলেট পাঠাবদুধ খাওয়ার পরে খাবেনঘুমের ওষুধভালাে ঘুম হবে। 

ইমাম সাহেব কিছু বললেন নাচোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেনডাক্তার দ্রুত চিন্তা করছেঘুমের ওষুধ ছাড়াও কি আরাে কিছু দেয়া দরকারমানুষটার স্নায়ুর ওপর দিয়ে একটা ঝড়ের মতাে গিয়েছেউত্তেজিত স্নায়ু ঠিক করতে হলে কী সিডেটিভ দিতে হবে ? মানুষটা একা থাকে একজন কেউ সঙ্গে থাকলে ভালাে হতােকথাবার্তা বলতে পারতমানুষের সঙ্গ মাঝে মাঝে ওষুধের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর হয়। 

ডাক্তার সাব আপনার অনেক মেহেরবাণী মেহেরবানির কিছু না আপনি বিশ্রাম করুন। 

ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যে অপরাধের জন্যে আমার শাস্তি হয়েছে সেই অপরাধ আমি করি নাইতবে নিশ্চয়ই কোনাে অপরাধ করেছিযে কারণে আল্লাহপাকের নির্দেশে আমার শাস্তি হয়েছেউনার অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না। 

ডাক্তার বলল, আপনি কথা বলবেন নাবিশ্রাম করুনআমি ওষুধ পাঠাচ্ছি। 

ইমাম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেনবিড়বিড় করে নিজের মনেই বললেন, ডাক্তার সাব আপনার মেহেরবানি। 

ফেরার পথে মতি তিক্ত গলায় বলল, কেমন মানুষ দেখছেন ডাক্তার সাব ? মুখে একবার বলল না ধন্যবাদবমি সাফ করা আর সাফ করা একইবমি পেটে আর কিছুক্ষণ থাকলেই গু হইয়া যায়কথা সত্য কিনা বলেন ডাক্তার সাব। 

আনিস জবাব দিল নাইমাম সাহেবের বাড়ি গ্রামের শেষ মাথায়আনিসকে শরীরে জ্বর নিয়ে অনেকখানি হাঁটতে হয়েছেবেশ খারাপ লাগছেঅসহ্য লাগছে মতির বকবকানিআনিস মতিকে চলে যেতে বলতে পারছে নাকারণ মতিকে দিয়ে ওষুধ পাঠাতে হবে। 

গরম কেমন পড়ছে দেখছেন ডাক্তার সাব

এখন আশ্বিন মাসকেঁথাশীত পড়নের কথাপড়ছে গরমদুনিয়া উলট পার্ট হওয়া শুরু হইতেছেকেয়ামত মনে হয় কাছাইয়া পড়ছেকী কন

হতে পারে। 

মতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, কেয়ামতের আগে আগে মাটির তল থাইক্যা এক জন্তু বাইর হইবহে মানুষের মতাে কথা বলবএই জন্তুটা দেখার বড় শখ ছিলদশ পনরাে বছরের মধ্যে কিয়ামত হইলে জন্তুটা দেখতে পারতামঅন্তুর সাথে দুই চাইরটা কথা বলতে পারতামডাক্তার সাব আপনের কি মনে হয় দশ বছরের মধ্যে কিয়ামত হইতে পারে

জানি না মতি। 

জন্তুটা কোন ভাষায় কথা বলব কে জানে! চাইনীজ ভাষায় কথা বললে আমরা বাঙালিরা কিছুই বুঝব না। 

 মতি, কথা বলা একটু বন্ধ রাখমাথা ধরেছে। 

আমার নিজেরাে মাথা ধরছে ডাক্তার সাব এই জন্যেই কথা বেশি বলতেছি। আমি একটা জিনিস পরীক্ষা কইরা বাইর করছিমাথায় যদি খুব যন্ত্রণা হয় তাইলে কথা বললে যন্ত্রণা কমেআর কথা না বইল্যা ঘরের চিপাত বইস্যাথাকলে মাথা ধরা বেজায় বাড়ে। 

এক গ্লাস দুধ, দুটা বিসকিট আর ওষুধ নিয়ে মতি রওনা হলাে ইমাম সাহেবের বাড়ির দিকে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *