তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ

 প্রচণ্ড ভারি, সাবধানে নামাও। 

আফা আপনে নিশ্চিন্ত মনে নিচে গিয়া বসেনআমার দেখা পাইছেন আর চিন্তা নাই। 

নবনী ট্রেন থেকে নামলপিচকিরি দিয়ে হলুদ রঙ ছােড়ার ব্যাপারটা এখনাে ঘটছেরঙ আরাে গাঢ় হচ্ছেতার কাছেই রকম লাগছে, না অন্য সবার কাছেই লাগছে সে বুঝতে পারছে না

তেঁতুল বনে জোছনা

ট্রেন থেকে যারা নামছে তাদের কাউকেই মুগ্ধ চোখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখা যাচ্ছে নারবীন্দ্রনাথ যদি ট্রেনে তার সঙ্গে আসতেন তাহলে কী করতেন ? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতেন? হাত বাড়িয়ে হলুদ আলাে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেন ? প্লটফরমে নেমে স্যুটকেসের ওপর বসে কাগজ কলম নিয়ে গান কিংবা কবিতা লিখতে বসতেন

আলাে ভাঙ্গার এই আলাে। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই কী সুন্দর! কী সুন্দর!বলে উচ্ছাস প্রকাশ করতেন না। 

এত বড় মানুষদের উচ্ছ্বাস মানায় না। তীব্র উচ্ছ্বাস কিশােরীদের এলাকা

 কিশােরীদের এলাকায় কিশােরীদেরই মানায় অন্য কাউকে মানায় নাহাতের তালুতে তেতুলের আচার নিয়ে যখন কোনাে কিশােরী চেটে চেটে খাবে তাকে মানাবেরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মানাবে না। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ

আফা দেখেন জিনিস সব নামছে কিনা। 

নেমেছে, থ্যাংক য়ুএখন একটা ভ্যানগাড়ি দেখ চল রওনা দেইএর আগের বার তুমিই তাে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলে

অবশ্যই আমিহেইবার আফনের পরনে ছিল কচুয়া রঙের শাড়ি, লাল সুতার হিজিবিজি পাইর। 

ঠিকই বলেছ, মতি শােন আমরা দেরি করছি কেন? পাঁচ দশ মিনিট বসতে হইব আফাবসতে হবে কেন

সইন্ধা মিলইতাছে তাে, এই সময় যাত্রা নাস্তিসইন্ধ্যা মিলাউকফ্লাস্কটা দেনগরম পানি আইন্যা দেইচা বানায়ে খানআপনের সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম আছে না আফাগতবার ছিল। 

এবারও আছে। 

গরম পানি আইন্যা দিতাছি চা খানএই ফাকে আমি ভ্যানগাড়ি ঠিক করিদশ মিনিটের মামলাআফা মাথাত কাপড় দেনআজান হইতেছে। 

নবনী মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিলমতি লােকটাকে তার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছেপ্রথমবার যখন দেখা হয়েছে তখন এত ইন্টারেস্টিং মনে হয় নিমনে হলে লােকটার কথা মনে থাকতকোনাে মানুষই সবসময়ইন্টারেস্টিং থাকে নামাঝে মাঝে ইন্টারেস্টিং হয়আজ এই মুহূর্তে মানুষটাকে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছেসন্ধ্যা মিলাবার পর হয়তাে আর মনে হবে না। 

মতি প্রবল উত্তেজনা বােধ করছেউত্তেজনার কারণ স্পষ্ট নাসে অতি দ্রুত গরম পানি জোগাড় করলনবনীর সামনে গরম পানি ভর্তি ফ্লাস্ক নামিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলখবর পেয়েছে বাজারে গরু জবেহ হয়েছে। ভাগা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এক টাকা ভাগাএক ভাগ ডাক্তার সাহেবের জন্যে কিনে নেয়া যায়এই অঞ্চলে গরুর মাংস সচরাচর পাওয়া যায় নাগরু জবেহ হয় শুধু হাটবারআজ হাটবার নাভাগ্যক্রমে পাওয়া গেলডাক্তার সাহেবের স্ত্রী এত দিন পর এসেছেনআলু ভর্তা দিয়ে তিনি যদি রাতে ভাত খান তাতে 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ

ডাক্তার সাহেবের ইজ্জত রক্ষা হবে নাডাক্তার সাহেবের ইজ্জত রক্ষার চিন্তায় 

মতিকে খুব অস্থির মনে হলো। 

নবনী যত্ন করে চা বানাচ্ছেহ্যান্ডব্যাগ থেকে সুগার কিউব, টি ব্যাগ বের হলােফ্লাঙ্কের লাল মুখটা হলাে চায়ের কাপ। দূর থেকে কয়েকজন আগ্রহ নিয়ে তার চা বানানাে দেখছেতাদের জন্যে নিশ্চয়ই মজার দৃশ্যএকটা মেয়ে সুটকেসে বসে বেশ আয়েশ করে চা বানাচ্ছে এই দৃশ্য নিশ্চয়ই সচরাচর দেখা যায় না। 

নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিলখেতে ভালাে লাগছেআরেকজন কেউ পাশে থাকলে হয়তােবা আরাে ভালাে লাগতরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশে থাকলে অসাধারণ একটা ব্যাপার হতােনবনী তাঁকে কী ডাকত ? গুরুদেব ? নাগুরুদেব মানে অনেক দূরের কেউপাশে বসে যিনি চা খাবেন তিনি দূরের কেউ

নবনী মনে মনে কথা বলা শুরু করল সময় কাটানাের এটা একটা ভালাে বুদ্ধিরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথােপকথন। 

কবি চা খেতে কেমন হয়েছে ? ভালােআলাে ভাঙার আলােএটা কবিতা না গান । 

কবিতাতবে বাণীতে সুরের আশ্রয় হলেই তাে গানসেই অর্থে গানও বলতে পার। 

শুধু প্রথম লাইন লিখলেন ? শেষ তত করলেন নাপ্রথম লাইনটা হলাে বীজবীজ বপন করা হয়েছে বৃক্ষ আসবে। 

লাইনটার মানে বুঝতে পারলাম নাআলাে ভাঙ্গার আলােএর মানে কী

তােমার মনে যে অর্থ আসে সেটাই মানেআরাে সহজ করে বুঝিয়ে দেইযখন আমি কোনাে গান বা কবিতা লিখি তখন সেটা থাকে আমারশুধুই আমার যখন তুমি সেটা পড় বা গুনগুন করে গানটা গাও তখন সেটা সম্পূর্ণই তােমারসন্তান জন্ম দেই আমি কিন্তু দত্তক দিয়ে দেয়া হয় তােমাদের। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ

কবি আপনাকে কি আরেক কাপ চা বানিয়ে দেব

প্রথম চায়ের স্মৃতিটি মাথায় রাখতে চাইদ্বিতীয় কাপ হয়তাে প্রথম বারের মতাে ভালাে হবে নাসুন্দর স্মৃতি থাকা ভালাে নাতুমি যাচ্ছ কোথায়

আমার স্বামী গ্রামে ডাক্তারি করেনআপনি চলুন না আমার সঙ্গেকয়েকটা দিন থেকে আসবেনআপনি গ্রামের পােস্ট মাস্টার নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন আমার স্বামীকে নিয়েও একটা গল্প লিখতে পারবেনগল্পটার নাম দেবেন গ্রাম চিকিৎসক। 

তোমার নিমন্ত্রণ মনে থাকলকোনাে এক সময় উপস্থিত হবআপনাকে ইস্টিশনে একা ফেলে চলে যেতে খুব খারাপ লাগবে। 

আমার কোনো সমস্যা হবে নাহাঁটতে হাঁটতে দিনের আলাে কীভাবে নিভে যায়, কী করে নির্জন স্টেশনে আঁধার নামে তাই দেখবএই দৃশ্য একজীবনে কতবার দেখলাম তারপরেও প্রতিবারই নতুন মনে হয়যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে...। 

ইট বিছানাে রাস্তামাঝে মাঝে ইট উঠে গেছেরাস্তা গেছে ডেবেভ্যানগাড়িতে খুব ঝাঁকুনি হচ্ছেঝাঁকুনির চেয়েও বড় সমস্যা ধূলা উড়ছেনবনীর ডাস্ট এলার্জি আছেএলার্জির এটাক হলে হাঁচি উঠতে থাকবেনবনী শাড়ির আঁচলে নাক মুখ ঢেকে রেখেছেইট বিছানাে রাস্তায় এত ধূলা ওড়ার কথা নাকেন উড়ছে কে বলবে! রাস্তার দুপাশে শিমুল গাছের সারিএকেকটা গাছ কাঁটাওয়ালা দৈত্যের মতােরাস্তা পাহারা দিতে দৈত্যের সারি নেমেছে। 

মতি ভ্যানগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসেছেতার হাতে কচুপাতায় মােড়া গরুর গােশতজিনিসটা সে আড়াল করে রাখছেঅতিথিকে রাতে যে খাবার খাওয়ানাে হবে সেই খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এটা অতিথির জন্যে 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ

অপমানসূচকঅতিথি যেন দেখতে না পায়। 

মতি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আফারে একটু সাবধান কইরা দেইরাইতে ঘর থাইক্যা বাইর হইবেন নামনে করবেন কাফু জারি হইছেযদি বাইর হইতেই হয় হারিকেন হাতে বাইর হইবেনটর্চ না, হারিকেন। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *