তোমাদের এই নগরে পর্ব:১১ হুমায়ূন আহমেদ

তোমাদের এই নগরে পর্ব:১১

ওসি সাহেব আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বেল টিপে ডিউটি অফিসারকে ডাকালেন।আমি গলা নামিয়ে অতি বিনিয়ের সঙ্গে বললাম, আরেকটা ফুলের মালা যদি আনিয়ে দেন। আবুল কালাম সাহেবের গলায় মালাটা পরাব। গলায় মালা পরে জেল থেকে অনেকে বের হয়েছেন। হাজত থেকে কেউ বের হন নি। একটা রেকর্ড হয়ে যাক।আপনার নাম হিমু? জি।এই দিন দিন না। আরো দিন আছে— এই গানটা শুনেছেন?

টিভিতে দেখেছি স্যার। কুদ্দুস বয়াতী একদল বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গানটা করে।গানের কথাগুলি মনে রাখবেন। ভবিষ্যতে আপনাকে যদি আমি ট্রিট করতে না পারি তা হলে আকিকা করে আমি আমার নাম আলম খান বদলায়ে রাখব।–কুত্তা খান। আপনি আকিকার দাওয়াত পাবেন।

রাগে ওসি সাহেবের শরীর কাঁপছে। তিনি রাগ সামলাতে পারছেন না। ডিউটি অফিসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওসি সাহেব তার দিকে তাকিয়ে বললেন–এই লোক কী বলছে শুনুন আর একটা ফুলের মালা আনিয়ে দিন।আবুল কালাম সাহেবের গলায় গাদা ফুলের মালা। তিনি এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছেন। আমি বললাম, শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?

জি না।

মালা গলায় নিয়ে হাঁটতে যদি খারাপ লাগে মালাটা খুলে ফেলুন।

জি না।

রিকশা নেব?

না।

যাবেন কোথায় ঠিক করেছেন? মেসে ফিরে যাবেন? না।ঢাকায় আত্মীয়স্বজন কেউ আছে? ঠিকানা বলুন সেখানে নিয়ে যাই। ঢাকায় তেমন পরিচিত কেউ নাই। দেশের বাড়ি চলে যাব চাঁদপুর। লঞ্চে করে যাব।চা খাবেন? চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে বসে চা খাই, তারপর ঠিক করি কী করা হবে। চাঁদপুরে চলে যেতে চাইলে চলে যাবেন।পুলিশের কাছে হাজিরা দিতে হবে না?

না। আপনাকে পুলিশ আর ঘাঁটাবে বলে মনে হয় না। আইজি সাহেব আপনার প্রসঙ্গে যেভাবে বলেছেন তারপর আর কিছু বলার থাকে না।উনি কি বলেছেন আমি সৎ লোক।অবশ্যই।কেন বলেছেন। উনি তো আমাকে চিনে না।আমি তাঁকে বলতে ঘলেছিলাম। উনি আপনাকে না চিনলেও আমি চিনি।হিমু ভাই আপনার ধারণা আমি একজন সৎ লোক? অবশ্যই।আবুল কালাম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, এই প্রথম একজন কেউ বলল, আমি সৎলোক। এর আগে কেউ কোনোদিন বলে নাই।

স্কুলে পড়ার সময় আমি একবার একটা কলম চুরি করেছিলাম— তারপর আমার নাম হয়ে গেল— চোর কালাম! স্কুলে দুজন কালাম ছিল। তাকে ডাকত ভালো কালাম, আমাকে ডাকত চোর কালাম।কে কী ডাকত তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি তো জানেন। আপনি কী? আপনি নিজেকে জানেন না? জানি। আমি হলাম চোর কালাম। দুই লাখ টাকা আমি সত্যিই চুরি করেছি। আপনি ফুলের মালা গলায় পরিয়ে একটা চোরকে বের করে নিয়ে এসেছেন। কাজটা ঠিক করেন নাই।

কালাম সাহেব বড় বড় করে নিশ্বাস নিচ্ছেন। আমি তাকিয়ে আছি। কালাম সাহেব তাকালেন আমার দিকে। শান্ত গলায় বললেন, আমি এখন সদরঘাট টার্মিনেলে চলে যাব। সেখান থেকে যাব চাঁদপুর। ভাই সাহেব যাই? ফুলের মালা গলায় দিয়ে কালাম সাহেব হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। আরো অনেকেই তাকে দেখছে। গাদা ফুলের মালা গলায় দিয়ে ঢাকা শহরে কেউ হাঁটাহাটি করে না।

জয়নাল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গায়ে জ্বর, বুকে সামান্য ব্যথা। বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়— উঠে বসলেই বুক ধড়ফড় করে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কিছু খেতেও পারছেন না। খাবার মুখে দিলেই বমি আসে। তার চেহারা একদিনে নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, গোলগাল মুখ লম্বাটে হয়ে গেছে। কথাও বলছেন হাসের মতো ফ্যাসফেসে গলায়।

অসুখটা হয়েছে আমার কারণে। আমি আবুল কালামকে দেখতে গিয়ে ফিরছি না দেখে তিনি টেনশনে অস্থির হয়ে আমার খোঁজ নিতে থানায় যান। সেখানে জানতে পারেন আমাকে হাজতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখনি তাঁর বুকে ব্যথা শুরু হয়। থানার সামনের রাস্তার পাশের নর্দমায় দুবার বমি করেন।

লোকজন তাঁর অবস্থা দেখে ফুটপাতেই শুইয়ে দেয়। আধঘণ্টা ফুটপাতে বিশ্রাম করে মেসে ফিরে শয্যাশায়ী।আমি বললাম, সামান্য কারণে বুকে ব্যথা বাধিয়েছেন? উঠে বসুন তো। আমি ঠিকঠাক মতো ফিরে এসেছি।জয়নাল সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনাকে দেখে খুবই আনন্দ লাগছে। ভাই সাহেব কিন্তু বুকের ব্যথাটা যাচ্ছে না। নিশ্বাস নিতে পারছি না।

সন্ধ্যাবেলা জয়নাল সাহেবের বুকে ব্যথা আরো বাড়ল। মেসের সামনে গ্রিন ফার্মেসির ড্রাক্তার সাহেবকে ডোর্কে নিয়ে এলাম। ডাক্তার বললেন, পেটে গ্যাস হলে বুকে ব্যথা হয়। মনে হচ্ছে পেটে গ্যাস হয়েছে। এন্টাসিড দিচ্ছি–এতেই কাজ হবে। ইসিজি করে দেখতে পারেন। হার্টের কোনো প্রবলেম থাকলে ধরা পড়বে। আমি অবিশ্যি তার কোনো দরকার দেখি না। তবু সেফ সাইডে থাকা। আমার পরিচিত একটা ক্লিনিক আছে। আমার নাম বলবেন টুয়েন্টি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দিয়ে দিবে।

রাত একটার দিকে জয়নাল সাহেবের অবস্থা খুব খারাপ করল। তাঁর প্রচণ্ড চোয়ালে ব্যথা শুরু হল। গা ঘামতে লাগল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, হিমু ভাই, মনে হয় মারা যাচ্ছি। যদি অপরাধ কিছু করে থাকি ক্ষমা দিয়ে দেবেন।আচ্ছা যান ক্ষমা দিলাম।এইভাবে বললে হবে-না ভাই সাহেব। আল্লাহ পাককে বলতে হবে— খাস দিলে ক্ষমা করতে হবে।আমি বললাম, ক্ষমার অংশটা আপাতত স্থগিত থাকুক। এই মুহুর্তে যা করতে হবে তা হল আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে; আমার ধারণা আপনার হার্ট এটাক হয়েছে। লক্ষণ তাই বলে।এত রাতে এম্বুলেন্স পাবেন?

দেখি চেষ্টা করে। এম্বুলেন্স না পেলে গাড়ি। গাড়ি না পেলে রিকশা, একটা ব্যবস্থা হবেই। হাসপাতাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যান।প্রয়োজনে কিছুই পাওয়া যায় না। এরকম কথা ভুল প্রমাণিত করে একটা এম্বুলেন্স অতি দ্রুত উপস্থিত হল। স্ট্রেচারে এম্বুলেন্সের লোকজন জয়নাল সাহেবকে নামিয়ে নিয়ে গেল। এম্বুলেন্সের পোঁ পোঁ শব্দ।

এত রাতেও লোক জমে গেল; জয়নাল সাহেব তাঁদেরকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, কিছুই হয় নাই সামান্য বুকে ব্যথা।পত্রিকায় প্রায়ই ডাক্তারদের অবহেলার কারণে মৃত্যুর খবর পড়ি। সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তারদের ছোটাছুটি দেখে মনে হল পত্রিকার খবর সব সত্যি না।

একজন রোগী চেহারার মহিলা ডাক্তার আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। ম্যাসিভ এটাক হয়েছে। দুদিন না কাটলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।আমি বললাম, আমার কি কিছু করণীয় আছে? আপনার কিছুই করণীয় নেই। অষুধপত্র কিনে দিতে হবে। সঙ্গে টাকা পয়সা আছে?

না। তবে যোগাড় করতে পারব।যোগাড় করুন। আপাতত আমরা চালাচ্ছি।রোগী কি বাঁচবে? মহিলা ডাক্তার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, রোগী আপনার কী হয়? কেউ হয় না। আমরা একই মেসে থাকি।আপনি রোগীয় আত্মীয়স্বজনকে খবর দিন। রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।বলেন কী?

যান টাকা পয়সা ব্যবস্থা করুন। সকালের মধ্যে যোগাড় হলেও চলবে। আমরা চালিয়ে নেব।আমি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললাম, রোগীর দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। এই বেচারা অতি সাধারণ একজন মানুষ কোনো মন্ত্রীর আত্মীয় না, কিছু না। তার সুপারিশ করার কেউ নেই! আপনার নাম কী?

হিমু।হিমু সাহেব শুনুন। আমরা সব সময় বলি– সব মানুষ সমান। একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো প্ৰভেদ নেই! কাৰ্যক্ষেত্রে কখনোই সেরকম দেখা যায় না। শুধু শেষ সময়ে, মৃত্যুর খুব কাছাকাছি এসে সব মানুষ এক হয়ে যায়। শুধু তখনই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাস্তায় ইট ভাঙে যে মেয়ে তার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। এই হাসপাতালের রোগীরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকেন কাজেই তারা সব সমান। বাইরের মানুষরা বিশ্বাস করুক বা না করুক আমরা সবাইকে একইভাবে দেখি; দেখতে দেখতে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করলেন?

জি বিশ্বাস করলাম। আমি টাকা নিয়ে আসছি। সকাল হবার আগেই চলে আসব।

ফরিদা খালা অবাক হয়ে বললেন, তুই এত রাতে?

আমি বললাম, কেমন আছ খালা?

রাত দুটার সময় কেমন আছ খালা? এর মানে কী? তুই সবার সঙ্গে ফাজলামি করিস বলে আমার সঙ্গেও করবি? কলিংবেল শুনে আমার বুক ধ্বক করে উঠেছে— এখনো ধ্বক ধ্বকানি হচ্ছে। এত রাতে কেন এসেছিস? তোর মতলবটা কী?

বিল নিতে এসেছি খালা।

বিল মানে? কিসের বিলা?

আশাকে নিয়ে দুদিন ঢাকা শহর দেখলাম। প্রতিদিন এক শ ডলার করে দু শ ডলার। পেমেন্টটা বাংলাদেশী কারেন্সিতে করলে ভালো হয়।অনেক রসিকতা করেছিস; আর করতে হবে না। তুই এক্ষুনি বিদেয় হবি।। এই মুহুর্তে। আমার সঙ্গে নাটক করবি না।

নাটক করছি না খালা। বিলটা আমার দরকার। তোমার কাছে যদি থাকে তুমি দিয়ে দাও। আর যদি না থাকে। আশাকে ডেকে তোল।খালী কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, রাতে কিছু খাই নি। ভাত খাব। তরকারি না থাকলে একটা ডিম ভেজে দাও। তোমার ঘরে তো সক সময় টাঙ্গাইলের গাওয়া ঘি থাকে। গরম ভাতের উপর ওই ঘি তরকারির চামচে এক চামচ ঢেলে দেবে। ডিম ভজিবে। সেই সঙ্গে দুটা শুকনা মরিচ ভাজবে।

হিমু শোন, তুই খুবই মতলববাজ ছেলে। মতলব ছাড়া তুই কখনো কিছু করিস না। রাত দুটার সময় এসেছিস। মতলব নিয়েই এসেছিস। এবং আমি যে সেই মতলব একেবারেই টের পাচ্ছি না, তাও না। তোকে তো অনেক দিন ধরেই দেখছি— তোর নাড়ি নক্ষত্র আমি জানি।জানালে বল দেখি আমার মতলব কী? তোর মতলব হচ্ছে আশার সঙ্গে কিছুক্ষণ লটরপটর করা। তার মাথাটা আরো খারাপ করে দেওয়া। মেয়েটাকে হকচাকিয়ে দিতে হবে। রাত দুটার সময় বিলের টাকা চাইলে সে হকচাকিয়ে যাবে। ঠিক বলছি না?

হুঁ।তুই চলিস পাতায় পাতায়— আমি চলি— শিরায় শিরায়। আমাকে হাইকোর্ট দেখাবি না। আমি বাস করি হাইকোর্টের ভিতরে।গলা নামিয়ে কথা বল খালা— তুমি সবার ঘুম ভাঙাবে।তুই বাসা থেকে বের হবি কি না সেটা বল।ভাত খেয়ে যাই— ক্ষুধার্তা মানুষকে না খাইয়ে বিদেয় করলে— তুমিই পরে অনুশোচনায় দগ্ধ হবে। তোমার অনিদ্রা হবে। অনিদ্রা থেকে পেপ্যাটিক আলসার…সেখান থেকে…

চুপ থাক। একটা কথাও না চুপ।আমি চুপ করলাম আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আশা দরজা ধরে দাঁড়াল। দেখে মনে হচ্ছে সে সেজেণ্ডজে আছে। চুল আঁচড়ানো। গায়ে ইন্ত্রি করা শাড়ি। ইন্ত্রি করা শাড়ি পরে রাত দুটার সময় কেউ বসে থাকে না। ঠোঁটে লিপস্টিকও থাকার কথা না। আশার ঠোঁটে টকটকে লাল রঙের গাঢ় লিপস্টিক। আশা আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল— আমার ঘরে আসুন।

খালার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, খালা যাব?

খালা জবাব দিলেন না। চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলেন।

আশা বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন আসুন।

খালার মুখ রাগে থমথম করছে। এই রাগ সহজে যাবার না। আমি বললাম, খালা তুমি ভাত-ডিমভাজির ব্যবস্থা কর আমি এই ফাঁকে আশার সঙ্গে কথা বলে আসি। পেমেন্টটাও নিয়ে আসি।

বিদেশিনী মেয়ের ঘর খুব গোছানো থাকবে, সুন্দর করে বিদেশী কায়দায় সাজানো থাকবে। ব্যাপার সেরকম না, আশার শোবার ঘরের খুবই এলেমেলো অবস্থা। খাটেক্স বিছানায় রাজ্যের ম্যাগাজিন; মেঝেতেও বালিস চাদর পাতা। ঘরময় কাপড়াচোপড় পড়ে আছে।

 

Read more

তোমাদের এই নগরে পর্ব:১২ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *