দারুচিনি দ্বীপ পর্ব:০২ হুমায়ুন আহমেদ

দারুচিনি দ্বীপ পর্ব:০২

আমার মনে হয় তুমি ভুল বলছি। ওরা তোমার অর্থ বিত্ত এইসব পছন্দ করে। তোমার মধ্যে পছন্দ করার মতো গুণাবলি বিশেষ নেই। তুমি মজার গল্প করতে পার না। আসর জমাতে পার না। তুমি অত্যন্ত ইস্ট্রোভার্ট ধরনের এক জন যুবক-যে এখনো বালকের খোলস ছাড়তে পারে নি।তুমি কি আমাকে যেতে নিষেধ করছ? না। তোমার বয়স বাইশ, তুমি নিশ্চয়ই তোমার ইচ্ছামত চলতে পার। আমি শুধু সমস্যাগুলোর প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রথমেই বলছি ভ্ৰমণ পরিকল্পনা কাগজে-কলমে যতটা ইন্টারেস্টিং বাস্তবে কখনোই তত ইন্টারেটিং হয়। না। দ্বীপে পৌঁছতে তোমাদের খুব কষ্ট করতে হবে—এত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তোমার নেই। দ্বীপে পৌঁছার পর শীতে কাবু হবে। বাথরুমের অভাবে কাবু হবে। তুমি হঠাৎ অবাক হয়ে লক্ষ্য করবে তোমার বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গও ততটা ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে না। তারা অশ্লীল সব রসিকতা করবে। তুমি তা-ও সহ্য করতে পারবে না।তুমি মনে করছি আমার যাওয়া উচিত নয়?

অবশ্যই তোমার যাওয়া উচিত। ছোট্ট একটা প্রবাল দ্বীপ। চারপাশে সমুদ্র, আকাশে Full moon–খুবই একসাইটিং। তুমি যাবে তো বটেই। তুমি তোমার মতো করে যাবে। আমি কক্সবাজারের ডিসি সাহেবকে টেলিফোন করে দেব। এ ছাড়াও আরো কিছু লোকজনকে বলব যাতে—টেকনাফ থেকে সেন্ট মাটিনে যাবার জন্যে ভালো জলযান থাকে। দ্বীপে চোর ডাকাত থাকতে পারে। কাজেই সঙ্গে পুলিশ দরকার। খাবার দাবারের ব্যবস্থা থাকাও প্রয়োজন। ক্ষুধা পেটে পূর্ণিমার চাদকে রুটির মতো লাগে। কার কথা যেন এটা? সুকান্তর।অবিকল এই রকম একটা কবিতার লাইন ইংরেজি কবিতায়ও পড়েছি।– Give me some salt, I will eat the moon…পড়েছ এই কবিতা? না।ইংরেজি কবিতা তুমি পড় না? না।

ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠতে উঠতে বললেন—তুমি আজকের দিনটা চিন্তা কর। কাল সকালে আমাকে বলবে কি করতে চাও। যা করতে চাও তাই হবে। বাইশ বছরের যুবক ছেলের উপর আমি কিছুই ইম্পোজ করতে চাই না। অবশ্যি আরেকটি ব্যাপারও আছে। দেশের সব মানুষ যেখানে গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলন করছে সেখানে তোমরা মজা করার জন্যে বেড়াতে যাচ্ছ এটা কেমন কথা? রেহানা বললেন, শুভ্র কখনোই কিছু চায় না। হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে—ঘুরে আসুক না।ইয়াজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, ওর কথা ওকেই বলতে দাও। শুভ্ৰ, তুমি কি যেতে চাও?

শুভ্র বলল, না। বলেই দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তার চোখে পানি এসে গেছে। বাবা-মাকে সে চোখের পানি দেখাতে চায় না।ইয়াজউদ্দিন হাতের ঘড়ি দেখলেন। বিশ মিনিট পার হয়েছে। তিনি উঠে পড়লেন। রেহানাকে বললেন, ও মন খারাপ করে না বলেছে। ওকে যেতে বল। ঘুরে আসুক। পৃথিবীর রিয়েলিটির সঙ্গে খানিকটা পরিচয় হোক।সঞ্জু বারান্দায় পাটি পেতে খেতে বসেছে।তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব ক্ষুধার্তা। বড় বড় নলা বানিয়ে মুখে দিচ্ছে। সঞ্জুর মা ফরিদা তার সামনেই বসে আছেন। অন্য দিন সঞ্জু খেতে খেতে গল্প করে আজ তাও করছে না।

ফরিদা অস্বস্তি বোধ করছেন। দ্রুত শূন্য হয়ে আসা থালার দিকে তিনি ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন। ভাত আর নেই। থালার ভাত শেষ হয়ে গেলে আর দেয়া যাবে না। ছেলেটা কি ক্ষিধে-পেটে উঠবে? আজি ভাত কম পড়ল কেন? তিনি নিজে মেপে-মেপে সাড়ে চার পট চাল দিয়েছেন।সঞ্জু মার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খেয়েছ মা? তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।এটা বলতেও তার লজ্জার সীমা রইল না। ফরিদা ক্ষিদে সহ্য করতে পারেন না। একেবারেই না। রান্না হওয়া মাত্র গরম গরম ভাত খেয়ে নেন। তখনো হয়ত তরকারি হয় নি, ডালটা শুধু নেমেছে।সঞ্জুর ভাতের থালা প্রায় শূন্য। এক্ষুণি হয়ত সে বলবে—আর চারটা ভাত দাওতো মা। ফরিদা মনে মনে বললেন, আল্লাহু আজ যেন সে ভাত না চায়। খাওয়া শেষ করে যেন উঠে পড়ে।সঞ্জু ভাত শেষ করে ফেলেছে। পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে। ফরিদা চাপা স্বরে বললেন, খাওয়া হয়ে গেল?

হুঁ।আর চারটা ভাত নিবি না? না। পান থাকলে একটা পান দাওতো মা।ফরিদা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোরতো দেখি পান খাওয়া অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। তুই ছাত্র মানুষ। তোর কি দাঁত লাল করে পান খাওয়া ঠিক? ঠিক না হলে দাও না।সঞ্জু হাত ধুতে উঠে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছে। মুখ ভৰ্তি করে পানি নিয়ে কুলি করে কলঘরের কাছে রাখা টবে ফেলার চেষ্টা করছে। ছেলেবেলার অভ্যাস। সব ভাই-বোন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কুলি করে টবে পানি ফেলার চেষ্টা করবে। কুলির পানিতে উঠান মাখামাখি। কত বকা দিয়েছেন লাভ হয় নি। দশ বছর আগের টব এখনো আছে। গাছ বদল হয়েছে। শুরুতে ছিল গোলাপ গাছ, তার পর কয়েক বছর মরিচের গাছ, একবার ছিল টমেটোর গাছ-খুব টমেটো হয়েছিল সেবার। এখন আবার একটা গোলাপ গাছ। গাছ ভৰ্তি করে কলি এসেছে। এখনো ফুল ফোটেনি।

সঞ্জু পান নে।সঞ্জু পান হাতে নিতে নিতে বলল, ভাত যদি চাইতাম তা হলে মা তুমি বিপদে পড়তে। ভাততো আর ছিল না।ফরিদা বিব্রত গলায় বললেন, কে বলল ছিল না? আমি বুঝতে পারি।ইস কি আমার বুঝনেওয়ালা—আয় রান্নাঘরে নিজের চোখে দেখে যা।সঞ্জু হাসতে হাসতে বলল, এম্নি বললাম।ফরিদা মুগ্ধ চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সঞ্জু হাসলেই তার গালে টোল পড়ে। দেখতে এমন মজা লাগে। ইচ্ছা করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে। গালে টোল-পড়া মেয়েরা দুৰ্ভাগ্যবতী হয়, ছেলেদের বেলায় কি এসব কিছু আছে? দশটা টাকা দিতে পারবে মা?

সকালে না পাঁচ টাকা নিলি। ঐটা বাস ভাড়াতেই শেষ। এখন যাব আদাবর, ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা।এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবি? উপায় কি মা। ফাইন্যাল প্ল্যানিং করতে হবে। সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে যাবার ব্লু প্রিন্ট আজ রাতে তৈরী হবে। আমাদের এই প্রজেক্টের নাম কি জান? প্রজেক্টের নাম হচ্ছে—প্ৰজেক্ট দারুচিনি দ্বীপ।দারুচিনি দ্বীপ কেন? রোমান্টিক ধরনের একটা নাম দেয়া হল—এই আর কি? দুইটা নাম সিলেকটেড হয়েছিল—প্রজেক্ট দারুচিনি দ্বীপ এবং প্রজেক্ট কালাপানি। লটারীতে দারুচিনি দ্বীপ উঠে এল। এটা আমার দেয়া নাম।ফরিদা হালকা গলায় বললেন, কি যে তোদের কাণ্ডকারখানা। বেড়াতে যাবি তাও আবার একটা না একটা—প্রজেক্ট হেন, প্রজেক্ট তেন…

এইসব তোমরা বুঝবে না মা। আর শুধু বেড়াতে যাচ্ছি। তাতো না আরো ব্যাপার আছে।আর কি ব্যাপার? তোমাকে বলা যাবে না। সঞ্জু মার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, টাকা দিতে হবে মনে আছে তো মা? মনে আছে।এক হাজার টাকা। সবাই মিনিমাম এক হাজার নিচ্ছে। দিতে পারবে তো? পারব। লাষ্ট মোমেন্টে যদি বল—টাকার জোগাড় হয় নি। তাহলে সর্বনাশ।কজন যাচ্ছিস? এখনো ঠিক হয় নি। আজ ফাইন্যাল হবে। ইয়ে মা শোন—আমাদের সঙ্গে কয়েকটা মেয়েও হয়ত যাবে।কি বললি?

ওরা যেতে চাচ্ছে। আমরা নিব কি-না এখনো ঠিক করিনি। নাও নিতে পারি। ওদের নেয়া মানেই যন্ত্রণা।ফরিদা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।সঞ্জু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, তুমি এমন করে তাকিয়ে আছ কেন? মেয়েরা সঙ্গে গেলে কি অসুবিধা। ওরা আমাদের বন্ধুর মতো। এক সঙ্গে পড়ি। ওরাতো এখন স্টাডি ট্যুরে যায়, এস্কারসানে যায়। ছেলেদের সঙ্গেই তো যায়।তখন তোদের স্যাররা সঙ্গে থাকেন। এখন যাচ্ছিস নিজেরা নিজেরা।তাতে কি? মেয়েগুলোর বাপ-মা যেতে দেবে? দিবে না কেন? একটা প্রশ্ন ফরিদার মুখে চলে এসেছিল তিনি চট করে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রশ্নটা করলে সঞ্জু যদি আবার কিছু মনে করে। যদি লজ্জা পায়। প্রশ্নটা হলো মেয়েগুলোর মধ্যে তোর পছন্দের কেউ আছে?

ফরিদার ধারণা আছে। তাঁর এত সুন্দর রাজপুত্রের মতো ছেলে। মেয়েদের অনেকেই নিশ্চয়ই আগ্রহ করে তার কাছে আসে ভাব করার জন্যে। এদের কাউকে কি সঞ্জু অন্যদের চেয়ে আলাদা চোখে দেখে না? দেখাটাই তো স্বাভাবিক।একবার তিনি সঞ্জুর বইখাতা গুছাচ্ছেন, হঠাৎ সেখান থেকে নীল রঙের একটা চিঠি বেরিয়ে পড়ল। তিনি পড়বেন না পড়বেন না ভেবেও শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেললেন। রিংকু নামে একটা মেয়ে লিখেছে। সুন্দর গোটা গোটা হাতের লেখা, তবে খুবই ছোট দুই লাইনের চিঠি।

সঞ্জ,

তুমি আমাকে এমন বোকা বানালে কেন?

আমি ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ রাগ করেছি।

ইতি রাগান্বিতা

রিংকু

ফরিদার খুব ইচ্ছা করছিল রিংকুকে সঞ্জু কি করে বোকা বানিয়েছিল সেটা জানতে। জানা হয় নি। লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারেন নি। তাছাড়া জিজ্ঞেস করলে সঞ্জু যদি বলে—মা, তুমি বুঝি লুকিয়ে আমার চিঠি পড়? রাগান্বিতা রিংকুর দুলাইনের চিঠি পড়ে ফরিদার খুবই ভালো লেগেছিল। চিঠি হবে এ রকম—এক লাইনের দুই লাইনের, চট করে ফুরিয়ে যাবে। তারপরও মনে হবে ফুরাল না। রহস্য থেকে গেল। অবশ্যি রিংকুর চিঠির সম্বোধন তাঁর পছন্দ হয় নি। নাম ধরে লিখবে কেন? কত সুন্দর সুন্দর সম্বোধন আছে–সুপ্রিয়, সুজনেষু, দেবেষু… ।সঞ্জু বলল, টাকাটা দাও মা চলে যাই। ফরিদা টাকা এনে দিলেন এবং মুখ ফসকে বলে ফেললেন, রিংকু কি তোদের সঙ্গে যাচ্ছে? সঞ্জু অবাক হয়ে বলল, রিংকু কে?

ফরিদা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। সঞ্জু আবার বলল, কোন রিংকুর কথা বলছ? তিন জন রিংকু আছে আমাদের সঙ্গে। এক জন অনার্সে, দুই জন সাবসিডিয়ারী ক্লাসে।ফরিদা দারুণ অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ঐ যে মেয়েটা তোকে চিঠি লিখেছিল–দুই লাইনের। তোর বই গুছাতে গিয়ে হঠাৎ দেখলাম।ও আচ্ছা বুঝেছি—সাবসিডিয়ারীর রিংকু। ওর সয়েল সায়েন্সে অনার্স। সাবসিডিয়ারীতে দেখা হয়। ফাজিলের চূড়ান্ত। না ও যাচ্ছে না। ও যাবে কেন? মেয়েটা কেমন? বললাম না, ফাজিল ধরনের। সবার সাথে ফাজলামী করে। স্যারদের সাথেও।চেহারা কেমন?

চেহারা মন্দ না। নাক বোচা, আমরা তাকে ডাকি মিস খ্যাদা। ও মোটেই ক্ষেপে না। উল্টা হাসে। ও কি বলে জান মা? ও বলে আগে না-কি ওর নাক গ্রীকদের মত খাড়া ছিল। কলেজে উঠার পর চাইনীজ খাওয়া ধরেছে। প্রতি সপ্তাহে একদিন করে চাইনীজ খায়। এই জন্যেই তার নাক চাইনীজদের নাকের মতো হয়ে যাচ্ছে। ও বলে, সঞ্জ, খুব চিন্তায় আছি নাক যে ভাবে বসে যাচ্ছে কোনদিন দেখব ফুটো বন্ধ হয়ে গেছে। তখন নিঃশ্বাস ফেলব কি করে? ফরিদা বললেন, তোকে নাম ধরে ডাকে? নাম ধরে ডাকবে না? আমরা এক সঙ্গে পড়ি না?

সঞ্জু মার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, রিংকুর বিয়ের কথা হচ্ছে। মার্চে বিয়ে হয়ে যাবে। সে কি বলেছে জান? বলেছে আমার সঙ্গে যাদের যাদের প্রেম করার ইচ্ছা তাদের জরুরী ভিত্তিতে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে তারা যেন মার্চের আগেই তা করে ফেলে।ফরিদা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।দিনকাল বদলাচ্ছে। তবে বড় বেশি দ্রুত বদলাচ্ছে। এত দ্রুত বদলানো কি ভালো? রিংকু মেয়েটার কাণ্ডকারখানা একই সঙ্গে তাঁর ভালো লাগছে, আবার ভালো লাগছে না।মা যাই। অনেকক্ষণ তোমার সাথে বক বক করলাম। রাতে কিন্তু ফিরতে দেরী হবে।বেশি দেরী করলে তোর বাবা রাগ করবে।বাবাকে খাইয়ে দাইয়ে নটার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দিও।সঞ্জুর বাবা সোবাহান সাহেব এজি অফিসে কাজ করেন।সেকশান অফিসার।

আজি দুপুরে বাসায় চলে এসেছেন। লাঞ্চ খাবার পর হঠাৎ কেন জানি তার মাথা ঘুরতে লাগল। বমি বমি ভাব হতে লাগল। বাসায় এসে খানিকক্ষণ শুয়ে ছিলেন। এখন শরীর ভালো লাগছে। বাসায় ফেরার পথে দুইটা খবরের কাগজ কিনেছিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সারা দুপুর তাই পড়ছেন। খবরের কাগজ পড়া তার নেশার মতো। আগে একটা কাগজ রাখা হত। খরচে পুষাচ্ছে না বলে গত তিন মাস ধরে রাখা হচ্ছে না। তবে প্রায়ই খবরের কাগজ কেনা হচ্ছে। আজ যেমন কেনা হলো। না কিনে করবেনই বা কি? আমেরিকা-ইরাকের যুদ্ধের খবর পাবেন কোথায়? গোড়াতে তিনি ধরে নিয়েছিলেন সাদ্দাম লোকটা মহা গাধা। গাধা না হলে আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করে? এখন দেখা যাচ্ছে লোকটাকে যতটা গাধা মনে হয়েছিল ততটা গাধা না। সাত দিন তো যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে গেল। আমেরিকার সঙ্গে সাত দিন যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যাওয়াতো সোজা ব্যাপার না। মুসলমান হলো মাথা গরমের জাত—এই লোকটার দেখা যায় মাথা ঠাণ্ডা।

ফরিদা শোবার ঘরে ঢোকামাত্র সোবাহান সাহেব বললেন, ফরিদা এক কাপ চা দাও তো।চায়ের সাথে আর কিছু খাবে? মুড়ি আছে। দিব? দাও। আর শোন, মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে কাকে দিলে, সঞ্জুকে? হ্যাঁ।অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছ। টাকা চাইলেই দিবে? দশটা মোটে টাকা।দশ টাকা মোটেই সামান্য না। দশ দিন যদি দশ টাকা করে দাও তা হলে কত হয়? একশ। একশ টাকায় দশ সের চাল পাওয়া যায়। তার উপর যুদ্ধ লেগে গেছে—থার্ড ওয়ান্ড-ওয়ার। সারা পৃথিবীর অবস্থা কাহিল।এইখানে তো আর যুদ্ধ হচ্ছে না।না বুঝে কথা বলবে না। যুদ্ধের এফেক্ট সারা পৃথিবীতে পড়বে। অলরেডি পড়ে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কোথায় হয়েছিল? ইউরোপে। লোক মারা গোল কোথায়? বাংলাদেশে। লাখ লাখ লোক। এক জন দুই জন না। এইবার মারা যাবে কোটিতে।

ফরিদা বললেন, যাই তোমার চা নিয়ে আসি।কথা শেষ করে নেই তারপর যাও। বস।ফরিদা বসলেন। শংকিত মনেই বসলেন। এই মানুষটার বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস আছে। একবার বক্তৃতা শুরু হলে ঘণ্টা খানিক চলবে। প্রতিটি কথা শুনতে হবে খুব মন দিয়ে। কথার মাঝখানে এদিক ওদিক তাকালেই মানুষটা রেগে যায়। অবশ্য বক্তৃতা সে শুধু তাঁর সঙ্গেই দেয় অন্য কারো সঙ্গে একটি কথাও বলে না। সোবাহান সাহেব, খবরের কাগজ নামিয়ে রেখে গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার মেয়েরা কোথায়? মুনার বান্ধবীর জন্মদিন। সে দুই বোনকে নিয়ে ঐখানে গেছে। ওরা গাড়ি দিয়ে নিয়ে গেছে। রাতে সেখানে খাবে তারপর গাড়ি করে দিয়ে যাবে।গাড়ি করে নিয়ে যাক আর হেলিকপ্টারে করেই নিয়ে যাক —যার বান্ধবীর দাওয়াত সে যাবে। গুষ্টিশুদ্ধো যাবে কেন? এইসব আমার পছন্দ না।মাঝে মাঝে একটু-আধটু বেড়াতে গেলে কি অসুবিধা?

অসুবিধা আছে। এতে পাড়া-বেড়ানি অভ্যাস হয়। দিন-রাত খালি ঘুর-ঘুর করতে ইচ্ছা করে। মেয়েদের জন্যে এটা ভালো না। আমাদের অফিসের করিম সাহেবের এক ছোটশালি বি.এ ফাষ্ট ইয়ারে পড়ে। তার এ রকম পাড়া-বেড়ানি স্বভাব। হুট হাট করে এখানে যায়, ওখানে যায়। এক দিন কোন বন্ধুর খোজে দুপুরে ছেলেদের এক হোস্টেলে গিয়ে উপস্থিত… তারপর থাক বাকিটা আর বলতে চাই না…

শুনি না তারপর কি? না থাক। সব কিছু শোনা ভালো না। যাও চা-টা নিয়ে আস।চা এনে ফরিদা দেখলেন, মানুষটা বমি করে সমস্ত ঘর ভাসিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে। চোখ রক্তবর্ণ। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।ফরিদা ভীত গলায় বললেন, কি হয়েছে? সোবাহান সাহেব প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।সে কি? তিনি পেটে হাত দিয়ে আবার বমি করলেন।

 

Read more

দারুচিনি দ্বীপ পর্ব:০৩ হুমায়ুন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *