দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

তা পারবেনবেশ, তাহলে আপনি আমাকে ঠিকানা দিনদেববাড়িতে চলেন, খাওয়াদাওয়া করেনআমি হােটেল থেকে খেয়েদেয়ে এসেছিতা কি হয়, অতিথিমানুষ! আসুন আসুন। 

দ্রলােক বাড়িতে নিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বড়ই গম্ভীর হয়ে রইলেনমাথার ওপর হঠাৎ এসে পড়া উপদ্রবে তাকে যথেষ্ট বিরক্ত মনে হলােভালাে করে কোনাে কথাই বললেন নাঅকারণে বাড়ির এক জন কামলার ওপর প্রচণ্ড হম্বিতম্বি শুরু করলেন। 

কিন্তু অনুফার বাড়িতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ঘটলমেয়েটি আদরযত্নের একটি মেলা বাধিয়ে ফেললমিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটির স্বামী সন্ধ্যাবেলাতেই জাল নিয়ে পুকুরে নেমে গেছেঅনুফা পরিচিত মানুষের মতাে আদুরে গলায় বলল, রাতে ফিরবেন কিকাল সকালে যাবেনলােকজন মিসির আলিকে দেখতে এলএরা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থমেয়েটিও মনে হয় বেশ ক্ষমতা নিয়ে আছেসবাই তার কথা শুনছে। 

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁকে গােসলের জন্যে গরম পানি করে দেয়া হলােএকটা বাটিতে নতুন একটা গায়ে মাখার সাবান। মােড়কটি পর্যন্ত হেঁড়া হয় নিবাংলাঘরে নতুন চাদর বিছিয়ে বিছানা করা হলােমেয়েটির বৃদ্ধ শ্বশুর একটি ফর্সী হুক্কাও এনে দিলেন এবং বারবার বলতে লাগলেন, খবর নাদিয়ে আসার জন্যে ঠিকমতাে খাতিরযত্ন করতে না পেরে তিনি বড়ই শরমিন্দা। তবে যদি কালকের দিনটা থাকেন, তবে তিনি হরিণঘাটার বিখ্যাত মাগুর মাছ খাওয়াবেনখাওয়াতে নাপারলে তিনি বাপের ব্যাটা না ইত্যাদি ইত্যাদি। 

মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল নাতিনি সত্যিসত্যি এক দিন থেকে গেলেনমিসির আলি সাহেব রকম কখনাে করেন না

রানু মৃদু স্বরে বলল, ভেতরে আসব?” 

এস রানু, এসগল্প করতে এলামখুব ভালাে করেছ‘ 

নীলু উঠে গিয়ে রানুর হাত ধরলরানু বলল, তুমি কাঁদছিলে নাকি, চোখ ভেজা! নীলু কিছু বলল নারানু বলল, এত কিসের দুঃখ তােমার যে দুপুরবেলায় কাঁদতে হয়

তােমার বুঝি কোনাে দুঃখটুঃখ নেই? উহুআমি খুব সুখী। 

রানু হাসতে লাগলনীলু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি বলেছিলে, একটা খুব অদ্ভুত কথা আমাকে বলবে‘ 

বলেছিলাম নাকি?‘ 

হাআজ সেটা বলতে হবেতারপর আমি আমার একটা অদ্ভুত কথা বলব‘ 

রানু হাসতে লাগলহাসছ কেন রানু? তােমার অদ্ভুত কথাটা আমি জানি, এই জন্যে হাসছি” 

কী আবােলতাবােল বলচ! তুমি জানবে কী? জানি কিন্তুনীলু গম্ভীর হয়ে বলল, জানলে বল তােতােমার এক জন প্রিয় মানুষ তােমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেঠিক ?‘ 

নীলু দীর্ঘ সময় কোন কথাবার্তা বলল নারানু বলল, কি ভাই, বলতে পারলাম তাে?” 

হ্যা, পেরেছকি বাসায় আসবে

বলব তােমাকেতার আগে তুমি বল, তুমি কী করে জানলে? বিলু তােমাকে বলেছে? কিন্তু বিলু তাে কিছু জানে না!‘ 

‘আমাকে কেউ কিছু বলে নিতাহলে তুমি জানলে কী করে? আমি স্বপ্ন দেখেছি?‘ 

স্বপ্ন দেখেছি মানে

নীলু, মাঝেমাঝে আমি স্বপ্ন দেখিসেগুলাে ঠিক স্বপ্নও নয়তবে অনেকটা স্বপ্নের মতােসেগুলাে সব সত্যিগত রাতে স্বপ্নে দেখলাম, তুমি একটি চিঠি পেয়ে খুব খুশিসেই চিঠিতে একটি লাইন লেখা আছে, যার মানে হচ্ছে তােমার সঙ্গে আমার দেখা হবে বা এই রকম কিছু। 

এসব কি তুমি সত্যিসত্যি বলছ রানু

কবে তার সঙ্গে তােমার দেখা হবে? আজ বিকেলেআমি নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে একটা সবুজ রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকবতিনি আমাকে খুঁজে বের করবেন। 

বাহ, খুব মজার ব্যাপার তাে

রানু হাসতে লাগলএক সময় হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, শুধু গল্প উপন্যাসেই এসব হয়বাস্তবে এই প্রথম দেখছিতােমার ভয় করছে না?‘ 

ভয় করবে কেন? তােমার কিন্তু নীলু ভয় করছেআমি বুঝতে পারছিবেশ ভয় করছেকরছে না

নাহ্। 

রানু ইতস্তত করে বলল, ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পার আমি দূরে থাকব‘ 

থাক, দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। 

মনে হলাে নীলু রানুর কথাবার্তা সহজভাবে নিতে পারছে নাতার চোখমুখ গম্ভীররানু বলল, কি, নেবে

আমার একা যাবার কথা, একাই যাবআর যদি গিয়ে দেখ, খুব বাজে ধরনের একটা লােকতখন কী করবে? বাজে ধরনের লােক মানে? অর্থাৎ যদি গিয়ে দেখ দাঁত পড়া, চুল পাকা এক বুড়াে? তােমার কি সে রকম মনে হচ্ছে

রানু মাথা দুলিয়ে হাসল, কিছু বলল নানীলুকে দেখে মনে হলাে রানুর ব্যবহারে সে বেশ বিরক্ত হচ্ছেদুটো বাজতেই সে বলল, এবার তুমি যাও, আমি সাজগােজ করব। 

এখনই? চারটা বাজতে তাে দেরি আছেতােমার মতাে সুন্দরী তাে আমি নাআমাকে সময় নিয়ে সাজতে হবেরানু উঠে পড়লনীলু সত্যি সাজতে বসলকিন্তু কী যে হয়েছে তার, চোখে 

পানি এসে কাজল ধুয়ে যাচ্ছেআইল্যাশ পরার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু একাএকা পরা সম্ভব নয়অনেক বেছেটেছে একটা শাড়ি পছন্দ করলসাদার ওপর নীলের একটা প্রিন্ট আগে সে কখনাে পরে নি। 

নীলু মা, কোথাও যাচ্ছ নাকি? নীলু তাকিয়ে দেখলবাবাকোথায় যাচ্ছ গাে মা? এক জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেতােমার কি চা লাগবে

হলে ভালাে হতথাক, তুই ব্যস্তচা বানাতে আর কয় মিনিট লাগবে! তুমি বস, আমি বানিয়ে আনছিনীলুর বাবা চেয়ার টেনে নীলুর ঘরেই বসলেন। 

চা কি চিনি ছাড়া আনব বাবা?না, এক চামচ চিনি দিসএকটুআধটু চিনি খেলে কিছু হবে না। 

নীলু চা নিয়ে এসে দেখে বাবা ঝিমুচ্ছেনঝিমুনিরও বেশি, প্রায় ঘুমাচ্ছেন বলা চলেবাবা যেন বড় বেশি দ্রুত বুড়াে হয়ে যাচ্ছেনবড় মায়া লাগল নীলুর । 

বাবা, তােমার চাকোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস মা?নীলু খানিক ইতস্তত করে বলল, তােমাকে আমি পরে বলব বাবা। 

সন্ধ্যার আগেই আসবি তাে?হ্যা, বাবাগাড়ি নিয়ে যাবি?” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *