দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

এই বাসাটাও ভালাে। 

রানু খুব খুশি মনে নতুন বাসা সাজালনিজেই পরদা কিনে আনল, সারা রাত জেগে সেলাই করল। তার উৎসাহের সীমা নেই। 

বুঝলে রানু, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবেঅন্যদের বাসায় যাবেটাবেএকাএকা থাকার অভ্যেসটা ভালাে নাযাবে তাে?” 

যাব‘ 

‘একা থাকলেই মানুষের মধ্যে নানান রকম প্রবলেম দেখা যায়, বুঝলে? সব ভাড়াটেদের সঙ্গে খাতির রাখবে। 

ভাড়াটে তাে মাত্র এক জনওনার বাসাতেই যাবেবাড়িঅলার বাসায়ও যাবেআচ্ছা, যাব।’ 

রানু অবশ্যি যায় নি কোথাওতার ভালাে লাগে নাঅন্যদের মতাে সে কারাে সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে নাঅন্যদের সামনে কেমন যেন আড়ষ্ট লাগেবারান্দার বেতের চেয়ারটাতে বসে থাকতেই বেশি ভালাে লাগেদুপুরটাই যা কষ্টেরদুপুরটা কেটে গেলেই অন্যরকম একটা শান্তি লাগে । 

কিন্তু আজকের দুপুরটা দীর্ঘকিছুতেই আর কাটছে নাবারান্দায় বসে থাকতেও ভালাে লাগছে নামেয়েদের স্কুলটাও কী কারণে যেন বন্ধ চারদিকে চুপচাপবডড ফঁাকাকিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কেমন হয়

ঘরের ভেতরটা কেমন যেন অন্যরকমরানু ভেতরে ঢুকে জানালার পর্দা ফেলে দিলঅনেকখানি অন্ধকার হয়ে গেলঅন্ধকার চুপচাপআর তখন স্পষ্ট গলায় কেউ ডাকল, রানু, রানুকয়েক মুহুর্ত রানু নড়ল নাঅপেক্ষা করতে লাগলকিন্তু যে ডেকে উঠেছে, সে দ্বিতীয় বার আর ডাকল না। 

রাণুর রকম চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক জন অশরীরী কেউ ডেকে ওঠেঅসংখ্যবার শুনেছে এই ডাককে সে! কোথেকে আসে সে! রানু ফিসফিস করে বলল, কে?কোনাে জবাব পাওয়া গেল না। 

কে তুমি

জানালার পরদাটা শুধু কাঁপছেবিকেল হয়ে আসছেরানু ছােট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালনিচের বাগানে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি হাঁটছেনীলু বােধহয় ওর নামএই মেয়েটি তার বােনের মতাে নয়গম্ভীরকথাবার্তা প্রায় বলেই নাতবুও ওকে দেখলেই রানুর মনে হয়মেয়েটি বড় ভালােমায়াবতী মেয়ে। 

রানু দেখল বিষন্ন ভঙ্গিতে মেয়েটি একাএকা বসে আছেতার ইচ্ছা হল নিচে নেমে ওর সঙ্গে কথা বলেকিন্তু সে গেল না। 

নীলু দুই বার বিজ্ঞাপনটা পড়লবেশ একটা মজার বিজ্ঞাপন। 

কেউ কি আসবেন? আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষস্ত্রীর মৃত্যুর পর একা জীবন যাপন করছিসময় আর কাটে নাআমার দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ 

রজনীর নিঃসঙ্গতা কাটাতে কেউ আমাকে দুই লাইন লিখবেন

জিপিও বক্স নাম্বার ৭৩ দৈনিক পত্রিকায় রকম বিজ্ঞাপন দেবার মানে কী? সাপ্তাহিক কাগজগুলিতে এই সব থাকে; ছেলেছােকরাদের কাণ্ডএই লােকটি নিশ্চয় ছেলেছােকরা নয়বুড়ােহাবড়াদের একজন। 

বাবা, এটা পড়েছ?নীলু জাহিদ সাহেবের হাতে কাগজটা খুঁজে দিলবাবা, এই বিজ্ঞাপনটি পড় তাে!’ 

জাহিদ সাহেব নিজেও কুঞ্চিত করে দুই বার পড়লেনতাঁর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল বেশ বিরক্ত হয়েছেন। 

পড়েছ?, পড়লামকী মনে হয় বাবা

কী আবার মনে হবে? কিছুই মনে হয় নাদেশটা রসাতলে যাচ্ছেখবরের কাগজঅলারা এইসব ছাপে কীভাবে

নীলু হাসিমুখে বলল, ছাপাবে না কেন?” 

দেশটা বিলাতআমেরিকা নয়, বুঝলি? আর ভালাে করে পড়লেই বােঝা যায়, লােকটার একটা বদ মতলব আছে। 

কই, আমি তাে বদ মতলব কিছু বুঝছি না।’ জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখিস, তুই আবার চিঠি লিখে বসবি ‘ 

নীলু মুখ নিচু করে হাসল ।। হাসছিস কেন?এমনি হাঁসছিচিঠি লিখবার কথা ভাবছিস না তাে মনেমনে?” 

নীলু মুখে উঁহু বললেও মনেমনে ঠিক করে ফেলল, গুছিয়ে একটা চিঠি লিখবেদেখা যাক না কী হয়কী লেখে লােকটি। 

রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সে সত্যি একটা চিঠি লিখে ফেলল মােটামুটি বেশ দীর্ঘ চিঠি। 

জনাব, পনার বিজ্ঞাপনটি পড়লামলিখলাম কয়েক লাইনএতে 

কি আপনার নিঃসঙ্গতা কাটবে? আমার বয়স আঠারআমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীআমরা দুবােনআমার ছােট বােনটির নাম বিলুসে হলিক্রস কলেজে ড়েআমরা দুবােনই খুব সুন্দরীএই যা, এটা পনাকে লেখা ঠিহল 

তাই না ? নাকি সুন্দরী মেয়েদের চিঠি পেলে আপনার নিঃসঙ্গতা আরাে দ্রুত কাটবে

নীলুচিঠিটি লিখেই তার মনে হলাে যে, এ রকম লেখাটা ঠিক হচ্ছে নাচিঠির মধ্যে একটা বড় মিথ্যা আছেসে সুন্দরী নয়বিলুর জন্যে কথাটা ঠিক, তার জন্যে নয়নীলু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখল। 

আমার নাম নীলুআমার বয়স কুড়িআপনার নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে পনাকে লিখছিকিন্তু চিঠিতে কি কারাে নিঃসঙ্গতা কাটে? আপনার বয়স , এটা দয়া করে জানাবেন। 

নীলু দ্বিতীয় চিঠিটিও তার পছন্দ হলাে নাতার মনে হলাে, সে যেন কিছুতেই গুছিয়ে আসল জিনিসটি লিখতে পারছে নারাতে শুয়েশুয়ে তার মনে হলাে, হঠাৎ করে সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন? চিঠি লেখারইবা কী দরকার? সেনিজেও কি খুব নিঃসঙ্গ? হয়তােবাবাড়িতে আর দুটি মাত্র প্রাণীবিলু আর বাবাবাবা দিনরাত নিজের ঘরেই থাকেনমাসের প্রথম দিকের কয়েকটা দিন বাড়িভাড়ার টাকা আদায়ের জন্যে অল্প যা নড়াচড়া করেনতারপর আবার নিজের ঘরেই বন্দিআর বিলু তাে আছে তার অসংখ্য বন্ধুবান্ধব নিয়েশুধু মেয়েবন্ধু নয়, তার আবার অনেক ছেলেবন্ধুও আছে। 

মহানন্দে আছে বিলুতবে সে একটু বাড়াবাড়ি করছেকাল তার কাছে একটি ছেলে এসেছিল, সে রাত আটটা পর্যন্ত ছিলসব ভালাে নয়নীলু উঁকি দিয়ে দেখেছে, ছেলেটি ফরফর করে সিগারেট টানছেহাত নেড়েনেড়ে কথা বলছেআর বীলু হাসতেহাসতে ভেঙে পড়ছেভাত খাওয়ার সময় নীলু কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল, ছেলেটা কে রে?” 

কোন ছেলে?ঐ যে রাত আটটা পর্যন্ত গল্প করলি

, সে তাে রুবির ভাই! মহা চালবাজনিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবে, আসলে মহা গাধা। 

বলতেবলতে খিলখিল করে হাসে বিলু। 

মহা গাধা হলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলি কেন? ‘যেতে চাচ্ছিল না তাে কী করব

বলতে বলতে বিলু আবার হাসল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *