দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

কেউ অবশ্যি এল নাদেখতেদেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেলচিঠিরও কোনাে উত্তর নেইলােকটি হয়তাে চিঠি পায় নিডাকবিভাগের কল্যাণে আজকাল তো বেশির ভাগ চিঠিই প্রাপকের হাতে পৌঁছায় নাএতে ক্ষতি যেমন হয়, লাভও তেমনি হয়কিংবা হয়তাে এমন হয়েছে, লােক অসংখ্য চিঠি পেয়েপছন্দমতাে চিঠিগুলাের উত্তর দিয়েছেনীলুর তিন লাইনের চিঠি তার পছন্দ হয় নিসে হয়তাে লম্বালম্বা চমৎকার সব চিঠি পেয়েছেইনিয়েবিনিয়ে অনেক কিছু লেখা সব চিঠিতে। 

দশ দিনের মাথায় নীলুর কাছে চিঠি এসে পড়ল খুবই দামী একটা খামে চমৎকার প্যাডের কাগজে চিঠিগােটাগােটা হাতের লেখা কালির রঙ ঘন কালােমাখনরাঙা সে কাগজে লেখাগুলাে মুক্তার মতাে ফুটে আছেএত সুন্দর হাতের লেখাও মানুষের হয়! চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত । 

কল্যাণীয়াসু তােমার চমৎকার চিঠি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছিএকজন ব্যথিত মানুষের আবেদনে তুমি সাড়া দিয়েছতােমাকে ধন্যবাদ খুব সামান্য একটি উপহার পাঠালামপ্লীজ, নাও। 

আহমেদ সাবেত উপহারটি সামান্য নয়অত্যন্ত দামী একটি পিওর পারফিউমের শিশি । 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

নীলু ভেবে পেল না, এই লােকটি কি সবাইকে রকম একটি উপহার পাঠিয়েছে? যারাই চিঠির জবাব দিয়েছে তারাই পেয়েছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব? নাকি নীলু একাই চিঠির জবাব দিয়েছে? নীলুর বড় লজ্জা করতে লাগলসে পারফিউমের শিশিটি লুকিয়ে রাখল এবং খুব চেষ্টা করতে লাগল সমস্ত ব্যাপার ভুলে যেতেসে চিঠিটি কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলে দিল জানালা দিয়েকেন এমন একটা বাজে ঝামেলায় জড়াল

কিন্তু দিন সাতেক পর নীলু আবার একটি চিঠি লিখলএকটি বেশ দীর্ঘ চিঠি সেখানে শেষের দিকে লেখাআপনি কে, কী করেনকিছুই তাে জানান নিআপনার বিজ্ঞাপনটিও দেখছি নাতার মানে কি এই যে আপনার নিঃসঙ্গতা এখন দূর হয়েছেনীলু বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করল চিঠির জবাবের জন্যে, কিন্তু কোনাে জবাব এল নাকেন জানি নীলুর বেশ মনখারাপ হলআরেকটি চিঠি লেখার ইচ্ছা হতে লাগল, কিন্তু তাও কি হয়? একাএকা সে শুধু চিঠি লিখবে? তার এত কী গরজ পড়েছে

দুপুররাতে আনিসের ঘুম ভেঙে গেলহাত বাড়াল অভ্যেসমতােপাশে কেউ নেইআনিস ডাকল, রানু, রানুকোনাে সাড়া নেইবাথরুম থেকে একটানা পানি পড়ার শব্দ হচ্ছেবাথরুমে নাকি? আনিস উকি দিল বাথরুমে কেউ নেইকোথায় গেল! আনিস গলা উঁচিয়ে ডাকল, রানুবসার ঘর থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ এল বসার ঘর অন্ধকাররানু কি সেখানে একাএকা বসে আছে নাকি

আনিস বসার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলেই সঙ্গেসঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেললরানু বসার ঘরে ছােট টেবিলে চুপচাপ বসে আছেতার গায়ে কোনাে কাপড় নেই। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

এই রানু। 

কী হয়েছে? তােমার কাপড় কোথায়? খুলে ফেলেছিবড় গরম লাগছেআনিস এসে রানুর হাত ধরলহিমশীতল হাতএকটুএকটু যেন কাঁপছেএস রানু, ঘুমুতে যাইআমার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে নাতুমি যাও। 

কাল আমরা একজন ডাক্তারের কাছে যাব, কেমন? কেন?তােমার শরীর ভালাে না রানুআমার শরীর ভালােই আছে। 

না, তুমি খুব অসুস্থএস আমার সঙ্গেকাপড় পরে ঘুমুতে এস‘ 

রানু কোনাে আপত্তি করল না। সঙ্গেসঙ্গেই উঠে এল কাপড় পরল এবং বাধ্য মেয়ের মতাে বিছানায় শুয়ে প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লজেগে রইল আনিসরানুর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছেআগে তাে রকম কখনাে হয় নিমিসির আলিটালি নয়, বড় কোনাে ডাক্তারকে দেখানাে দরকার। 

খুটখুট করে শব্দ হচ্ছে রান্নাঘরেইদুরের উপদ্রবতবু কেন জানি শব্দটা অন্য রকম মনে হচ্ছেযেন কেউ হাঁটছে রান্নাঘরেথপথপ শব্দও হলাে কয়েক বারআনিস বলল, কে?রান্নাঘরের শব্দটা হঠাৎ থেমে গেলআনিস বলল, কে? কে? মনের ভুল নাকি? আনিস যেন স্পষ্ট শুনল, রান্নাঘর থেকে কেউএক জন বলল, আমিস্পষ্ট এবং তীক্ষ্ণ আওয়াজমেয়েলি স্বরনাকি রানুই বলছে ঘুমের ঘােরে? এটাই হয়েছে। রানুরই গলা। 

আনিস হাত বাড়িয়ে রানুকে কাছে টানলরানু বলল, হাতটা সরিয়ে নাও

গরম লাগছেতার মানে কি রানু জেগেছিল এতক্ষণ

‘তুমি জেগেছিলে?‘াআমি যখন বললাম কে কে, তখন কি তুমি বলেছ, আমি? রানু চুপ করে রইলআনিস বলল, বল, বলেছ রকম কিছু? হা, বলেছি‘ 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

কিন্তু তুমি জবাব দিলে কেন? তােমাকে তাে কিছু জিজ্ঞেস করি নিআমি জানতে চাচ্ছিলাম রান্নাঘরে কেউ আছে কি না‘ 

রানু ফিসফিস করে বলল, আমি তাে রান্নাঘরেই ছিলামআমি রান্নাঘর থেকেই জবাব দিয়েছি‘ আনিস চুপ করে গেলবিছানায় উঠে বসে পরপর দুটি সিগারেট শেষ করলবাথরুমে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে রেখে এলরান্নাঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এলথাকুক, সারা রাত বাতি জ্বালানাে থাকুক। রানু। 

কাল তুমি আমার সঙ্গে একজন ডাক্তারের কাছে যাবে, কেমন? ঠিক আছে, যাব‘ ডাক্তার সাহেব যাযা জানতে চান, সব বলবে। রানু জবাব দিল নামনে হলাে সে ঘুমিয়ে পড়েছেশান্ত নির্বিঘ্ন ঘুম কিন্তু রান্নাঘরে আবার শব্দ হচ্ছেআনিসের মনে হলাে সে স্পষ্ট চুড়ির টুনটুন শব্দ শুনছেকাঁচের চুড়ির আওয়াজআনিস কয়েক বার ডাকল, কে, কে ওখানে? কেউ কোনাে জবাব দিল নাবাথরুম থেকে একটানা জল পড়ার শব্দ আসছে

বাড়িঅলাকে বলতে হবে কল ঠিক করে দিতেএক জন কাজের মানুষ রাখতে হবেপুরুষমানুষ নয়, মেয়েমানুষযে রাতদিন থাকবেআত্মীয়স্বজন কাউকে এনে রাখলে ভালাে হতকিন্তু আনিসের তেমন কোনাে আত্মীয়স্বজন নেই, যারা এখানে এসে থাকবেআনিসের ঘুম এল শেষরাতের দিকে। 

মিসির সাহেবের সঙ্গে তারা প্রায় দুই ঘণ্টা সময় কাটাল। রানু খুব সহজস্বাভাবিক আচরণ করলএর প্রধান কৃতিত্ব সম্ভবত মিসির সাহেবেরতিনি খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বললেনএক পর্যায়ে রানু বলল, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন, আমি আপনার মেয়ের বয়সী। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

মেয়ের বয়সী হলে কী, আমার তাে মেয়ে নেইবিয়েই করি নিরানু কিছুএকটা বলতে গিয়েও বলল নাভদ্রলােক সেটি লক্ষ্য করলেন তুমি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?” 

কিছু বলতে চাইলে বলতে পারনা, আমি কিছু বলব না‘ 

মিসির সাহেব চায়ের ব্যবস্থা করলেনচা খেতেখেতে নিতান্তই সহজ ভঙ্গিতে বললেন, আনিস সাহেব বলেছিলেন, তুমি যা স্বপ্নে দেখ তাসত্যি যা স্বপ্নে দেখ তাহয়?শুধু স্বপ্ন না, যা আমার মনে আসে তাহয়বল কী!‘ 

আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, না? বিশ্বাস হবে না কেন? পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার আছেপৃথিবীটা বড় অদ্ভুত‘ 

বলতেবলতে মিসির আলি ড্রয়ার খুলে চৌকা ধরনের চারটি কার্ড বের করলেনহাসিমুখে বললেন, রানু, এই কার্ডগুলিতে ডিজাইন আঁকা আছেআমি একেকটি টেবিলের ওপর রাখব, ডিজাইনগুলি থাকবে নিচে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *