জিতু ফিরে এসে জানাল, এখনও আসে নি। রানু একটি নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখল, আটটা বাজতে চার মিনিট বাকি। কখন আসবে আনিস?
সারাটা পথ নীলু চুপ করে রইল। এক বার সে বলল, কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে?‘ নীলু তারও জবাব দিল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে আছে একটা ঘােরের মধ্যে ।
গান শুনবে? গান দেব?” নীলু মাথা নাড়ল। সেটা হাঁ কি না, তাও স্পষ্ট হলাে না।
কী গান শুনবে? কান্ট্রি মিউজিক? কান্ট্রি মিউজিকে কার গান তােমার পছন্দ? নীলু জবাব দিল না ।
আমার ফেবারিট হচ্ছে জন ডেনভার । জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই গানটা শুনেছ?”
“খুব সুন্দর! অপূর্ব মেলােডি!
সে ক্যাসেট টিপে দিতেই জন ডেনবারের অপূর্ব কণ্ঠ শােনা গেল, ক্যালিফোর্নিয়া রকি মাউন্টেন হাই।
‘কেমন লাগছে নীলু?”
ভালাে। ‘শুধু ভালাে না। বেশ ভালাে।
সেও জন ডেনভারের সঙ্গে গুনগুন করতে লাগল । নীলুর মনে হলাে ওর গানের গলাও তাে চমৎকার! একবার ইচ্ছে হলাে জিজ্ঞেস করে গান জানেন কি
, কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গাড়ি কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে তাও সে লক্ষ্য করছে না। এক বার শুধু ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল । এক জন ভিখিরি এসে ভিক্ষা চাইল। সে ধমকে উঠল কড়া গলায়। তারপর আবার গাড়ি চলল। নীলু ফিসফিস করে বলল, কটা বাজে?”
সাতটা পঁয়ত্রিশ। তােমাকে আটটার আগেই পৌছে দেব।‘ আপনার বাড়ি মনে হয় অনেক দূর?”
‘শহর থেকে একটু দূরে বাড়ি করেছি। কোলাহল ভালাে লাগে না । ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড কার লেখা জান?”
‘নাহ।
‘টমাস হার্ডির। পড়ে দেখবে, চমক্কার! অথচ ট্রাজেডি হচ্ছে, টমাস হার্ডিকেই নােবেল পুরস্কার দেয়া হয় নি। তুমি তার কোনাে বই পড়েছ?”
‘পড়ে দেখবে। খুব রােমান্টিক ধরনের রাইটিং।‘
গাড়ি ছুটে চলেছে মীরপুর রােড ধরে। হঠাৎ নীলু বলল, আমার ভালাে লাগছে না।‘
কী বললে?” ‘আমার ভালাে লাগছে না, আমি বাসায় যাব।‘
সে তাকাল নীলুর দিকে। একটি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটের ভলুম বাড়িয়ে দিল । গাড়ির গতি কমল না ।
‘আমি বাসায় যাব।‘ ‘আটটার সময় আমি তােমাকে বাসায় পৌছে দেব।‘
না, আজ আমি কোথাও যাব না। প্লীজ গাড়িটা থামান, আমি নেমে পড়ব। ‘কেন?” ‘আমার ভালাে লাগছে না। প্লীজ।
সে তাকাল নীলুর দিকে। নীলু শিউরে উঠল। এ কেমন চাউনি! যেন মানুষ নয়, অন্য কিছু।
‘প্লীজ, গাড়িটা একটু থামান।
‘কোনাে রকম ঝামেলা না–করে চুপচাপ বসে থাক। কোনাে রকম শব্দ করবে না।‘
‘আপনি এ রকম করে কথা বলছেন কেন?‘
গাড়ির গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে পাশ দিয়ে দুটো ট্রাক গেল। লােকটি তার একটি হাত রাখল নীলুর উরুতে। নীলু শিউরে উঠে দরজার দিকে সরে গেল। লােকটি হাসল। এ কেমন হাসি!
‘গাড়ি থামান। আমি চিৎকার করব। ‘কেউ এখন তােমার চিঙ্কার শুনবে না।‘
আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? ‘আমি ভয় দেখাচ্ছি না।‘ ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে গাড়িতে উঠেছি। ‘আরাে কিছুক্ষণ থাক। বেশিক্ষণ নয়, এসে পড়েছি বলে।
কী করবেন আপনি? ‘তেমন কিছু না।
নীলু এক হাতে দরজা খুলতে চেষ্টা করল। লােকটি তাকিয়ে দেখল, কিন্তু বাধা দিল না। দরজা খােলা গেল না। নীলু প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করল, আমাকে বাঁচাও, কিন্তু বলতে পারল না। প্রচুর ঘামতে লাগল । প্রচণ্ড তৃষ্ণা বােধ হলাে।
আনিস এল রাত সাড়ে আটটায়। ঘর অন্ধকার। কারাে কোনাে সাড়াশব্দ নেই। রানু বাতিটাতি নিভিয়ে অন্ধকারে বসে আছে। জিতু মিয়া মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়েছে।
‘রানু, কী হয়েছে?” রানু ফোঁপাতে–ফোঁপাতে বলল, তুমি এত দেরি করলে। “কেন, কী হয়েছে? নীলুর বড় বিপদ।
আনিস কিছু বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকাল । রানু থেমে–থেমে বলল, নীলুর খুব বিপদ।
‘কিসের বিপদ? কী বলছ তুমি?‘ রানুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না। রানু, তুমি শান্ত হয়ে বস। তারপর ধীরেসুস্থে বল—কী হয়েছে নীলুর?” ‘ও একজন খারাপ লােকের পাল্লায় পড়েছে। লােকটা ওকে মেরে ফেলবে।
রানু ফেঁাপাতে লাগল। আনিস কিছুই বুঝতে পারল না।