দেয়াল(পর্ব-১২)- হুমায়ূন আহমেদ

বলেন কী স্যার! 

আমি তােমাকে সত্যি কথা বলছি। ভালাে কথা, আমিও যে পীরবংশের সন্তান তা কি জানাে ? 

জি-না স্যার। 

দেয়ালআমি পীরবংশের। বংশের ধারা অনুযায়ী আমি এখন গদিনশীন পীর। অথচ আমার কোনােই ক্ষমতা নেই। এটা একটা আফসােস। তবে আফসােস থাকা ভালাে। মানুষ একমাত্র প্রাণী যে পুরােপুরি সফল জীবন পার করার পরেও আফসােস নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। 

ইশতিয়াক বলল, স্যার, আপনি মাঝে মাঝে ফিলােসফারদের মতাে কথা বলেন। 

মেজর ফারুক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সরি ফর দ্যাট! একজন সৈনিক সবসময় সৈনিকের মতাে কথা বলবে। ফিলােসফারদের মতাে বা। রাজনীতিবিদদের মতাে কথা বলবে না।Thate both the classes. 

ইশতিয়াক বলল, স্যার, একটা কথা বলি ? ফারুক বললেন, বলাে। 

আপনি প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার সব গল্প করেন, কিন্তু আপনি মুক্তিযুদ্ধে খুব অল্প সময় ছিলেন। আপনি যুদ্ধে গেলেন নভেম্বরের শেষ দিকে। দেশ স্বাধীন হলাে ডিসেম্বরে। 

ফারুক বললেন, তুমি কি আমার গল্প অবিশ্বাস করছ ? জি-না স্যার। একটি যুদ্ধে চব্বিশ ঘণ্টায় অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। পারে না ? পারে স্যার। 

দেয়াল(পর্ব-১২)- হুমায়ূন আহমেদ

ক্যাপ্টেন শামস নিয়ে আমি প্রায়ই যে গল্পটি করি তা অনরেকর্ড আছে। জেনারেল ওসমানির যুদ্ধকালীন আর্কাইভ। Do you understand ? 

Yes sir. অতিরিক্ত চালাক হয়াে না। সেনাবাহিনী অতিরিক্ত চালাকদের জন্যে নয়। স্যরি স্যার । 

টিনের বেড়া, টিনের চালা। ছােট্ট কামরা। দড়ির চারপাইয়ের এক কোনায় প্রচণ্ড গরমেও উলের চাদর গায়ে আন্ধা পীর বসে আছেন। চারপাইয়ের এক কোনায় বিশাল হারিকেন। হারিকেনের কাচ ঠিকমতাে লাগানাে হয় নি বলে বুনকা বুনকা ধোয়া বের হচ্ছে। বাতাসের কারণে ধোয়া যাচ্ছে আন্ধা পীরের নাকেমুখে। তাতে তাকে ব্ৰিত মনে হচ্ছে না। চাদরের বাইরে তার ডানহাত বের হয়ে আছে। হাতে মােটা দানার তসবি। দানাগুলির একেকটির রঙ একেক রকম। 

মেজর ফারুকের হঠাৎ মনে হলাে, এ রকম একটি তসবি ফরিদা পেলে খুশি হতাে। মালা বানিয়ে গলায় পরত। এ ধরনের চিন্তা মাথায় আসায় ফারুক খানিকটা লজ্জিত বােধ করলেন। ফারুক বললেন, পীর সাহেব। আসসালামু আলায়কুম। 

আন্ধা হাফেজ সালামের জবাবে মাথা নাড়লেন। মুখে সালামের উত্তর দিলেন। 

আন্ধা হাফেজ পরিষ্কার শুদ্ধ উর্দুতে বললেন (বিহারিরা শুদ্ধ উর্দু জানে না), আপনি সৈনিক মানুষ। আপনি কষ্ট করে আমার কাছে এসেছেন। আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি বলুন। 

হুজুর! আমি সৈনিক মানুষ, তা কী করে টের পেলেন ? 

আন্ধা হাফেজ হাসতে হাসতে বললেন, আমি কোনাে আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় এই সংবাদ পাই নি। আপনি বুট পায়ে দিয়ে এসেছেন, বুটের শব্দে টের পেয়েছি। বুট জোড়া খুলে আমার পাশে বসুন। 

দেয়াল(পর্ব-১২)- হুমায়ূন আহমেদ

ফারুক তা-ই করলেন। আন্ধা পীর বললেন, সৈনিকদের সম্পর্কে একটি রসিকতা শুনবেন ? 

শুনব। 

বলা হয়ে থাকে, সৈনিকদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে। এটা ঠিক না। তাদের বুদ্ধি থাকে বুটজুতায়। যখন তারা বুট পরে, তখন তারা বুদ্ধিশূন্য মানুষে পরিণত হয়। তখন তাদের বুদ্ধি চলে যায় বুটজুতায়। এই কারণে কোনাে সৈনিক যখন আমার কাছে আসে, আমি তাকে বুট খুলে আমার কাছে বসতে বলি। এখন বলুন, আমার কাছে কেন এসেছেন ? ফারুক বললেন, আমি একটা কাজ করার পরিকল্পনা করেছি। আপনার দোয়া নিতে এসেছি। 

আন্ধা পীর বললেন, আপনার ডানহাতটা আমার দিকে বাড়ান। আমি ধরে দেখি । 

ফারুক হাত বাড়ালেন। আন্ধা পীর দুই হাতে ফারুকের হাত ধরলেন। 

সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে দেওয়া বর্ণনায় মেজর ফারুক হাত ধরাধরির এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, হঠাৎ তার মনে হলাে শরীর দিয়ে যেন হাইভােল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলাে। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলাে তার শরীর অবশ হয়ে গেছে । 

মেজর ফারুকের বর্ণনার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় ও সাধক অনুকূল ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাতের মিল আছে। শীর্ষেন্দু লিখেছেন, ঠাকুর আমার গায়ে হাত রাখামাত্র আমার শরীরের ভেতর দিয়ে হাইভােল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলাে। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলাে আমার শরীর 

অবশ হয়ে গেল। 

আন্ধা হাফেজ ফারুকের হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনার পরিকল্পনা অতি বিপজ্জনক এবং অতি ভয়ঙ্কর। কাজটি যদি আপনি নিজের কোনাে স্বার্থসিদ্ধির জন্যে না করেন তাহলে সফলকাম হবেন এবং বিপদেও পড়বেন না। তবে সময় এখনাে আসে নি। যে-কোনাে কাজের জন্যে নির্ধারিত সময় আছে। 

ফারুক বললেন, নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে আপনি কি আমাকে জানাবেন ? জানাব। ফারুক বললেন, যদি ইজাজত দেন তাহলে আমি উঠব। 

দেয়াল(পর্ব-১২)- হুমায়ূন আহমেদ

আন্ধা হাফেজ মাথা নাড়লেন এবং ফারুকের দিকে হাতের তসবি এগিয়ে দিলেন। ক্ষীণ গলায় বললেন, আমার সামান্য উপহার গ্রহণ করুন। এই উপহার আপনার কোনাে কাজে আসবে না, তা জানি। তবে আপনার প্রিয় কাউকে উপহার দিতে পারেন। একই জিনিসের নানান ব্যবহার হয়ে থাকে। যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথ চলে, সেই লাঠি দিয়ে মানুষও খুন করা যায়। হাতের তসবি গলার মালাও হতে পারে। 

আন্ধা হাফেজের কথার মাঝখানেই চারপাইয়ের নিচ থেকে দুটি বিড়াল লাফ দিয়ে হাফেজের দু’পাশে বসল। ফারুকের মনে হলাে বিড়াল দুটিও অন্ধ। 

জিপ শহরের দিকে ছুটে চলেছে । ফারুক চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আকাশে ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসও ছেড়েছে, মনে হয় দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি কি দূরেই হতে থাকবে ? নাকি এগিয়ে আসবে ? 

বড় ধরনের ঝুঁকি খেয়ে জিপ থেমে গেল। ফারুক বললেন, সমস্যা কী ? 

ড্রাইভার বলল, চাকা পাংচার হয়েছে স্যার। স্পেয়ার আছে। দশ মিনিট লাগবে। 

ফারুক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, fake your time. ইশতিয়াক বলল, স্যার কি জিপ থেকে নামবেন ? 

ফারুক জবাব দিলেন না। সিগারেটে টান দেওয়ামাত্র তাঁর মাথায় আবারও পুরােনাে পরিকল্পনা চলে এসেছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করে দেশে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটানাে। 

পরিকল্পনা এখন ঈগল পাখি। পাখির দুটি ডানার একটি ডানা হলাে সামরিক। হত্যা কীভাবে করা হবে ? কারা করবে ? দ্বিতীয় ডানা হচ্ছে রাজনৈতিক। এত বড় ঘটনা রাজনৈতিকভাবে কীভাবে সামাল দেওয়া হবে? এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁর ভায়রা ভাই মেজর রশীদকে। সে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তার ওপর ভরসা করা যায়। 

দেয়াল(পর্ব-১২)- হুমায়ূন আহমেদ

কাগজে-কলমে করা নিখুঁত পরিকল্পনা বাস্তবে ভেস্তে যায়। তুচ্ছ কারণেই TCCIA kingdom is lost for a nail. 

পরিকল্পনা কী কী কারণে জলে ভেসে যেতে পারে ফারুক তা ভাবার চেষ্টা করছেন। 

১. পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই প্রকাশ পেয়ে যাবে। 

পরিকল্পনাকারীরা ধরা খাবে। তাদের কোর্টমার্শাল হবে। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সামস যেভাবে হতভম্ব চোখে পিস্তলের নলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাকেও সেইভাবেই কোনাে এক পিস্তলের নলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। মূল পরিকল্পনা অতি অল্পকিছু মানুষকে জানানাে হবে, যাদের দিয়ে কার্যসমাধা করতে হবে। তারা বেঁকে বসতে পারে। তারা বলতে পারে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রশ্নই ওঠে না। ফারুকের হাতে ট্যাঙ্কবহর আছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত ত্রিশটি টি-৫৪ ট্যাঙ্ক এবং চার শ রাউন্ড ট্যাঙ্কের গােলা বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। গােলা এখন গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে তালাবন্ধ। ফারুক ট্যাঙ্কবাহিনীর প্রধান, কিন্তু তার ট্যাঙ্ক গােলাশূন্য। এমনকি মেশিনগানের গুলি পর্যন্ত নেই। এই ট্যাঙ্ক আর খেলনা ট্যাঙ্ক তাে একই। 

জিপ চলতে শুরু করেছে। জিপের চাকা কখন বদল হয়েছে, কখন জিপ চলতে শুরু করেছে, ফারুক কিছুই জানেন না। তিনি এতক্ষণ ছিলেন ঘােরের মধ্যে। হঠাৎ ঘাের কেটেছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *