দেয়াল শেষ পর্ব- হুমায়ূন আহমেদ

কারণ খাসির সালুন অসাধারণ স্বাদ হয়েছিল।দেয়াল

হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, তােমাকে দেখে অবাক হয়েছি। তুমি একা চলে এসেছ। 

অবন্তি বলল, আমি একা তাে আসি নাই। আমার সঙ্গে দুইজন চড়নদার 

ছিল। 

জাহাঙ্গীর অবাক হয়ে বললেন, বলাে কী ? তারা পুরুষ? 

অবন্তি হাই তুলতে তুলতে বলল, তারা পুরুষও না, রমণীও না। তাঁরা দুজন ফেরেশতা। সব মানুষের কাঁধে বসে থাকে। 

ও আচ্ছা বুঝেছি। কেরামন কাতেবিন। তােমার সাহস দেখে চমকায়েছি। হুজরাখানার দিকে তােমার টান দেখেও ভালাে লেগেছে। 

অবন্তি বলল, হুজরাখানার প্রতি বা আপনার প্রতি আমার কোনাে টান নাই। আমার এখানে চলে আসার একটাই কারণ—দাদাজানকে শিক্ষা দেওয়া। তিনি সারাক্ষণ আমার ওপর নজরদারি করেন, এটা আমার ভালাে লাগে না। আমার জন্যে আমিই যথেষ্ট, এটা উনাকে বুঝাতে চাই। এখন কি আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে আমি কেন খতিবনগরে এসেছি ? 

পরিষ্কার হয়েছে। 

আপনি আবার স্বামীর অধিকার ফলানাের জন্যে নিশিরাতে আমার ঘরে উপস্থিত হবেন না। আমি আপনাকে স্বামী স্বীকার করি না।

দেয়াল শেষ পর্ব- হুমায়ূন আহমেদ

জাহাঙ্গীর ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি উপস্থিত হব না। 

অবন্তি বলল, তবে আমি আপনার সঙ্গে খানা খাব। আপনার সঙ্গে খানা খেতে আমার অসুবিধা নাই। মাছ আমি পছন্দ করি না, তবে আজ কাতল মাছের সালুন দিয়ে ভাত খাব ।। 

জাহাঙ্গীর বললেন, মাছে বিষ মিশানাে হয়েছে, এই খবর পাও নাই ? 

অবন্তি বলল, পেয়েছি। এটা ভুয়া খবর। মাছে বিষ মিশানাের কথা আপনি বলেছেন যেন সবাই বুঝে আপনি বাতেনি খবর পান। খুবই অন্যায় কাজ করেছেন। আপনার অন্যায় আপনি দেখবেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি শুধু মাছের সালুন দিয়ে ভাত খেয়ে দেখাব যে, মাছে কেউ বিষ দেয় নাই। 

মাছের সালুন নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়েছে। 

অবন্তি বলল, তার আগেই আমি দুইটা পেটি আনিয়ে রেখেছি। একটা আপনি খাবেন, আরেকটা আমি। সালমাকে খানা দিতে বলি। আমার ভুখ লেগেছে। সারা দিন কিছু খাওয়া হয় নাই। 

হাফেজ জাহাঙ্গীর নিঃশব্দে রাতের খাওয়া খেলেন। কাতল মাছের বিশাল পেটির অর্ধেকটা শেষ করলেন। 

অবন্তি বলল, এত স্বাদের মাছ আমি কখনাে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। দাদাজানকে এই মাছের এক টুকরা খাওয়াতে পারলে ভালাে হতাে। উনি মাছ খুব পছন্দ করেন। 

জাহাঙ্গীর বললেন, তােমার দাদাজানের রাতের খানা শেষ হয়েছে। তিনি খাসির সালুন দিয়ে তৃপ্তি করে খেয়েছেন। 

দাদাজান আমার খোঁজে চলে এসেছেন? 

দেয়াল শেষ পর্ব- হুমায়ূন আহমেদ

হা। তাকে থাকার জন্যে হুজরাখানায় একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। নিজের বাড়িতে তার থাকার উপায় নাই। বাড়িঘর দখল হয়ে গেছে। 

কে দখল করেছে ?

শহরবন্দরের চেয়ে মফস্বলে দুষ্ট লােক বেশি। তাদেরই একজন। নাম ছানু ভাই। 

অবন্তি বলল, ছানু ভাই কি আপনার চেয়েও দুষ্ট? 

হাফেজ জাহাঙ্গীর জবাব দিলেন না। আহত চোখে অবন্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বারবার মনে হচ্ছিল–তার সামনে কোনাে মানবী বসে নেই, আয়তলােচনা বেহেশতের হুর বসে আছে। যাকে কোনাে পুরুষ বা জ্বিন স্পর্শ করে নি। 

ছানু ভাই হাসিখুশি মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। বেঁটে গােলগাল চেহারা, মাথাভর্তি কাঁচাপাকা বাবরি চুল। অমায়িক কথাবার্তা। 

ছানু ভাই সরফরাজ খানের সঙ্গে কোলাকুলি করে গাঢ় স্বরে বলল, ভাইসাহেব, কেমন আছেন ? বাড়িঘরের কথা মনে পড়ে না ? আফসােস। 

সরফরাজ খান বললেন, বাড়িঘর তাে সব আপনি দখল নিয়ে নিয়েছেন। মনে পড়লেই বা কী, না পড়লেই কী ? 

ছানু ভাই ব্যথিত গলায় বললেন, আমি যদি দখল নিয়ে থাকি তাহলে দশজনের মােকাবিলায় আমারে এক শ বার জুতাপেটা করেন। বাড়িঘর খালি পড়ে ছিল। গরু-ছাগলের আস্তানা হয়ে ছিল সেখানে। আমি মুজিব সেন্টার করেছি। মুজিব সেন্টারে বঙ্গবন্ধু এবং বাকশাল নিয়ে গবেষণা হবে। এতে আপনার পাপ কাটা যাবে। সরফরাজ খান অবাক হয়ে বললেন, আমার পাপ কাটা যাবে মানে? আমার কী পাপ ? 

দেয়াল শেষ পর্ব- হুমায়ূন আহমেদ

ছানু ভাই শান্ত গলায় বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি শান্তি কমিটির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, সেই পাপ। খতিবনগরের পীর সাহেব ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। আপনি তার মুরিদ হয়েছিলেন। নিজ নাতনিকে এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এই ইতিহাস তাে কারও অজানা না। তারপরেও আপনাকে ছােটভাই হিসেবে একটা পরামর্শ দেই। আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার নামে নালিশ করেন। কীভাবে আমি আপনার বিষয়সম্পত্তি সব দখল করেছি সেটা বলেন। বঙ্গবন্ধু যে হুকুম দেন তা মাথা পেতে নিব। আমার নাম বললেই উনি আমাকে চিনবেন। উনার জন্যে আজ সকালেই জিয়ল কই মাছ পাঠিয়েছি। 

সরফরাজ খান বললেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার যােগাযােগের ব্যবস্থা আছে। আমি উনাকে জানাব। | ছানু ভাই বলল, ভাই সাহেবকে একটা সত্য কথা বলি ? উনাকে জানালে কিছুই হবে না। উনার কানে লাখ লাখ নালিশ। এত নালিশ শুনলে উনার পুষবে । ভাইসাহেব এখন বলেন, চা খাবেন নাকি কফি খাবেন ? মুজিব সেন্টারে চা কফি দু’টারই ব্যবস্থা আছে। 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *