দেয়াল(পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় সরফরাজের ঘর অন্ধকার। কিছুদিন হলাে তাঁকে অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে, কারণ তাঁর চোখ উঠেছে। আলাের দিকে তাকালেই চোখ কড়কড় করে।

দেয়ালমুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের সব মানুষের চোখে এই রােগ হয়েছিল। তখন রােগের নামকরণ হয়েছিল জয়বাংলা রােগ’। সরফরাজ খানের তখন এই রােগ হয় নি, এখন হয়েছে। মানসিক টেনশনের সঙ্গে কি এই রােগের কোনাে যােগ আছে ? 

প্রবল মানসিক চাপের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় সবার এই রােগ হয়ে গেল । তিনি কোনাে মানসিক চাপে ছিলেন না বলে তাঁর হয় নি। এখন মানসিক চাপে 

আছেন বলে চোখে জয়বাংলা রােগ হয়েছে। মানসিক চাপটা অবন্তিকে নিয়ে। 

কালাম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে সে কুঁজো না। বুক টান করে হাঁটে। শুধু তার সামনেই কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়। সরফরাজ বললেন, সাইকেলে করে এসেছে মেয়েটা কে? 

শামিমা আপু। শামিমা আপু বললে তাে আমি কিছু বুঝব না। শামিমা আপুটা কে ? অবন্তি আপুর বান্ধবী। ফ্রেন্ড! 

সরফরাজ বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি কোনােদিন এই মেয়েকে দেখলাম না । অবন্তির কাছে তার নাম শুনলাম না। সে হয়ে গেল অবন্তির বান্ধবী ? 

দেয়াল(পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

শামিমা আপু পেরায়ই আসেন। 

প্রায়ই যদি আসে আমার সঙ্গে দেখা হয় না কেন ? আপনি দুপুরে খানার পরে যখন ঘুম যান, তখন শামিমা আপু আসে। 

সরফরাজ কঠিন গলায় বললেন, তুমি ওই মেয়ের কাছে যাও। তাকে আসতে বলল। 

কালাম বলল, এখন যাওয়া যাবে না। এখন যাওয়া যাবে না কেন? উনারা দুইজন দরজা বন্ধ কইরা কী জানি করেন। 

সরফরাজ খানের মাথায় চক্কর দিল। দরজা বন্ধ করে কী জানি করে, এর মানে কী ? খুব খারাপ কিছু না তাে? কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ! 

সরফরাজ খান নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, যাও, বন্ধ দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকে। যখন দরজা খুলবে তখন তাকে নিয়ে আসবে। 

জি আচ্ছা। 

দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। ওরা কী কথা বলে তা আমার জানা দরকার। 

জি আচ্ছা স্যার। 

সরফরাজ তিক্ত গলায় বললেন, দরজা বন্ধ করে গল্প করার কী আছে তাও তাে বুঝলাম না। 

কালাম বলল, শামীমা আপু ছিগরেট গাঁজা এইগুলা খায় তাে, এইজন্যে দরজা বন্ধ রাখে। 

সরফরাজ হতভম্ব গলায় বললেন, কী বলাে! 

কালাম বলল, কথা সত্য স্যার। আমি দুইবার উনারে ছিগারেট আইনা দিছি। উনি খায় কেটু ছিগারেট। কড়া আছে। পাকবাহিনী এই ছিগারেট খাইত। 

সরফরাজ নিজেই একতলায় নেমে এলেন, অস্বস্তি নিয়ে বন্ধ দরজার পাশে মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভেতর থেকে কোনাে কর্থাবার্তা শােনা যাচ্ছে না, তবে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে শামীমা মেয়েটিকে বের করেন। এই কাজটা করলে অবন্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট হবে বলে কাজটা করতে পারছেন না। 

ছেলেদের মতাে পােশাক পরা মেয়েটির নাম শামীমা না। তার নামও ছেলেদের মতাে। শামীম। পুরাে নাম শামীম শিকদার । সে মাওবাদী সিরাজ সিকদারের ছােটবােন। পেশায় ভাস্কর। কিছুদিন আগে ভাস্কর্যে সে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছে। 

দেয়াল(পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

শামীম সিকদারের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের লেকচারার হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা আছে। শামীম শিকদার হুমায়ূন আহমেদের প্রথম গ্রন্থ নন্দিত রকের প্রচ্ছদ শিল্পী। বইয়ের দুটি মুদ্রণে শামীম শিকদারের প্রচ্ছদ ছাপা হয়। তারপর প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। শামীম শিকদারকে প্রায়ই দেখা যেত সাইকেল চালিয়ে (মাঝে মাঝে মােটর সাইকেল) হুমায়ুন আহমেদের বাবর রােডের বাসায় (শহীদ পরিবার হিসেবে সরকার থেকে পাওয়া) উপস্থিত হতাে। সে সারাক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সঙ্গে থাকত। গলা নিচু করে গুটুর গুটুর গল্প করত। | অবন্তির সঙ্গে শামীম সিকদারের পরিচয়ের সূত্র হচ্ছে, অবন্তি আর্ট কলেজ থেকে তাকে ধরে এনেছে। শামীম শিকদারের দায়িত্ব মাটি দিয়ে অবন্তির একটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা। অবন্তি এই মূর্তি পাঠাবে তার মাকে। 

সরফরাজ মােটামুটি বিচারকের আসনে বসে অবন্তির বান্ধবীর অপেক্ষা করছেন। বসেছেন কাঠের চেয়ারে। সােফায় আয়েশ করা বসা না। তাঁর হাতে দৈনিক ইত্তেফাক। গােল করে চোঙার মতাে করা। চোঙা কী কাজে আসবে তা বােঝা যাচ্ছে না। 

অবন্তি ঘরে ঢুকে হালকা গলায় বলল, আমাকে ডেকেছ ? সরফরাজ বললেন, তােকে তাে ডাকি নি। তাের বান্ধবী কোথায়? চলে গেছে। চলে গেছে মানে কী ? তাকে বলা হয়েছে আমার সঙ্গে দেখা করতে । 

অবন্তি বলল, সে তােমার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নি। চোখমুখ শক্ত করে বসে থাকবে না। কী জানতে চাও, আমাকে জিজ্ঞেস করাে। আমি বলে দেব। 

ওই মেয়ে নাকি গাঁজা খায় ? হু, খায় । গাঁজা খাওয়া ক্যাটাগরির একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় কীভাবে? 

অবন্তি বলল, তুমি এত উত্তেজিত হয়াে না। এই মেয়ে গাঁজা খাচ্ছে তাতে কী হচ্ছে ? আমি তাে তার কাছ থেকে গাঁজা খাওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছি না।

দেয়াল(পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

সরফরাজ খান বললেন, তুই কিসের ট্রেনিং নিচ্ছিস ? 

অবন্তি হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি কোনাে ট্রেনিং নিচ্ছি না। আমি শুধু তার সামনে এক ঘণ্টা নেংটো হয়ে বসে থাকি । 

কী বললি? 

অবন্তি বলল, কী বলেছি তা তুমি ভালােই শুনেছ। দ্বিতীয়বার বলব না। আমার বান্ধবী আমার আবক্ষ মূর্তি বানাচ্ছে। আমি নিশ্চয়ই লেপ-তােষক গায়ে দিয়ে মূর্তির জন্যে সিটিং দেব না। 

তুই ওই মেয়ের সামনে নগ্ন হয়ে বসে থাকিস? হঁ্যা। আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলিস ? বিশ্বাস করতে না চাইলে করবে না। 

অবন্তি ঠোট গােল করে শিস বাজানাের চেষ্টা করল। এই চেষ্টার পেছনের উদ্দেশ্য একটাই—দাদাজানকে রাগানাে। তবে আজ মনে হয় তিনি রাগবেন না। বিস্ময়ে হতভম্ব হওয়া মানুষ রাগতে পারে না। 

অবন্তি দাদার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে কুঁ কুঁ শব্দ করতে লাগল। সরফরাজ অবাক হয়ে বললেন, এমন করছিস কেন? 

অবন্তি বলল, ভেঙাচ্ছি। But why? তােমার ওপর রাগ লাগছে, এইজন্যে ভেঙাচ্ছি। হতভম্ব সরফরাজ বললেন, কেন রাগ লাগছে, সেটা কি জানতে পারি ? 

না, জানতে পারাে না। কারণ আমি নিজেই জানি না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, আমার কিসের ব্যথা যদি জানতেম তাহলে তােমায় জানাতেম। কথাগুলি মনে হয় উলট-পালট হয়ে গেল। স্যারের কাছ থেকে জানতে হবে। 

তাের স্যার সব জানে ? সব জানে না, তবে যা জানার তা জেনে দিতে পারে। তাহলে তাে বিরাট কৰ্মীপুরুষ। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *