চায়ে প্রচুর চিনি ও এলাচ দেয়ায় পায়েসের মতাে গন্ধ। শুৰু চমৎকার লাগছে খেতে। জরীর মা বললেন, “চপ আনতে বলেছি। যে কয়টা পার খেয়ে নাও সবাই—রাতে খেতে দেরি হবে।‘ আবার একটা হুল্লোড় উঠল।
কন্যাপক্ষীয় মেহমানদের আসবার বিরাম নেই। রিকশা এসে থামছে। হাসিমুখে নামছে চেনা লােকজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিশে যাচ্ছে বিয়েবাড়ির স্রোতে। এ রকম একটা উৎসবে কাউকেই আলাদা করে চেনা যায় না। সবাই বাড়ির লােক হয়ে যায়। আনিসের মা তাই রিকশা থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলেন।
আনিসের মা যে আসবেন তা সবাই জানত। তাকে চিঠি লিখে জানান হয়েছে, আনিস সতের তারিখে আমেরিকা যাচ্ছে, জটিল অপারেশন হবে, একবার যেন তিনি আসেন। সেই চিঠি পেয়ে আনিসের মা যে এত আগেভাগে এসে পড়বেন, তা কেউ ভাবে নি।
অনেক দিন পরে দেখা, তবু জরীর মা ঠিকই চিনলেন। চিনলেও না চেনার ভান করলেন। বললেন, আপনাকে চিনতে পারলাম না তাে!’ |
আনিসের মা কুষ্ঠিত হয়ে বললেন, ‘আমি আশরাফী, আনিসের মা।
তার স্বামী ভদ্রলােকটি মােটাসােটা ধরনের গােবেচারা ভালােমানুষ। তিনি বিনীত হেসে বললেন, ‘আপা, ভালাে আছেন? কার বিয়ে ?
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
‘আমার সেজো মেয়ের।’
বলতে গিয়ে জরীর মার একটু লজ্জা লাগল। কারণ পরীর বিয়ের সময় এদের কোনাে খবর দেন নি, জরীর বিয়েতেও না। জরীর মা বললেন, ‘আপনারা হাত–মুখ ধােন | আনিসের সঙ্গে দেখা করলে দোতলায় যান।
আনিসের মা দোতলায় উঠলেন না। তাঁর হয়তাে কোনাে কারণে লজ্জা বােধ হচ্ছিল। বিয়েবাড়িতে অতিথি হিসেবেও নিজেকে অবাঞ্ছিত লাগছে। কিন্তু তাঁকে তাে আসতেই হবে। কারণ, এই বাড়িতে তাঁর একটি অসুস্থ ছেলে আছে। সেই ছেলেটি একসময় এতটুকুন ছিল! দু’টি ছােট ছােট দুধদাঁত দেখিয়ে অনবরত হাসত। কথা শিখল অনেক বয়সে। তাও কি, ‘ম’ বলতে পারত না। আম্মাকে ডাকত ‘আন্না’ বলে।
আহ, চোখে জল আসে কেন? | পুরনাে কথায় বড়াে মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি ছােট ছােট পা ফেলে ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এ বাড়ির লােকজন অনেকেই আজ তাঁকে চিনতে পারছে না, এও এক বাঁচোয়া। চিনতে পারলে আরাে খারাপ লাগত। মাঝবয়েসী এক মহিলা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জনীর কী হন?
তিনি থতমত খেয়ে কি একটা বললেন। লােকজনের সঙ্গ ছেড়ে চলে গেলেন ভেতরের দিকে।
এ বাড়ির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি যখন বউ হয়ে আসেন, তখন দোতলায় একটিমাত্র ঘর ছিল, সেখানে বড়াে ভাসুর থাকতেন। পুকুরপাড়েও কোনাে আলাদা ঘর ছিল না। বাড়ির কোনাে নামও ছিল না। লােকে বলত ‘উকিলবাড়ি। রিকশা থেকে নেমেই পিতলের নেমপ্লেটে বাড়ির নাম দেখলেন ‘কারা কানন । কে রেখেছে এ নাম কে জানে! বােধহয় বড়ো ভাসুর। এ বাড়ি এখন আর চেনা যায় না। অনেক সুন্দর হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফুলের বাগানটি নষ্ট হয়ে গেছে। গােলাপঝাড়ে মাত্র অল্প ক’টি চুল দেখছেন। অথচ একসময় অগণিত গােলাপ ফুটত।
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
এই গােলাপ নিয়েই কত কাণ্ড। আনিসের বাবার শখ হল গােলাপ দিয়ে খাঁটি আতর বানাবেন। রাশি রাশি ফুল কুচিকুচি করে পানিতে চোবান হল। সেই পানি জ্বাল দেয়া হল সারা দিন। সন্ধ্যাবেলা আতর তৈরি হল, বােটা গন্ধে তার কাছে যাওয়া যায় না। বাড়িতে মহা হাসাহাসি।
আনিসের বাবার মনমরা ভাব কাটাবার জন্যে তিনি সে–আতর মাখলেন। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল ‘আতর বৌ’! কী লজ্জা কী লজ্জা! বড়াে ভার পর্যন্ত আর বৌ বলে ডাকতেন। পরী তখন সবে কথাবলা শিখেছে। ‘র’ বলতে পারে না, সে ডাকত ‘আতল, আতল’। আজ কি সেই পুরনাে স্মৃতিময় নাম কারাে মনে আছে? জরীর মা যখন নাম জানতে চাইলেন, তখন তিনি কেন সহজ সুরে বললো না, আমি আর বৌ? | না, আজ তা সম্ভব নয়। এ বাড়িতে আর বৌ বলে কেউ নেই। পুরনাে দিনের সব কথা মনে রাখতে নেই। কিছু কিছু কথা ভুলে যেতে হয়। তিনি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পিছনের খােলা জায়গাটায় এসে পড়লেন। এখানে একটি প্রকাণ্ড পেয়ারাগাছ ছিল, ‘সৈয়দী পেয়ারা বলত সবাই। ভেতরটা লাল টুকটুক। গাছটি আর নেই।