নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-২)

কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছেশীতকালে আমের মুকুল হয় নাকি? 

বড়াে চাচা।’ তিনি চমকে পিছনে ফিরলেনআশ্চর্য! জরী দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পেছনে। ঘুম ৬ন ফোলা ফোলা মুখ। মেয়েটিকে আজ বড়াে অচেনা মনে হচ্ছে। এত রূপসী তাে জরীকে কখনাে মনে হয় নি।

নির্বাসনবিয়ের আগের দিন সব মেয়ে নাকি গুটিপােকার মতাে খােলস ছেড়ে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। তিনি হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। 

‘বুড়ােচাচা, কী করছেন একা একা? ‘সানাই শুনছি। 

আজ আমি খুব ভােরে উঠেছি। আপনি খুশি হয়েছেন চাচা?” 

তিনি হাসলেন। জরী একটা হলুদ রঙের চাদর গায়ে জড়িয়েছে। একটু একটু কাঁপছে শীতে? 

‘জরী, তাের শীত লাগছে? 

উহু। আপনি আজ রেওয়াজ করবেন না চাচা? “না মা। আজ আমার ছুটি। 

দু’ জনে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। জরী অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ইস, কী কুয়াশা পড়েছে বাবা! 

তিনি একসময় বললেন, ‘সানাই শুনতে ভালাে লাগছে জরী?” 

লাগছে।’ 

কে বাজাচ্ছে জান? জানি না, কে বাজাচ্ছে। ‘বিসমিল্লাহ্ খাঁ, এখন বাজছে মিয়া কি টৌড়ি। 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ 

জরী আরাে কাছে সরে এসে কার্ণিশে ভর দিয়ে দাঁড়াল। মৃদু গলায় বলল, ‘কী সুন্দর লাগছে। আগে জানলে রােজ ভােরে উঠতাম।’ 

তিনি জরীর দিকে তাকিয়ে সমেহে হাসলেন। জরী বলল, ‘একটা হালকা সুবাস পাচ্ছেন বড়ােচাচা?” 

‘পাচ্ছি ।’ ‘বলুন তাে কিসের? 

তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন। শিউলি ফুলের নাকি? বাগানে একটি শিউলিগাছআছে। কিন্তু সেফুলের গন্ধ তাে হালকা। 

এতক্ষণে সূর্য উঠল। গাছে গাছে কাক ডাকছে। কিচিরমিচির করতে করতে দু’টি শালিক এস বসল ছাদে। জরী হাত বাড়িয়ে দুটি আমের পাতা ছিড়ে এনে গন্ধ শুকল। তিনি দেখলেন জুরী কাঁদছে। তিনি চুপ করে রইলেন। আহা একটু কাঁদুক। এমন একটি সময়ে না কাঁদলে মানায় না। তার ভীষণ ভালাে লাগল। তিনি কোমল গলায় বললেন, “জরী, দেখ সূর্য উঠেছে। এমন সুন্দর সূর্যোদয় কখনাে দেখেছিস?” 

জরী চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, ‘সান্তাহার যাবার সময় এক বার ট্রেনে দেখেছিলাম।’ 

‘দেখ, আজকে আবার দেখ।’ 

জরী ফিসফিস করে বলল, ‘কী সুন্দর। 

বলতে বলতে জরী আবার চোখ মুছল। তিনি নরম গলায় বললেন, •• মেয়ে, আজকের দিনে কেউ কাঁদে? ঐ দেখ দু’টি শালিক পাখি। দুই শালিক দেখলে 

কী হয় মা? 

জরী ফিসফিস করে বলল, ‘ওয়ান ফর সৱাে, টু ফর জয়। 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ 

ঠিক তখনি জরীর বন্ধুরা নিচ থেকে ‘জরী জরী’ করে চেচাতে লাগল। জরী নিঃশব্দে নিচে নেমে গেল।তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ভােরের এরকম অচেনা আলােয় মন বড়াে দুর্বল হয়ে যায়। আপনাকে ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। বড়াে বেশি মনে পড়ে, দিন ফুরিয়ে গেল। তিনি সুর করে পড়লেন‘ফাৰিআয়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ জি বান]* 

কাল রাতে চার বান্ধবী জরীকে নিয়ে একখাটে ঘুমিয়েছিল। এরা অনেক দিন পর একসঙ্গে হয়েছে। লায়লার সঙ্গে জরীর দেখা হয়েছে প্রায় চার বছর পর। আভা ও কনক ময়মনসিংহ থাকলেও দেখাসাক্ষাৎ প্রায় হয় না বললেই চলে। দূরসম্পর্কের বােন। স্কুলের পড়া শেষ হবার পর একমাত্র তার সঙ্গেই জরীর রােজ রােজ দেখা হত। পুরনাে বন্ধুদের মধ্যে শেলী ও ইয়াসমীন আসে নি। 

অনেক দিন পর মেয়ে বন্ধুরা একত্রিত হলে একটা দারুণ ব্যাপার হয়আচমকা সবার বয়স কমে যায়। প্রতিনিয়ত মনে হয় বেঁচে থাকাটা কী দারুণ সুখের ব্যাপার। 

জরীর বন্ধুরা গত পরশু থেকে ক্লান্তিহীন হৈচৈ করে যাচ্ছে। গুঞ্জগুজ করে খানিকক্ষণ গল্প, পরমুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত হাসি। আবার খানিকক্ষণ গল্প, আবার হাসি। এক জনকে হয়তো দেখা গেল হঠাৎ কী কারণে দল ছেড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। তার পিছনে পিছনে ছুটছে বাকি সবাই! খিলখিল হাসির শব্দে সচকিত হয়ে উঠছেবাড়ির লােকজন। | গতরাতটা তাদের জেগেই কেটেছে। আভা তার প্রেমের গল্প বলেছে রাত একটা পর্যন্ত। তার প্রেমিকটি এক জন অধ্যাপক।

আভার বর্ণনানুসারে দারুণ স্মার্ট ও খানিকটা বােকা। সে তার স্মার্ট প্রেমিকটির দু’টি চিঠিও নিয়ে এসেছিল বন্ধুদের দেখাতে। কাড়াকাড়ি করে দেখতে গিয়ে সে চিঠির একটি ছিড়ে কুটিকুটি। অন্যটি থেকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে সবাই বানান ভুল বের করতে লাগল। একএকটি ভুল বের হয়, আর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সবাই। 

মাঝরাতে লায়লার হঠাৎ চা খাবার ইচ্ছে হল। কলক বলল, ‘চমৎকার, চল সবাইছাদে বসে চা খাই।’ 

রুনু রাজি হল না। তার নাকি ঘুম পাচ্ছে। সে বলল, এই শীতে ছাদে কেন? 

 

Read More

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-৩)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *