নীলু বলতে-বলতে হেসে ফেলল। এবং হাসি ঢাকার জন্যে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। মিসির আলি খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। কারণ, তিনি একটি আপত্তিকর ভাবনা ভাবছিলেন। তিনি ভাবছিলেন–নীলুর সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দুজনেই ভিজে জবজব। হুড় তোলা এবং পর্দা ফেলা। রিকশাওয়ালা বাতাস কাটিয়ে বহু কষ্টে এগুচ্ছে। তিনি নীলুর হাত ধরে আছেন।স্যার।কল শুধু শুধু আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন?
আমরা সবাই তো এ-রকম কত অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা করি, এবং এটাই তো স্বাভাবিক।হু, তা ঠিক। আমার সঙ্গে কী বলতে চাচ্ছিলে বল। আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ঝড় আসবে।বলতে না বলতেই বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বাতাস বইতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। নীলু মৃদু স্বরে বলল, রানু আপাকে তো আপনি ভালো মতন চিনতেন, তাই না। স্যার?
হ্যাঁ।রানু আপার সঙ্গে আমার কী কী মিল আছে? কোনো মিল নেই। প্রতিটি মানুষই আলাদা। এক জন মানুষের সঙ্গে অন্য এক জন মানুষের মিল থাকে সামান্যই।আপার অসম্ভব ইএসপি ক্ষমতা ছিল। ছিল না? তা ছিল।আমারও আছে। আছে না? হ্যাঁ, আছে।রানু আপা কি আপনাকে কখনো বলেছিল, তার ভেতরে এক জন দেবী বাস করেন? বলেছিল।আপনি বিশ্বাস করেন নি?
না, করি নি। এইসব ছেলেমানুষ জিনিস বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।স্যার, রানু আপা যা বলত, এখন আমি যদি তা-ই বলি–আপনি বিশ্বাস করবেন।না। পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে স্যার।একসময় ঝড়-বৃষ্টিকেও রহস্যময় মনে করা হত, এখন করা হয় না। মানুষের জ্ঞান, মানুষের বুদ্ধি রহস্যময়তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে যত অলৌকিক ব্যাপার আছে, তার প্রতিটির পেছনে আছে একটি লৌকিক ব্যাখ্যা।মিসির আলি সিগারেট ধরলেন এবং বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন– দেখ নীলু, তুমি বলছ, তোমার ভেতর একজন দেবী আছেন। সেই দেবী যদি এই তোমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন এবং আমাকে বলেন এই যে মিসির সাহেব। তাহলেও আমি ব্যাপারটা বিশ্বাস করব না। আমি খুঁজব একটা লৌকিক ব্যাখ্যা।কী হবে সেই ব্যাখ্যা?
আমি যা দেখব, মনোবিজ্ঞানীর ভাষায় তার নাম হেলুসিনেশন। কিছু-কিছু ড্রাগস আছে, যা খেলে হেলুসিনেশন হয়। যেমন এলএসডি। ইংল্যাণ্ডে আমি এক ছাত্রকে দেখেছিলাম–সে এলএসডি খেত যিশুখ্রিষ্টকে দেখার জন্যে। এলএসডি খেলেই সে যিশুখ্রিষ্টকে দেখতে পেত। তুমি বুঝতেই পারছি, সে যা দেখত, তা হেলুসিনেশন।নীলু দীর্ঘ সময় চুপ কুরে বসে রইল। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। এক-একটা বাতাসের ঝাপটা এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে, তবু দুজনের কেউ নড়ল না। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু মিসির আলির সিগারেটের আলো ওঠানামা করছে।নীলু ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার।বল।
আমি একটি খারাপ লোকের হাতে পড়েছিলাম স্যার। একটা ভয়ঙ্কর খারাপ লোক আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নির্জন একটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সে একটা ক্ষুর নিয়ে এসেছিল আমাকে মারতে। তখন সেই দেবী আমাকে রক্ষা করেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমার দেখা। দেবীকেও আমি দেখেছি। একটি অপূর্ব নারীমূর্তি।তুমি বলতে চাও, তারপর থেকে সেই দেবী তোমার সঙ্গে আছে? হ্যাঁ।তুমি যা দেখেছ, তার যে একটা লৌকিক ব্যাখ্যা হতে পারে–তা কি তুমি ভেবেছ?
সবকিছুর ব্যাখ্যা নেই স্যার।চেষ্টা করে দেখি, এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় কিনা।ঠিক আছে, চেষ্টা করুন।রানু মেয়েটির সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল। তার কাছ থেকেই দেবীর ব্যাপারটি তুমি শুনেছ।। একটা নতুন ধরনের কথা। রোমান্টিক ফ্লেভার আছে দেবীর ব্যাপারটায়, কাজেই জিনিসটা তোমার মনে গেঁথে রইল। তুমি নিজে যখন বিপদে পড়লে, ঐ জিনিসটাই উঠে এল তোমার মনের ভেতর থেকে। একটা হেলুসিনেশন হল। তীব্র মানসিক চাপ এবং তীব্ৰ হতাশা থেকে এই হেলুসিনেশনের জন্ম। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে strees induced hallicination. ঐ খারাপ লোকটি মারা গেল কীভাবে?
তাঁর মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক কারণে। পা পিছলে উন্টে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে বা এইজাতীয় কিছু। এখানে দেবীর কোনো ভূমিকা নেই, লোকটির সুরতহাল রিপোর্ট থেকেই তার মৃত্যুর কারণ বের হয়ে আসা উচিত। কী ছিল পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে? মিসির আলি প্রশ্নের জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন। কোনো জবাব পাওয়া গেল। না। নীলু মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। অন্ধকারে পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কেন জানি তাঁর মনে হল, মেয়েটি কাঁদছে। কাঁদবে কেন সে? কাঁদার মতো কোনো কথা কি তিনি বলেছেন?
নিলু?
জ্বি।
আমি এখন উঠি? আমার যাওয়া দরকার। এ-বৃষ্টি কমবে না। যত রাত হবে, তত বাড়বে। তুমি কি আমাকে আরো কিছু বলবে?
নীলু জবাব দিল না। মিসির উঠে দাঁড়ালেন।
তোমার বাবাকে খবর দাও, বিদেয় নিয়ে যাই।
নীলু কঠিন কণ্ঠে বলল, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
তিনি বিঘিত হয়ে বললেন, বাসায় যাচ্ছি, আর কোথায় যাব? না। আপনার বাসায় যাওয়া হবে না। আজ রাতে আপনি এখানে থাকবেন।কী বলছ তুমি! আপনার জন্যে ঘর রেডি করে রেখেছি। সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম আছে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এখানে কেন থাকিব? এখানে থাকবেন, কারণ আজ রাতে লোহার রড নিয়ে একটি ছেলে আপনাকে মারতে যাবে। আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না বা বানিয়েও কিছু বলছি না। আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি। ঐ ছেলেটির নাম যদি আপনি জানতে চান, তাও বলতে পারি। কি, জানতে চান? মিসির আলি ক্ষীণ স্বরে বললেন, ওরা কী নাম? ওর নাম ফিরোজ। স্যার, আপনি কি আমি যা বলছি, তা বিশ্বাস করছেন?
বুঝতে পারছি না। আমি একটি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছি।দ্বিধার মধ্যে পড়েন বা না পড়েন–আমি এখান থেকে আপনাকে যেতে দেব না, কিছুতেই না।মিসির আলি লক্ষ করলেন, মেয়েটি কঠিন স্বরে কথা বলছে। তার কথা বলার ধরন থেকেই বলে দেয়া যায়, এই মেয়ে তাকে যেতে দেবে না।নীলু, আমার বাসায় কাজের মেয়েটি আছে একা।না, ইমা আপনার ঘরে নেই। আপনার ফিরতে দেরি দেখে সে বাড়িওয়ালার ঘরে ঘুমুতে গেছে।তুমি ওর কী নাম বললে? যা নাম, তা-ই বললাম–ইমা।ইমা? হ্যাঁ, ইমা।ওর বাবার নাম বলতে পারবো?
ইমা নাম থেকেই আপনি ওর বাবাকে বের করতে পারবেন।বলতে-বলতে নীলু। হেসে উঠল। হাসিতে একটি ধাতব ঝঙ্কার। অন্য এক ধরনের কাঠিন্য। যেন এ নীলু নয়, অন্য একটি মেয়ে। অচেনা এক জন মেয়ে।স্যার আসুন, আপনাকে আপনার ঘর দেখিয়ে দিই। ড্রয়ারে মোমবাতি আছে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে-বসে বৃষ্টির শোভা দেখুন। আমি যাব রান্না করতে।তোমাদের টেলিফোন আছে না? আছে। দিয়ে যাচ্ছি। আপনার ঘরে। যত ইচ্ছা টেলিফোন করুন।টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও ফিরোজদের বাড়ির কাউকে ধরা গেল না। হয় টেলিফোন নষ্ট, কিংবা রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না। আশ্চর্য ব্যাপার! বাড়িওয়ালা করিম সাহেবকে টেলিফোন করলেন। করিম সাহেব জেগে ছিলেন এবং তিনি জানালেন হানিফা তাঁর বাসাতেই আছে। ঘুমুচ্ছে।
মিসির আলি মোমবাতি জ্বালিয়ে গেষ্টরুমে বসে রইলেন একা-একা! এখনো ইলেকট্রসিটি আসে নি। বাজ পড়ে কোনো ট্রান্সফরমার পুড়েটুড়ে গেছে হয়তো। কেউ ঠিক করবার চেষ্টা করছে না। এ দেশে কেউ কোনো কিছু ঠিক করবার জন্যে ব্যস্ত নয়। শহর অন্ধকারে ডুবে আছে তো কী হয়েছে? থাকুক ডুবে দুষ্ট লোকেরা অন্ধকারে বেরিয়ে আসবে? আসুক বেরিয়ে! আমরা কেউ কারো জন্যে কোনো মমতা দেখাব না। মমতা এ-যুগের জিনিস নয়।কিন্তু সত্যি কি নয়? মমতা কি কেউ-কেউ দেখাচ্ছে না? নীলু। যে তাঁকে আটকে রাখল, তার পেছনে কি মমতা কাজ করছে না?সে কেন তাঁকে এই মমতোটা দেখাচ্ছে? কেন, কেন? তাঁর ভুরু কুঞ্চিত হল। কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। জ্বর আসছে নাকি?
তিনি আবার সিগারেট ধরালেন। প্যাকেট শূন্য হয়ে আসছে। রাত কাটবে কী করে? এ বাড়িতে এখনও কোনো কাজের লোক তাঁর চোখে পড়ে নি, যাকে সিগারেট আনার জন্যে অনুরোধ করা যায়।স্যার, আপনার চা।নীলু এসে দাঁড়িয়েছে। মোমবাতির আলোয় কী সুন্দর লাগছে তাকে! মিসির আলি বিৱত স্বরে বললেন, চা তো চাই নি।রান্না হতে দেরি হবে। চা খেয়ে খিদেটা চেপে রাখার ব্যবস্থা করুন।তিনি চায়ের পেয়ালা হাতে নিলেন, এবং নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, তুমি আমার নিরাপত্তার জন্যে হঠাৎ এত ব্যস্ত হলে কেন?নীলু মৃদু হেসে বলল, এই প্রশ্নের জবাব এখন দেব না। একদিন নিজেই বুঝতে পারবেন। চায়ে চিনি হয়েছে কি না তাড়াতাড়ি দেখুন। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।হয়েছে।
নীলু। নিঃশব্দে চলে গেল! মিসির আলির হঠাৎ মনে হল, তিনি চাঁপা ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন। হালকা সুবাস, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা গাঢ় হল। তিনি ঘরের ভেতর ফিসফিস কথা শুনলেন। কে কথা বলছে? দমকা বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল, এবং তিনি স্পষ্ট শুনলেন, মাল পরে হেঁটে যাওয়ার মতো কে যেন তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন। এ-সব মনের ভুল। এ জগতে কোনো রহস্য নেই। আশেপাশে নিশ্চয়ই কোনো চাঁপা ফুলের গাছ আছে। গন্ধ আসছে সেখান থেকেই।
কিন্তু তবু তাঁর মনে হচ্ছে, দরজার ওপাশে পর্দার আড়ালে কেউ-একজন দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। কে সে? অন্য ভুবনের কেউ? নাকি অবচেতন মনে তার জন্মঃ পৃথিবীর সমস্ত অশরীরীর জন্মই কি অবচেতন মনে নয়? অবচেতন মন জিনিসটির অবস্থান কোথায়? মস্তিষ্কের নিউরোনে? নিউরোনের বৈদ্যুতিক আবেশই কি আমাদের নানান রকম মায়া দেখাচ্ছে?তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। পর্দাটি খুব নড়ছে। যেন কেউ পর্দা নাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে।
তিনি দেয়াশলাই জ্বললেন। আলো আসুক। আলোর স্পর্শে সব মায়া কেটে যাক। তিনি যেন নিজেকে সাহস দেবার জন্যেই বললেন, এ পৃথিবীতে রহস্যেরর কোনো স্থান নেই।সন্ধ্যাবেলা ওসমান সাহেব নিজে গিয়ে পরীক্ষা করলেন, গেট বন্ধ করা হয়েছে কি না। তালা টেনে- টেনে দেখলেন। দারোয়ানকে বললেন, ভোর হবার আগে গেট খুলবে না। কেউ ঢুকতে চাইলে বলবে, বাড়িতে কেউ নেই।জ্বি আচ্ছা।গেটের তালার চাবি কাউকে দেবে না। এমন কি ফিরোজ যদি চায়, তাকেও দেবে না।জি আচ্ছা।রাতটা মোটামুটি সজাগ কাটাবে। কোনো শব্দটব্দ হলে বের হয়ে দেখবে কী ব্যাপার।
জ্বি আচ্ছা! ওসমান সাহেব চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকলেন। ফরিদার সঙ্গে তাঁর দেখা হল, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো কথা হল না। দু জন এমন ভাব করছেন, যেন কেউ কাউকে চেনেন না। অনিদ্রাজনিত কারণে ফরিদার চোখ লাল। তিনি বসে আছেন মূর্তির মতো। ওসমান সাহেব তাঁর সামনের চেয়ারটাতে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থেকে মৃদু স্বরে বললেন, ফিরোজ কেমন আছে? ফরিদা জবাব দিলেন না।ওসমান সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। কানো যায় নি? ফরিদা কোনো সাড়াশব্দ করলেন না। ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন। ওসমান সাহেব চাপা স্বরে বললেন, কথার জবাব দাও। ফিরোজ কেমন আছে? ভালো।ভালো মানেটা কী? গুছিয়ে বল।
গুছিয়ে বলতে পারব না। তুমি দেখে এস। আর শোন, আমার সঙ্গে এ রকম তেজিতে কথা বলবে না।ফরিদা উঠে গেলেন। রওনা হলেন ফিরোজের ঘরের দিকে। ক্রুদ্ধ আওয়াজ আসছে সে-ঘর থেকে চাপা আওয়াজ। কোনো মানুষের কণ্ঠ থেকে এ-ধরনের আওয়াজ হওয়া সম্ভব নয়। যে এমন আওয়াজ করছে, সে মানুষ হতে পারে না। ফরিদাঁর গা কাঁপতে লাগল। কী হচ্ছে এ-সব। তিনি কি এগিয়ে যাবেন, না ফিরে আসবেন? এগিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা করছে না, কিন্তু তিনি গেলেন।কাছাকাছি যাওয়ামাত্র ক্রুদ্ধ গর্জন থেমে গেল। তিনি দেখলেন, ফিরোজ বেশ ভালোমানুষের মতো চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। হাতে একটি বই। সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। ফরিদা বললেন, কেমন আছিস তুই? ভালো। তুমি কেমন আছ মা? ফরিদার চোখে পানি এসে গেল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে এই প্রথম ফিরোজ এমন স্বরে কথা বলল।
ফিরোজ, তুই আমাকে চিনতে পারছিস তো?
চিনতে পারব না কেন? কী বলছি তুমি।
গত দু দিন তো চিনতে পারিস নি।
তোমারও তো আমাকে চিনতে পার নি।
আমরা চিনতে পারব না কেন? না, চিনতে পায় নি। চিনতে পারলে নিজের ছেলেকে তালাবদ্ধ করে রাখতে না। তোমরা বিশাল একটা তালা দিয়েছ। হা হা হা।ফরিদা কথা ঘোরাবার জন্যে বললেন, কিছু খাবি ফিরোজ? হ্যাঁ, খাব। কিন্তু মা, টেবিলে খাবার দেবে। তালা খুলে ফেলবে। আমি খাবার ঘরে টেবিল-চেয়ারে বসে খাব।ফরিদা কোনো উত্তর দিলেন না। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফিরোজ যা বলছে তা সম্ভব নয়। তালা খুলে তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।কি মা, কথা বলছ না যে? তালা খুলবে না? ফরিদা জবাব দিলেন না।কিন্তু মা তালাবন্ধ করে কাউকে আটকে রাখা ঠিক না। খুব অন্যায়। অন্যায় নয়? হা, অন্যায়।বেশ, তালা খোল।
ফিরোজ উঠে দাঁড়াল। তার কোলের ওপর রাখা বইটি মেঝেতে পড়ে গেল, ফিরোজ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সে এগিয়ে এসে জানালার শিক ধরে দাঁড়াল। ফরিদা জানালার পাশ থেকে একটু দূরে সরে গেলেন।দূরে চলে গেলে যে মা? ভয় লাগছে? হা হা হা। খুব ভয় লাগছে, না? ফিরোজ জানালার শিক ধরে বাঁকাতে লাগল।ফরিদা ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, এ-রকম করছিস কেন?লোহার শিকগুলো কেমন শক্ত, তাই দেখছি।এ রকম কারিস না বাবা।তালা খুলে দাও, এ রকম করব না। আমি চিড়িয়াখানার জন্তু নাই মা, যে, আমাকে খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখবে। যাও, বাবার কাছে যাও। চাবি নিয়ে এস। বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে আসছে। আমি খোলা মাঠে খানিকক্ষণ হাঁটব। যাও, যা করতে বলছি কর।
ফরিদা বসার ঘরের দিকে এগুলেন। ফিরোজ জানালার শিক ধরে ঝাঁকাচ্ছে। তার মুখ হাসি-হাসি। যেন শিক ঝাঁকানো খুব-একটা মজার ব্যাপার। আনন্দের একটা খেলা। খুব ছোটবেলায় ফিরোজ এ-রকম করত। জানালায় উঠেশিক ধরে ঝাঁকাত।ওসমান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। কঠিন স্বরে বললেন, কী পাগলের মতো কথা বলছ। তালা খুলব মানে? কী হয়েছে, তুমি জান না? ফরিদা চুপ করে রইলেন।একটা ছেলে মারা গেছে। তার পরেও তুমি বলছি তালা খুলব।তালা দিয়েই-বা লাভ কী হচ্ছে? ঐ রাতেও তো তালাবন্ধ ছিল। ছিল না?
ওসমান সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। হ্যাঁ, ঐ রাতে তালাবন্ধ ছিল। এবং ভোরবেলা ঘর তালাবন্ধই পাওয়া গেছে।ফরিদা বললেন, ঐ ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে ফিরোজের কোনো সম্পর্ক নেই। ফিরোজ ঘরেই ছিল।ঘরে থাকলেই ভালো।ফরিদা স্বামীর পাশে বসলেন। তাঁর মুখ শান্ত। তাঁর চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ ওসমান সাহেব বললেন, তুমি কিছু বলবে? হ্যাঁ।বলে ফেল। এভাবে তাকিয়ে থেক না।ফিরোজ প্রসঙ্গে তুমি যে ডিসিসন নিয়েছ, আমার মনে হয় তা ঠিক নয়। তুমি কতদিন তাকে তালাবন্ধ করে রাখবে? ওরা চিকিৎসা করাও। মিসির আলিকেই-বা আসতে দিচ্ছ না কেন?
ঐ ছেলেটির প্রসঙ্গ চাপা না-পড়ার আগে আমি কাউকে এ-বাড়িতে আসতে দেব না। উনি টেলিফোন করলে বলবে।–ফিরোজ মামার বাড়ি গেছে।এতে ফিরোজের অসুখ বাড়তেই থাকবে।বাড়ুক। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, তোমার ছেলেকে ওরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিক। চাও? না, চাই না।তাহলে চুপ করে থাক। একটা তালা আছে, আরেকটা তালা লাগাও।ফিরোজকে তুমি শুধু-শুধু সন্দেহ করছি। তালাবন্ধ ঘর থেকে সে কীভাবে বের হবে?
তা জানি না। কিন্তু সে বের হয়েছে, এটা আমি যেমন জানি–তুমিও তেমন জান। এই নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তুমি অন্য ঘরে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।ঝন ঝন শব্দ হচ্ছে ফিরোজের ঘরে। সে প্ৰচণ্ড শব্দে জানালা ঝাঁকাচ্ছে।ফরিদা নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলেন। ওসমান সাহেব বের হয়ে এসে কঠিন স্বরে ফিরোজকে বললেন, এ-রকম করছিস কেন? স্টপ ইট।ফিরোজ হাসিমুখে বলল, রাগ করছ, কেন বাবা?
ওসমান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
দরজা খুলে দাও বাবা। আমি খাবার ঘরে বসে ভাত খাব খিদে লেগেছে। কি, খুলবে না?
লোহার রডটা আমার কাছে দে, আমি তালা খুলে দিচ্ছি।
না বাবা, ওটা সম্ভব নয়। লোহার রাডটা দেয়া যাবে না।
কেন দেয়া যায় না?
ও রাগ করবে।
কে রাগ করবে?
নাম বললে চিনবে? শুধু-শুধু জিজ্ঞেস করছ, কেন? তালা খুলবে কি খুলবে না? ওসমান সাহেব জবাব না দিয়ে চলে এলেন। ফিরোজ জানালা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে খুব হাসতে লাগল।থার্ড ইয়ার ফাইনালের ডেট দিয়ে দিয়েছে।মেডিকেলের ছাত্রদের কারোর দম ফেলার সময় নেই। ক্লাস এখন সাসপেণ্ডেড। আজমল ঠিক করে রেখেছে, সে এখন থেকে নাশতা খেয়ে পড়তে বসবে এবং একটানা পড়বে লাঞ্চ টাইম পর্যন্ত। এক ঘন্টার ব্রেক নেবে লাঞ্চে, তারপর আবার পড়া। তা ছাড়া পাস করার উপায় নেই। নানান দিক দিয়ে খুব ক্ষতি হয়েছে এবছর। প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো ঝামেলায় পড়া হচ্ছে না। এ-রকম চললে পরীক্ষা দেয়া হবে না। এবার পরীক্ষায় না বসলে ডাক্তারি পড়া বন্ধ করে দিতে হবে। খরচ চালিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই। গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে দিলে হত, কিন্তু মা বেঁচে থাকতে তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিক্রি করেও লাভ হবে না কিছু ভাঙা রাজপ্রাসাদ কে কিনবে? কার এত গরজ?
আজমল বই নিয়ে বসেই উঠে পড়ল——জানোলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মিসির আলি ঢুকছেন। তার খুব ইচ্ছা হতে লাগল, বইপত্র নিয়ে অন্য কোনো ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ খুঁজেটুজে তিনি চলে যাবেন। কিন্তু ভদ্রলোকের যা স্বভাব-চরিত্র, তিনি আবার আসবেন! আবার আসবেন! অসহ্য! কেন জানি আজমল তাকে সহ্য করতে পারে না। কেন সহ্য করতে পারে না–এ নিয়েও সে ভেবেছে, কিছু বের করতে পারে নি। লোকটি ভালোমানুষ ধরনের, তবে অসম্ভব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান কেউ ভালোমানুষ হতে পারে না। ভালোমানুষেরা বোকাসোকা ধরনের হয়।ভেতরে আসব? আজমল বিরক্তি গোপন করে বলল, আসুন।আমি পরশুও এক বার এসেছিলাম। তোমার রুমমেটকে বলে গিয়েছিলাম, আজ আসব। সে তোমাকে কিছু বলে নি?
জ্বি-না, বলে নি। ভুলে গেছে বোধহয়। বসুন।মিসির আলি বসাতে-বসতে বললেন, অনেক দিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা। এর মধ্যে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। জান বোধহয়।জ্বি, জানি। নাজ চিঠি লিখেছিল।খুব যন্ত্রণায় ফেলেছিলাম। ওদের। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।আজমল কিছু বলল না।মিসির আলি বললেন, বেশিক্ষণ তোমাকে বিরক্ত করব না। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করতে এসেছি।জিজ্ঞেস করুন। তোমাদের বাড়িতে একটা ঘর আছে, যেখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কিছু ছবিটবি আছে। তুমি কি সেই ঘরে ফিরোজকে নিয়ে গিয়েছিলে? জ্বি হ্যাঁ, নিয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু ঐ ঘর তো তালাবন্ধ। ওর চাবি থাকে নাজনীনের কাছে। সে তো বলল, ও ঘর খোলা হয় নি।আমার কাছে একটা চাবি আছে, ও জানে না।খালিগায়ে এক জনের ছবি আছে। ঐ ছবিটা কি ফিরোজকে দেখিয়েছ?
সব ছবিই দেখিয়েছি।আমি এই বিশেষ ছবিটি প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি। শুনেছি একে ক্ষিপ্ত প্ৰজারা লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এটা কি সত্যি?জ্বি, সত্যি। শাবল দিয়ে পিটিয়ে মারে।এই গল্পটি কি তুমি ফিরোজের সঙ্গে করেছ? জ্বি-না, করিনি।অন্য কেউ কি করেছে বলে তোমার ধারণা? মনে হয় না। গল্প করে বেড়াবার মতো কোনো ঘটনা এটা না।মিসির আলি উঠে পড়লেন। আজমল বলল, আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না?
না। উঠি এখন। তুমি পড়াশোনা করছিলে, কর। আর ডিসটার্ব করব না।আজমল তাঁকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। মিসির আলি বললেন, নাজনীন মেয়েটি বড় ভালো। ওকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। চমৎকার মেয়ে।আজমল কিছু বলল না।মিসির আলি বললেন, নাজনীন আমাকে বলেছে শীতের সময় একবার যেতে। আমি কথা দিয়েছি, যাব। এ-শীতেই যাব। যাই আজমল, আর আসতে হবে না।তিনি মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন। ফিরোজ ছবিটা দেখেছে। জট খুলতে শুরু করছে। এই ছবির ছাপ পড়েছে ফিরোজের চেতনায়। এবং মিসির আলির ধারণা, লোকটির মৃত্যুসংক্রান্ত গল্পটিও সে শুনেছে। লোহার রড নিয়ে তার খালিগায়ে বের হবার রহস্যটি হচ্ছে ছবিতে এবং গল্পটিতে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিসির আলি গ্রাহ্য করলেন না। বরং বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে এগিয়ে যেতে তাঁর ভালোই লাগছে। ফিরোজের অসুখের পেছনের কারণগুলো দাঁড় করাতে চেষ্টা করতে লাগলেন। অনেকগুলো ঘটনাকে একসঙ্গে মেলাতে হবে। ঘটনাগুলো এ-রকম—
(১) অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল। মেয়েটির পলিও। এই ঘটনাটি তাকে অভিভূত করল।
(২) মেয়েটি তাকে আহত করল, সে কড়া গলায় বলল-আমার হাত ছাডুন।
(৩) ফিরোজ খালিগায়ের লোকটির ছবি দেখল, এবং খুব সম্ভব তার মৃত্যুবিষয়ক গল্পটিও শুনল।
(৪) রাতে তার প্রচণ্ড জ্বল্প হল। জ্বরের ঘোরে ঐ লোকটির ছবি বারবার মনে হল।
(৫) সে নির্জন নদীর পাড় ধরে এক-একা হাঁটতে গেল, তখুনি একটি হেলুসিনেশন হল।
মিসির আলি বৃষ্টিতে নেয়ে গেছেন। রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে। ঢালাও বর্ষণ উপেক্ষা করে কেউ এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটে না।সাইদুর রহমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনার কী হয়েছে।মিসির আলি বললেন, শরীরটা খারাপ স্যার। শরীর তো আপনার সবসময়ই খারাপ। এর বাইরে কিছু হয়েছে কি না বলেন। আপনাকে হ্যাগার্ডের মতো দেখাচ্ছে!গত পরশু রাতে কে যেন তালা ভেঙে আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করেছে।আপনি বাসায় ছিলেন না?
আমি তো স্যার প্রথমেই আপনাকে বলেছি তালা ভেঙে ঢুকেছে। কাজেই আমার ঘরে থাকার প্রশ্ন ওঠে না।সাইদুর রহমান সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।মিসির আলি বললেন, আমি ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছি। দিন দশেকের ছুটির আমার খুব দরকার।রহমান সাহেব মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস-টলাস তো এমনিতেও হয় না। এর মধ্যে আপনারা ছুটি নিলে তো অচল অবস্থা। এর চেয়ে আসুন, সবাই মিলে ইউনিভার্সিটি তালাবন্ধ করে চলে যাই, কী বলেন? মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, আপনি কি স্যার আমার সঙ্গে রসিকতা করতে চেষ্টা করছেন? রসিকতা করব কেন? গত দু বছরে আমি কোনো ছুটি নিই নি। এখন নিতান্ত প্রয়োজনে চাচ্ছি। দিতে না চাইলে দেবেন না। আপনার নিজের কী অবস্থা। এ-বছরে আপনি কি কোনো দুটি নেন নি?
Read more