নিষাদ পর্ব – ৬ হুমায়ূন আহমেদ

নিষাদ পর্ব – ৬

বিনু বলল, বাবা, তুমি ঐ ভদ্রলোককে আর তো আনলে না।নিজাম সাহেব বললেন, মুনিরের কথা বলছিস? হ্যাঁ। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় না? হবে না কেন? রোজই তো হচ্ছে।আজ একবার তাঁকে নিয়ে আসতে পারবে? কেন? একটা দরকার আছে বাবা।কি দরকার? আছে একটা দরকার। তুমি অবশ্যি আজ তাঁকে সঙ্গে করে আনবে।রাতে খেতে বলব? হুঁ, বলতে পার।

বিনুর ভাবভঙ্গি নিজাম সাহেব ঠিক বুঝতে পারলেন না। ক দিন আগেই সে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করেছে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে—আগে বিনু তাঁর ঘরে এল। মশারি গুঁজে দিল। বাতাস যাতে ঢুকতে পারে সে জন্যে জানালার পর্দা উঠিয়ে দিল। নিজাম সাহেব বললেন, কিছু বলবি?…না বাবা, কিছু বলব না।

তোকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাস।না, চাই না। তুমি যদি কিছু বলতে চাও, বল। আমি শুনব।আমি আবার কী বলব? ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে।তাহলে ঘুমাও। বাতি নিভিয়ে দিই? দে।বিনু বাতি নিভিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই সে মৃদু স্বরে বলল, আমার যে বিয়ে তুমি ঠিক করেছ, ওতে আমার মত নেই।

বিয়ে ভেঙে দাও! কি বললি?……..বিনু উত্তর দেবার জন্যে দাঁড়াল না, ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে এল। নিজাম সাহেব পেছনে-পেছনে উঠে এলেন। বিনু ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। তিনি বেশ ক বার ডাকলেন। বিনু সাড়া দিল না।ভোরবেলায় তিনি বিনুকে খুব স্বাভাবিক দেখলেন। যেন কিছুই হয় নি। আগের মতো হাসিখুশি। তাঁর বুক থেকে পাথর নেমে গেল। তাঁর মনে হল বিনুযা করেছে, তা সাময়িক অস্থিরতার কারণে। অস্থিরতা কেটে গেছে।

বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বরপক্ষীয় লোকজন বিয়ের কার্ড ছাপাতে দিয়েছে। এ সময় নতুন কোনো ঝামেলা সৃষ্টি না-হলেই ভালো। বিনু তেমন ময়ে নয়। অবুঝের মতো কিছু করবে বলে মনে হয় না। তবু নিজাম সাহেবের ভয় না। চমৎকার ছেলে পাওয়া গেছে। ডাক্তার স্বভাব-চরিত্র ভালো।–নাম-ভদ্র ছেলে। এই বিয়ে ভেঙে গেলে এ-রকম আরেকটি ছেলে পাওয়া মুশকিল হবে।

সন্ধ্যাবেল নিজাম সাহেব এক-একা ফিরলেন। বিনু কিছু বলল না। নিজাম সাহেব জামা খুলতে-খুলতে নিজ থেকেই বললেন, মুনির আজ আসেনিরে মা! দেখি, আগামীকাল যদি আসে, নিয়ে আসব।বিনুচুপ করে রইল। রাতে খেতে বসে নিজাম সাহেব দেখলেন, অনেক আয়োজন। তিনি শুধু মাছ কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে মুরগিও আছে।মুরগি কোথায় পেলি রে?আকবরের মাকে দিয়ে আনিয়েছি।

ও এসেছে নাকি?…….হুঁ।যাক, ভালো হয়েছে, এখন আর এক-একা থাকতে হবে না।হ্যাঁ, ভালোই হয়েছে।অবশ্যি কয়েকটা দিন। তোর খালারাও তো চলে আসবে। বিয়েশাদির ব্যাপার, ওদেরই তো এখন দায়িত্ব।কথাটা বলে নিজাম সাহেব আড়চোখে তাকালেন। মেয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলেন। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না।তুইও বসে যা। একসঙ্গে খাই।আমার খিদে নেই বাবা, তুমি খাও।

খিদে নেই কেন? শরীর খারাপ নাকি?…….না, শরীর ঠিকই আছে।রাতে বিনু বাবার মশারি খাটাতে এসে শান্ত গলায় বলল, কাল যদি ঐ ভদ্রলোক আসেন, তাহলে তাকে মনে করে নিয়ে এসো।নিজাম সাহেব বিস্ময় গোপন করে বললেন,  কোনো দরকার আছে? না, এম্নি।আচ্ছা, বলব। পরদিনও মুনির অফিসে এল না। নিজাম সাহেব এক-একা ফিরলেন। বিনু বলল, উনি আজও অফিসে আসেন নি, তাই না? হুঁ, তাই।ওরা ঠিকানা জানা আছে? না।

বিনু আর কিছু বলল না। নিজাম সাহেব রাতে খেতে বসে দেখলেন, আজও অনেক আয়োজন। খাবার শেষে পায়েসও আছে। তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। ছেলেটাকে এ বাড়িতে আনা বোধহয় ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। ভুলটা কোথায়, তা তিনি ধরতে পারছেন না।

বিনু! বল বাবা।আমাদেরও তো কার্ডটার্ড ছাপাতে হয়।ছাপাতে হলে ছাপাও।না, মানে …ওই দিন তুই হঠাৎ বললি-মানে ওই বিয়ের ব্যাপারটা, মানে… পায়েস নাও বাবা। পায়েসটা ভালো হবার কথা।খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। রোজ এ-রকম খাওয়া হলে ব্লাড প্রেসার হয়ে যাবে।তোমার কিছুই হবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে খাও তো।

নিজাম সাহেবের বুকের পাথর নেমে গেল। তিনি তার পুরনো, পরিচিত মেয়েকে খুঁজে পেলেন। এই লক্ষ্মী মেয়ে সারাজীবন কাউকে যন্ত্রণা দেয় নি, এখনো দেবে না।রাতে মশারি গুঁজতে এসে বিনু চেয়ার টেনে পাশে বসল। নিজাম সাহেব নিদারুণ আতঙ্ক বোধ করলেন। একবার ভাবলেন–ঘুমিয়ে পড়েছেন এমন ভাব করবেন, ডাকলে সাড়া দেবেন না।বাবা।কি? আগামীকাল তুমি যে করেই হোক, ভদ্রলোকের ঠিকানা বের করবে।

কেন?……..আমি মিসির আলি নামে এক জন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই! সে আবার কে? তুমি চিনবে না, উনি এক বার এ-বাড়িতে এসেছিলেন। মুনির সাহেবকে চেনেন।তুই কি বলছিস, আমি তো কিছুই বুঝছি না।আমিও বুঝতে পারছি না। বাবা। উনি একটা অদ্ভুত ছবি নিয়ে এসেছিলেন। মনে হয় আমার বিয়ের ছবি।কি আবোল-তাবোল বকছিস!

তোর বিয়ের ছবি মানে? তোর বিয়েটা হল কবে?…….নিজাম সাহেব উত্তেজনায় মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর ভ্রূকুঞ্চিত। কপালের চামড়ায় গভীর ভাঁজ।ব্যাপারটা কী, আমাকে গুছিয়ে বল।আমি জানলে তো গুছিয়ে বলব। আমাকে জানতে হবে না? আমার মনে হয়। উনি জানেন।কি বারবার উনিী-উনি করছিস, উনিটা কে? মিসির আলি সাহেব।কী মুশকিল, মিসির আলিটা কে? একবার তো বলেছি বাবা, মুনির সাহেবের বন্ধু।

সে-রাতে নিজাম সাহেবের ভালো ঘুম হল না। বারবার জেগে উঠলেন। শেষরাতের দিকে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন প্ৰকাণ্ড একটা মাকড়সার পেটের সঙ্গে তিনি সেঁটে রয়েছেন। মাকড়সাটা তাঁকে পেটে নিয়ে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। ঐ মাকড়সার পেছনে-পেছনে আরো কয়েকটা মাকড়সা তাঁর দখল নেবার চেষ্টা করছে। বড় মাকড়সাটার সঙ্গে পারছে না। মাকড়সাটার গা থেকে পিচ্ছিল কি একটা বের হচ্ছে। তাঁর গা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ঘুমের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কোঁদে উঠলেন। কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন!

দরজায় খুব আলতো করে কে যেন হাত রাখল। মিসির আলি কেরোসিনের চুলোয় চা বসিয়েছেন। সেখান থেকেই বললেন, কে? কোনোরকম জবাব পাওয়া গেল না। কেউ দরজার কড়াও নাড়ছে না। মিসির আলি উঠে এলেন। দরজার ও-পাশে একজন— কেউ আছে কড়া না-নাড়লেও তা বোঝা যাচ্ছে। মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় খুব দুর্বল নয়, অনেক কিছুই সে ধরতে পারে।

হয়তো কোনো ভিখিরি। কড়া নাড়তে সঙ্কোচ বোধ করছে, কিংবা এমন কেউ, যে ঠিকানা গুলিয়ে ফেলেছে। মিসির আলি দরজা খুলে চমকে উঠলেন–নীলু দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরেই সে নানান জায়গায় ঘুরছে। তার শান্তমুখে শ্ৰান্তির ছায়া! কেমন আছ নীলু? ভালো! ভেতরে অসব? কী আশ্চৰ্য কেন আসবে না? আমি ভাবছিলাম, আপনি আমাকে ঘরেই ঢুকতে দেবেন না।

এ-রকম মনে করার কোনো কারণ আছে?…..হ্যাঁ, আছে। আপনি আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঠিকানা বদল করেছেন। ইউনিভার্সিটিতেও যান না।ইউনিভার্সিটিতে যাই না, কারণ আমি এক বছরের ছুটি নিয়েছি। এস, ভেতরে এসে বস।নীলু ভেতরে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নিচু গলায় বলল, আর কেউ নেই? আর কে থাকবে? তুমি কি ভেবেছিলে বিয়ে করে, সংসার পেতে বসেছি? না, তা ভাবি নি। আপনি গৃহী মানুষ নন।

তাহলে আমি কি সন্ন্যাসী? না, তাও না।নীলু, তুমি আরাম করে বাস।–আমি চা বানাচ্ছিলাম। চা শেষ করে তোমার সঙ্গে কথা বলব! চা-টা আমি বানিয়ে দিই? …….দাও! সব হাতের কাছেই আছে-হাত বাড়ালেই পাবে।নীলু শীতল গলায় বলল, হাতের কাছে থাকলেই হাত বাড়ালে সব কিছু পাওয়া না।মিসির আলি এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় কথার পিঠে কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না।

কিছুতেই সহজ হতে পারেন না, অথচ তার সঙ্গেই সম্পর্কটা সবচে সহজ হওয়া উচিত ছিল।নীলু চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আপনি আমাকে কিছু না বলে বাড়িটা বদলালেন কেন?নানান ঝামেলায় বলা হয়ে ওঠে নি।বাজে কথা বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করেই এটা করেছেন। এবং কেন করেছেন তাও জানি।কেন করেছি? লোকলজ্জার ভয়ে। আমার মতো একটা অল্পবয়সী মেয়ে আপনার মতো আধাবুড়োর পেছনে দিন-রাত ঘুরঘুর করে, এটা আপনার ভালো লাগে নি। সারাক্ষণ ভেবেছেন, লোকে না-জানি কি বলছে।

লোকে কি বলছে না-বলছে, তা নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাই না।তাও অবশ্যি ঠিক। আপনি মাথা ঘামান বড়-বড় বিষয় নিয়ে।মিসির আলি আলোচনার মোড় ঘোরাবার জন্যে বললেন, ইন্টারেষ্টিং একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছি, বুঝলে নীলু। একটা মানুষের অনেক কটা জীবন থাকার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নীলু বলল, এসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না।

ভালো না লাগলেও শোন—এই যে তুমি এসেছ আমার কাছে, এটা ঘটছে এই জীবনে। অন্য এক জীবনে আমি হয়তো গিয়েছি তোমার কাছে। সেই জীবনে আমি হয়তো তোমার পেছনে-পেছনে ঘুরছি, আর তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ।আপনি কি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন? আমি কথার কথা বলছি নীলু।নীলু থমথমে গলায় বলল, আপনার ঠিকানা বের করার জন্যে আমি যে কী কষ্ট করেছি, তা যদি আপনি জানতেন … । জানলে কী হত?

না-কী আর হত? কিছুই হত না।নীলুর চোখ ছলছল করছে। মিসির আলি ভয় করছেন, হয়তো কেঁদে ফেলবে। তবে এই মেয়েটি শক্ত মেয়ে, সহজে কাঁদবে না। নিজেকে সামলে নেবে।হ্যাঁ, তাই হচ্ছে। নীলু নিজেকে সামলে নিচ্ছে। সে সহজ গলায় বলল, চায়ে চিনি হয়েছে তো? মিসির আলি হাসলেন। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে।বিনু অবাক হয়ে বলল, আপনি? মুনির অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল।

নিচু গলায় বলল, স্যার কি বাসায় নেই?…….বাসায় থাকবেন কেন? এখন তো ওঁর অফিসে থাকবায় কথা। তাই না? ও, আচ্ছা–হ্যাঁ।আপনি অফিসে যান নি? না। আমি তাহলে যাই।বসতে চাইলে বসুন! মুনির বারান্দায় চেয়ারটায় বসে পড়ে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। টানা টানা গলায় বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম…।

চা খাবেন, না লেবু দিয়ে দিয়ে সরবত বানিয়ে দেব? …..আপনি খুব ক্লান্ত, সেই জন্যে বলছি।না, কিছু লাগবে না।বিনু ভেতরে চলে গেল। আবার ফিরে এল লেবুর সরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে।আমাদের তো ফ্ৰীজ নেই, এই জন্যে খুব ঠাণ্ডা হবে না। গরম সরবত।মুনির হেসে ফেলল। বিনু বলল, আমার মনে হয়, আপনি আমাকে কিছু বলতে এসেছেন। বলে ফেলুন।না, এমনি এসেছি।আপনি এমনি আসেন নি। কি বলতে চান। আপনি বলুন। আমি রাগ করব না।মুনির ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি আপনাকে চিনি।

তা তো চিনবেনই। না-চেনার তো কথা না। আগে একদিন এসেছিলেন। আমার বাবাকে এত ভালো করে চেনেন, আর আমাকে চিনবেন না? তার চেয়েও ভালোভাবে চিনি।তাই নাকি? জ্বি।কীভাবে বলুন তো? আপনি যখন খুব ছোট, তখন কী কী করতেন সব আমি বলতে পারব।বেশ তো, দু-একটা বলুন, আমি শুনি।আমি মীনার কথা জানি। মীনা আপনার খুব বন্ধু ছিল না? কে বলেছে আপনাকে মীনার কথা? মুনির চুপ করে রইল।

বলুন, কে মীনার কথা আপনাকে বলেছে?………মুনির একবার ভাবল বলে ফেলে–বিনু, ও সব কথা আমি তোমার কাছ থেকেই শুনেছি। এক সময় তুমিই আমাকে বলেছ। বিয়ের পর রাত জেগে তুমি কত গল্প করতে! কিন্তু এই মেয়েটিকে এ-সব বলা অর্থহীন। সে কিছুই বুঝবে না।কি ব্যাপার, চুপ করে আছেন? মুনির নিচু স্বরে বলল, আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো আমাকে দেখে কি আপনার খুব চেনা-চেনা মনে হয় নি? না।

চেনা-চেনা মনে হবে কেন? চেনা মনে হবার কি কোনো কারণ আছে?…..জ্বি-না। আচ্ছা, আমি উঠি।মুনির উঠে দাঁড়াল। বিনু বলল, আপনি আর এ-রকম এক-একা এ বাড়িতে আসবেন না! জ্বি আচ্ছা।যদি কখনো আসতে চান, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন।ভয় নেই, আমি আর আসব না।আপনি আপনার এক বন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে। এ-সব করবেন না। বাবা আপনাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন।

আপনার কাণ্ডকারখানা শুনলে বাবা মনে খুব কষ্ট পাবেন! আমি নিজে বাবাকে এ—সব কখনো বলব না। আপনিও বলবেন না।মুনির হেসে ফেলল। হঠাৎ তার হাসি এসে গেল, কারণ বিনূর ভঙ্গিটা তার খুব চেনা। রাগী-রাগী গলায় অনেকক্ষণ কথা বলবার পর, হঠাৎ তার রাগ পড়ে যায়। চোখে পানি এসে যায়। এখনো বিনুর চোখে পানি আসছে।

আসতেই হবে।আপনি হাসছেন কেন?…..হাসছি, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে এত সব কঠিন কথা বলার জন্যে আপনার খুব কষ্ট হবে। আপনি কাঁদতে শুরু করবেন।আপনি বেরিয়ে যান।মুনির বের হয়ে এল। বিনু সত্যি-সত্যি কাঁদতে বসল। তার খুব খারাপ লাগছে।মিসির আলি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি গত কয়েক দিন ধরেই চেষ্টা করছেন তাঁর সেই থিওরি গুছিয়ে ফেলতে পারছেন না। লিখতে গিয়ে সব আরো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে মনে মনে যা ভাবছেন, তা লিখতে পারছেন না।

সারা দুপুর বসে বসে তিনি তাঁর থিওরির পয়েন্টগুলো লিখলেন। সেগুলো কেটে ফেলে আবার লিখলেন। সন্ধ্যাবেলা সব কাগজপত্র ফেলে দিয়ে নতুন খাতা কিনে আনলেন। কলম কিনলেন। তিনি লক্ষ করেছেন, খাতা-কলম বদলে ফেললে মাঝে-মাঝে তারতর করে লেখা এগোয়। তাই হল। রাতের বেলা বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন।

রচনার নাম দিলেন—……..একজীবন : বহুজীবন একটি মানুষের কয়েকটি জীবন থাকে? তাই তো মনে হয়। এক জন শিশু জন্মায়, বড় হয়, মৃত্যু হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনকাল একটি ধারায় প্রবাহিত হয়। সেই ধারায় সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার নানান ঘটনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জীবনের ধারা একটি না হয়ে কি অনেকগুলো হতে পারে না? ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। মনে করি, মুনির নামের একটি ছেলে বড় হচ্ছে শৈশবে তার পিতৃবিয়োগ হল। সেই মুহূর্ত থেকে যদি তাঁর জীবন দুটি ভাগে ভাগ হয়, তাহলে কেমন হয়? একটি ভাগে ছেলেটির পিতৃবিয়োগ হল, অন্য ভাগে হল না।–বাবা বেঁচেই রইলেন। দুটি জীবনই সমানে প্রবাহিত হতে লাগল।

তবু এক জীবনের সঙ্গে অন্য জীবনের কোনো যোগ রইল না। কারণ এই দুটি জগতের মাত্রা ভিন্ন।দুই ভিন্ন মাত্রায় দুটি জীবন প্রবাহিত হচ্ছে। এক জীবনে ছেলেটি সুখী-অন্য জীবনে নয়।এখন এই দুটি জীবনের ব্যাপারটাকে আরো বিস্তৃত করা যাক। ধরা যাক, জীবন দুটি নয়। অসংখ্য, সীমাহীন। প্রকৃতি একটি মানুষের জীবনে যতগুলো ভেরিয়েশন হওয়া সম্ভব, সবগুলোই পরীক্ষা করে দেখছে। সবই সে চালু করেছে।

অসীম ব্যাপারটা এমনই যে, এ-পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্যেই অসীম সংখ্যক জীবনধারা চালু করতে পারে। কারণ অসীম সংখ্যাটির এমনই মাহাত্ম্য যে, সে অসীমসংখ্যক অসীমকেও ধারণ করতে পারে। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট অসীমের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর হিলবার্ট হোটেলের সমস্যায়। এই হোটেলটির সবচে বড়ো গুণ হচ্ছে, হোটেলের প্রতিটি কক্ষ অতিথি দিয়ে পূর্ণ হবার পরও যত খুশি অতিথিকে ঢোকান যায়।

এর জন্যে পুরনো অতিথিদের কোনো অসুবিধে হয় না। কারো কক্ষে দু জন অতিথি ঢোকানোর প্রয়োজন হয় না। এটা সম্ভব হয় অসীম সংখ্যাটির অদ্ভুত গুণাবলীর জন্যে। মানুষ তার প্রচুর জ্ঞান সত্ত্বেও অসীমকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। সবচে সহজ ব্যাখ্যাটি হচ্ছে–অসীম হচ্ছে বিরাট বই, যার শুরুর পাতা এবং শেষের পাতা বলে কিছু নেই।

এখন কথা হচ্ছে, কেন একটি মানুষের জন্যে অসংখ্য জীবনের ব্যবস্থা করবে? প্রকৃতির স্বার্থ কী?…….প্রকৃতির একটি স্বার্থের কথা আমরা কল্পনা করতে পারি, সেটি হচ্ছে।–কৌতূহলের সঙ্গে সে একটি পরীক্ষা চালাচ্ছে। তার চোখের সামনে মানবজীবনের, সেই সঙ্গে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডেরও, অসংখ্য ভেরিয়েশন। প্রতিটিই চলছে স্বাধীনভাবে, একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো যোগ নেই, কারণ প্রতিটিই প্রবাহিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়।প্রকৃতি না বলে ঈশ্বরী শব্দটি ব্যবহার করলে ব্যাপারটা আরো সহজ হয়।

ঈশ্বর নামের কোনো মহাশক্তিধর, যিনি অসীমকে ধারণ করতে পারেন, কারণ তিনি নিজেই অসীম-সেই তিনিই অসীম নিয়ে খেলছেন।কাজেই আমরা দেখছি মুনির নামের ছেলেটির অসংখ্য জীবন। এক জীবনে সে বিনুকে বিয়ে করে, অন্য জীবনে বিনুকে বিয়ে করতে পারে না। এক জীবনে তার এবং বিনুর একটি ছেলে হয়, ছেলেটি চার বছর বয়সে মারা যায়। অন্য জীবনে ছেলেটি বেঁচে থাকে। কত বিচিত্র রকমের পরিবর্তন। এবং প্রতিটি পরিবর্তনকেই প্রকৃতি গভীর আগ্রহে এবং গভীর মমতায় দেখছে।

প্রকৃতির নিয়ম কঠিন এবং ব্যতিক্রমহীন, তবু মাঝে-মাঝে হয়তো কিছু-একটা হয়। সামান্য এদিক-ওদিক হয়। জীবনের এক ধারায় মানুষ প্রকৃতিরই কোনো- এক বিচিত্র কারণে অন্য ধারায় এসে হকচকিয়ে যায়।এ-রকম ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এই মুহূর্তে আমি একটি উদাহরণ দিতে পারি। খুঁজলে নিশ্চয়ই আরো প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে।

উদাহরণটি আমেরিকার আরিজোনা শহরের। আঠার শ চরিশ সালের ঘটনা। ঘটনাটি স্থানীয় মেথডিস্ট চার্চের নথিতে অন্তর্ভুক্ত। বেশ কিছু অনুসন্ধানী দল ঘটনাটি বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা অতীতে করেছে। এই ঘটনা বিশ্বে সংঘটিত অদ্ভুত ঘটনাগুলোর একটি বলে এখনো মনে করা হয়।ডেভিড় ল্যাংম্যান আরিজোনা শহরের এক জন সাধারণ ছুতোর মিস্ত্রী।

ছুতোরের কাজ করে জীবনধারণ করেন। সরল সাধাসিধে মানুষ। তবে অতিরিক্ত মদ্যপানের বদ অত্যাস ছিল। মাঝে-মাঝে পুরো মাতাল হয়ে ঘরে ফিরতেন। স্ত্রী এবং পুত্ৰ-কন্যাদের ওপর অত্যাচার করতেন। নেশা কেটে গেলেই আবার ভালোমানুষ।ভদ্রলোক চল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। যথারীতি তাঁকে কফিনে ঢুকিয়ে গোর দেওয়া হয়। এর প্রায় চার বছর পরের ঘটনা। এক রাতে প্রবল তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটুউঁচু বরফ।

দেখা গেল, এই বরফ ভেঙে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত ডেভিড ল্যাং আসছেন। প্রথমে সবাই ভাবল চোখের ভুল। পরে দেখা গেল-না, চোখের ভুল নয়, আসলেই ডেভিড ল্যাংম্যান। সেই মানুষ, সেই আচার-আচরণ। বী হাতের একটি আঙুল নেই। কপালে গভীর ক্ষতচিহ্ন, তাঁর চোখের দৃষ্টিতে দিশেহারা ভাব। লোকজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? তিনি বললেন, আমি ডেভিড ল্যাংম্যান।তুমি কোথেকে এসেছ? আসব। আবার কোথা থেকে। আমি তো এখানেই ছিলাম। আমি আমার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।

তোমার ছেলেমেয়েদের নাম কি?…….তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের নাম বললেন। কাউন্টির শেরিফ তাঁকে গ্রেফতার করে হাজতখানায় রেখে দিল। খবর পেয়ে ডেভিড় ল্যাংম্যানের স্ত্রী এল দেখতে। বিস্ময়ে তার বাকরোধ হল! ডেভিড ল্যাংম্যান বললেন, আমার কী হয়েছে বল তো, সব কেমন অচেনা লাগছে।

এরা আমাকে হাজতে আটকে রেখেছে? তুমি মারা যাও নি? আমি মারা যাব কোন! এ-সব কী বলছি?তুমি তো মারা গেছ। চার্চ ইয়ার্ডে তোমাকে গোর দেয়া হয়েছে। ডেভিড ল্যাংম্যানের স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ডেভিড ল্যাংম্যানকে তাঁর স্ত্রী-পুত্ররা কেউ গ্রহণ করল না। শহরের সবাই তাঁকে বর্জন করল। তিনি একা একা থাকতেন। রাতে চার্চে ঘুমাতেন।

শেষের দিকে তাঁর মাথারও গণ্ডগোল হল। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বলতেন, আমার কী হয়েছে? আমার কী হয়েছে? তাঁর এই কষ্টের জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। দু বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর ডেভিড ল্যাংম্যান নামেই তাঁর কবর হয়।ঘটনাটি অবিশ্বাস্য! কোনো রকম ব্যাখ্যা এর জন্যে দেয়া যায় না। এ-জাতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনার নজির প্রাচীন উপকথায় প্রচুর আছে।

উত্তর ভারতের উপকথায় মহারাজ উরুনির কথা আছে, যাঁকে বলা হয়েছে দানসাগর। মহারাজ উন্ননি শিকার করতে গিয়ে, গণ্ডারের শিংয়ের আঘাতে নিহত হন। রাজকীয় মর্যাদায় তাঁর দাহ সম্পন্ন করার পরপরই তিনি আবার বন থেকে ফিরে আসেন এবং রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তবে তাঁর চরিত্রের বিরাট পরিবর্তন হয়। তিনি ধর্মকর্ম দানাধ্যানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাজতাণ্ডার দেখতে-দেখতে শূন্য হয়ে যায়।

 

নিষাদ পর্ব – ৭ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *