নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

নীল অপরাজিতা

আমারতাে বিশ্বাসই হয় নাওসি সাহেবকে বলেছি একটা বড় বজরা নৌকা যদি দু এক দিনের জন্যে জোগাড় করতে পারেন। 

উনাকে পেলে কোথায়?” 

‘স্কুল ঘর ঝড়ে উড়ে গেছে শুনে দেখতে গেছেনতখন বললামওসি সাহেব উনার বিশেষ ভক্ত, লেখা পড়েছেন। 

কুয়াতলা থেকে দোতলার ঘর দেখা যায়শওকত সাহেবের ঘরের বাতি নেভানােসেই ঘরের দিকে পিতা এবং কন্যা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। 

শওকত সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন। 

আজো তাঁর খুব ভােরে ঘুম ভেঙ্গেছেঘুম ভেঙ্গেছে পাখির ডাকেপাখির দল যে ভােরবেলা এত হৈ চৈ করে তিনি আগে কল্পনাও করেন নি। কবিরা পাখির ডাক নিয়ে এত মাতামাতি কেন করেন তিনি বুঝতে পারছেন নাতাঁর কাছে যন্ত্রণার মত মনে হচ্ছেতবে রাত কেটে ভাের হবার দৃশ্য অসাধারণশুধু মাত্র এই দৃশ্য দেখার জন্যে রােজ ভােরবেলায় ওঠা যেতে পারে। 

পুষ্প চা নিয়ে ঢুকল। 

শওকত সাহেব বললেন, তুমি কি রােজই এত ভােরে ওঠ, না আমার জন্যে উঠতে হচ্ছে

নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ

পুষ্প এই কথার জবাব দিল না, হাসলমেয়েটি বুদ্ধিমতী – হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে রােজ এত ভােরে ওঠে নামেয়েটি তার বাবার বকবকানির স্বভাব পায় নি এও এক দিক দিয়ে রক্ষাদুজনের কথা শুনতে হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। 

তােমার বাবা কি আছেন না স্কুলে চলে গেছেন? স্কুলে গেছেনআজ সকাল সকাল ফিরবেনহাফস্কুলবস পুষ্প, চা খেতে খেতে তােমার সঙ্গে গল্পকরি। 

বারান্দায় বসার কোন জায়গা নেইএকটি মাত্র চেয়ার সেখানে তিনি বসেআছেন। 

শওকত সাহেব বললেন, টেবিটায় বসআর টেবিলে যদি বসতে অসুবিধা হয় তাহলে ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে এসােপুষ্প টেবিলেই বসলতবে টেবিলটা একটু দূরে সরিয়ে নিল। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ

‘এখন বল তুমি কেমন আছ?ভালদেখে খুব ভাল মনে হচ্ছে নারাতে ঘুম হয়নি তাই না?” 

পুস্প হ্যা সূচক মাথা নাড়লএই মানুষটার দৃষ্টি তীক্ষপুষ্প বলল, রাতে ঘুম হয়নি কি করে বুঝলেন

চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলামরাতে ঘুম না হলে চোখের নীচ একটু কালচে হয়ে যায়তােমার হয়েছেতবে তুমি যদি এত ফর্শা না হতে তাহলে ধরতে পারতাম নাচা খুব ভাল হয়েছে। 

আরেক কাপ দেই? নাভাল হয়েছে বলেই দ্বিতীয় কাপ খাব নাহয়ত দ্বিতীয়টা এত ভাল হবে সেই মন্দ চা খেয়ে প্রথম কাপের আনন্দ মাটি হবেআচ্ছা এখন বল, তুমি আমার কোন লেখা পড়েছ?” 

একটা পড়েছিএকটা? মােটে একটা ?” 

জ্বিআপনি আসবেন যখন কথা হল তখন বাবা নেত্রকোনা থেকে আপনার একটা বই কিনে আনলেন। 

কোন বইটা কিনলেন

বাবা দোকানদারকে বললেন, উনার সবচে কমদামী বই যেটা সেটাই দেনদোকানদার একটা চটি বই দিয়ে দিল প্রথম দিবস, দ্বিতীয় রজনী” 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ

 কমদামী বই হলেও এটা আমার ভাল লেখার মধ্যে একটাএই বই নিয়ে সুন্দর একটা গল্প আছে দাড়াও তােমাকে বলিবৈশাখ মাসের এক তারিখে বই বের হবার কথাপ্রকাশকের দোকানে সকাল থেকে বসে আছিতখনতাে আর আমার এত বই ছিল না ঐটি হচ্ছে দ্বিতীয় বইবই বেরুবে আমার আগ্রহ সীমাহীনবাইরের বই দেয়ার কথা সে আসছে না

দুপুরবেলা প্রকাশক বললেন, আপনি বাসায় চলে যান বই বের হলে আপনাকে বাসায় দিয়ে আসবআমি রাজি হলাম নাএসেছি যখন বই নিয়েই যাববিকেল পর্যন্ত বসে রইলাম, বাইন্ডারের দেখা নেইপ্রকাশক বললেন, আপনি কাজ করুন বাইন্ডারের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি গিয়ে দেখুন কি ব্যাপার। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ

বাইন্ডারকে আওলাদ হােসেন লেনে ধরলামসে সবে মাত্র লেই লাগাচ্ছেআমার খুব মেজাজ খারাপ হলবাইন্ডার বলল, কিছুক্ষণ বসেন একটা কাঁচা বই দিয়ে দেই। 

সেই কিছুক্ষণ মানে চার ঘণ্টাবাসায় ফিরলাম রাত নটার পরবাসায় এসে দেখি রেনুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেতার তখন নমাস চলছেডেলিভারী ডেটের এখনাে অনেক দেরীব্যথা উঠে গেছে আগেইছুটে গেলাম হাসপাতালেস্বাতীর জন্ম হয়ে গেছেসন্ধ্যায় তাকে মার পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছেআমার লজ্জার সীমা রইল নাআমার প্রথম বাচ্চা অথচ আমি পাশে নেইআমার লজ্জা এবং দুঃখ স্বাতী ঠিকই বুঝলআমার লজ্জা ঢাকাজন্যে বলল, কই দেখি তােমার বইবাহ কি সুন্দরবলেই শুধু মাত্র আমাকে খুশী করার জন্যে এই অবস্থায় বইটি পড়তে শুরু করলআমার চোখে পানি এসে গেল। 

পুষ্প বলল, আপনি এত সুন্দর করে গল্পটা বললেন যে আমার চোখেই পানি এসে গেছে। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ

রেনু অনেক বড় ভুল করেনানান ভাবে আমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু রাতের ঘটনার কথা মনে হলেই ওর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই। 

যে মেয়ে রাতে এমন কান্ড করতে পারেন তিনি ভুল করতে পারেন নাতাও অবশ্যি ঠিকএখন তুমি বল, বইটা তােমার কেমন লাগল ?” পুষ্প চুপ করে রইলশওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বইটা কি তােমার ভাল লাগেনি? জ্বিনাভাল না লাগারতাে কথা নাতুমি কি পড়েছু ভাল মত

কেন ভাল লাগল না বলতে পারবে? পারবতাহলে বলতে শুনিআপনি কি আমার কথায় রাগ করছেন

না রাগ করছি নাআমার লেখার বিপক্ষে কঠিন কঠিন কথা আমি সব সময় শুনিসাহিত্যের অধ্যাপকরা বলেন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন, বিদগ্ধ জনেরা বলেন, তােমার মত অল্প বয়স্ক মেয়ে বলবে তা ঠিক ভাবি নিবিশেষ করে যে আমার একটি মাত্র বই পড়েছেএখন তুমি আমাকে বল, কেন ভাল লাগল না। 

 

Read more

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *