আমার কাজ বাকি আছে। বাবু বজরা থেকে নেমে আবার উঠে এল। ‘আসল কথা, বলতে ভুলে গেছি। আপনার চিঠি আসছে। এই যে নেন। একটিমাত্র চিঠি তাও রেনু লিখেনি। লিখেছে স্বাতী।
বাবা,
অনেকদিন তােমাকে দেখি না। তুমি কবে আসবে? তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ? মা বলেছে – পৃথিবীর সবার সঙ্গেই তােমার রাগ। আচ্ছা বাবা পৃথিবী বানান কি ঠিক হয়েছে? মাকে জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবী বানান। মা বলল তােমার যা ইচ্ছা লেখ। আমি কিছু জানি না। বাবা তােমার বই লেখা শেষ হয়েছে? আমার একটা দাঁত পড়েছে। আমি রেখে দিয়েছি – তুমি এলে দেখাব। মার কাছে লেখা। তােমার চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি।
তােমার আদরের মেয়ে, স্বাতী। চিঠিতে কিছুই নেই অথচ শওকত সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে স্বাতীকে কিছু লিখলেন না। লিখলেন রেনুকে।।
স্বাতীর চিঠি পেয়েছি। খামের উপর তােমার হাতের ঠিকানা দেখে ভাবলাম তােমার চিঠি। চিঠি লিখছ না কেন বল তাে? এক সময় তুমি তােমার রাগ এবং অভিমানের কারণগুলি আমাকে বলতে। দীর্ঘ দিন সেই সব বলা বন্ধু করেছ। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। না–কি সুর কখনোই ছিল না, আমরা ভেবে নিয়েছি সুর আছে। একটা সময় ছিল – আমার অর্থবিত্ত ছিল না, খ্যাতি ছিল না, ক্ষমতা ছিল না, লেখার একটা কলম ছিল। আর ছিলে তুমি। তখন প্রায়ই ভাবতাম কোনটি আমার প্রিয় কলমটা না তুমি? আজো আমি ঠিক তেমনি করেই ভাবি কিন্তু তুমি বোধ হয় তা বিশ্বাস কর ।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
তুমি অনেক দূরে সরে গেছ। আমি সেদিন যেখানে ছিলাম আজো সেখানে আছি। ভালবাসা কি সেই সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছে। কাউকে কখনো বলিনি – তােমাকে বলি। আমার ধারণা প্রকৃতি প্রথমে একটি চমৎকার ‘নকশা তৈরী করে। অপূর্ব একটি ডিজাইন। যা জটিল এবং ভয়াবহ রকমের সুন্দর। তারপর সেই ডিজাইনটি কাঁচি দিয়ে কেটে দু‘ভাগ করে। এক ভাগ দেয় একটি পুরুষকে অন্য ভাগ একটি তরুণীকে। পুরুষটি তখন ব্যাকুল হয়ে ডিজাইনের বাকি অংশ খুঁজে বেড়ায়। মেয়েটিও তাই করে। কেউ যখন তার ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখে তখন প্রেমে পড়ে যায়। তারপর দেখা
যায় ডিজাইনটি ভুল। তখন ভয়াবহ হতাশা। আমার মনে হয় প্রকৃতির এটা একটা মজার খেলা। মাঝে মাঝে প্রকৃতি কি করে জান? মূল ডিজাইনের দুই অংশকে কাছাকাছি এনে মজা দেখে, আবার সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতি চায়
এরা একত্র হােক। দুজনে মিলে মূল ডিজাইনটি তৈরী করুক। প্রকৃতির না চাওয়ার কারণ আছে – মূল ডিজাইন তৈরী হওয়া মানে এ্যাবসলিউট বিউটির মুখােমুখি হওয়া। প্রকৃতি মানুষকে তা দিতে রাজি নয়। প্রকৃতির ধারণ মানুষ এখনাে তার জন্যে তৈরী হয় নি। তােমাকে এত সব বলার অর্থ একটিই – আমি সব সময় ভেবেছি তোমার কাছে ডিজাইনের যে অর্ধাংশ আছে তার বাকিটা আমার কাছে .…
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
এই পর্যন্ত লিখে শওকত সাহেবের মনে হল তিনি মিথ্যা কথা লিখছেন। রেনুর কাছে মূল ডিজাইনের অর্ধাংশ নেই। রেনুর কাছে তিনি কখনাে মিথ্যা বলেননি – আজ কেন বলবেন?
‘স্যার, ও স্যার।
শওকত সাহেব বের হয়ে এলেন। বাবু ছাতিম গাছের নীচে দাড়িয়ে। আছে। তার হাতে কুকুরের বাচ্চার মত একটা কি যেন দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাটা কুঁই কুঁই করছে।
“কি চাও তুমি?
‘এটা স্যার শিয়ালের বাচ্চা। আমি একটা শিয়ালের বাচ্চা ধরে ফেলেছি। আচ্ছা স্যার শিয়ালের বাচ্চাকে কি কুকুরের মত ট্রেনিং দেওয়া যায়?
শওকত সাহেব তীব্র ও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আর কখনাে তুমি আমার আশে–পাশে আসবে না। কখনাে না।।
বাবু অবাক হয়ে বলল, রাগ করতেছেন কেন স্যার? তিনি ক্ষিপ্তের মত চেঁচালেন, যাও তুমি, যাও বলছি। ‘এমন করতেছেন কেন? আপনের কি হইছে?
হৈ চৈ শুনে লােক জমে গেল। শওকত সাহেব বজরার ভেতর ঢুকে গেলেন। সারা বিকাল বিছানায় শুয়ে রইলেন। সন্ধ্যার আগে আগে করিম সাহেব এলেন চা নিয়ে। হাসি মুখে বললেন, দারুন খবর পাওয়া গেছে স্যার। মঠ একটা না। আরাে দুটা আছে। দেখতে একই রকম, তবে সাইজে ছােট।।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
শওকত সাহেব বললেন, করিম সাহেব আপনি এখন যান। আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
‘কি হয়েছে জ্বর জ্বারি নাকি?”
‘ভবেশ বাবুকে খবর দিব? ‘কাউকে খবর দিতে হবে না।” ‘মঠে কবে যাবেন বললে ব্যবস্থা করে ফেলি। ‘করিম সাহেব, আমি চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব। ‘চা খাবেন না ? ‘না। আমি রাতেও কিছু খাব না। খাবার পাঠাবেন না।
করিম সাহেব চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। বজরার মাঝি এল বাতি জ্বালাতে। তিনি তাকে ফিরিয়ে। দিলেন। অন্ধকারে বজরার ছাদে বসে রইলেন। চারদিকে ঝিঝি ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজো কি সেদিনের মতে ঝড় হবে?
রাতে খাবার নিয়ে এল পুষ্প। সে একা আসনি, বাবুকে নিয়ে এসেছে। বাবুর। হাতে হারিকেন।
পুষ্প বজরায় উঠে বাবুকে বিদেয় করে দিল। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শওকত সাহেবকে বলল, আপনার খাবার এনেছি।
তিনি চুপ করে রইলেন।
পুষ্প বলল, খাওয়া শেষ করে আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। আজ রাতে বাসায় থাকবেন। আজো ঐ দিনের মত ঝড় হবে। দিনের অবস্থা ভাল না।
Read more