নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

নীল অপরাজিতা

আমার কাজ বাকি আছেবাবু বজরা থেকে নেমে আবার উঠে এলআসল কথা, বলতে ভুলে গেছিআপনার চিঠি আসছেএই যে নেনএকটিমাত্র চিঠি তাও রেনু লিখেনিলিখেছে স্বাতী। 

বাবা

অনেকদিন তােমাকে দেখি নাতুমি কবে আসবে? তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ? মা বলেছে পৃথিবীর সবার সঙ্গেই তােমার রাগআচ্ছা বাবা পৃথিবী বানান কি ঠিক হয়েছে? মাকে জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবী বানানমা বলল তােমার যা ইচ্ছা লেখআমি কিছু জানি না। বাবা তােমার বই লেখা শেষ হয়েছে? আমার একটা দাঁত পড়েছেআমি রেখে দিয়েছি তুমি এলে দেখাবমার কাছে লেখাতােমার চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি। 

তােমার আদরের মেয়ে, স্বাতীচিঠিতে কিছুই নেই অথচ শওকত সাহেবের চোখে পানি এসে গেলতিনি তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব লিখতে বসলেনআশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে স্বাতীকে কিছু লিখলেন নালিখলেন রেনুকে। 

স্বাতীর চিঠি পেয়েছিখামের উপর তােমার হাতের ঠিকানা দেখে ভাবলাম তােমার চিঠিচিঠি লিখছ না কেন বল তাে? এক সময় তুমি তােমার রাগ এবং অভিমানের কারণগুলি আমাকে বলতেদীর্ঘ দিন সেই সব বলা বন্ধু করেছকোথায় যেন সুর কেটে গেছেনাকি সুর কখনোই ছিল না, আমরা ভেবে নিয়েছি সুর আছেএকটা সময় ছিল আমার অর্থবিত্ত ছিল না, খ্যাতি ছিল না, ক্ষমতা ছিল না, লেখার একটা কলম ছিলআর ছিলে তুমিতখন প্রায়ই ভাবতাম কোনটি আমার প্রিয় কলমটা না তুমি? আজো আমি ঠিক তেমনি করেই ভাবি কিন্তু তুমি বোধ হয় তা বিশ্বাস কর 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

তুমি অনেক দূরে সরে গেছআমি সেদিন যেখানে ছিলাম আজো সেখানে আছিভালবাসা কি সেই সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছেকাউকে কখনো বলিনি তােমাকে বলিআমার ধারণা প্রকৃতি প্রথমে একটি চমৎকার নকশা তৈরী করেঅপূর্ব একটি ডিজাইনযা জটিল এবং ভয়াবহ রকমের সুন্দরতারপর সেই ডিজাইনটি কাঁচি দিয়ে কেটে দুভাগ করেএক ভাগ দেয় একটি পুরুষকে অন্য ভাগ একটি তরুণীকেপুরুষটি তখন ব্যাকুল হয়ে ডিজাইনের বাকি অংশ খুঁজে বেড়ায়মেয়েটিও তাই করেকেউ যখন তার ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখে তখন প্রেমে পড়ে যায়তারপর দেখা 

যায় ডিজাইনটি ভুলতখন ভয়াবহ হতাশাআমার মনে হয় প্রকৃতির এটা একটা মজার খেলামাঝে মাঝে প্রকৃতি কি করে জান? মূল ডিজাইনের দুই অংশকে কাছাকাছি এনে মজা দেখে, আবার সরিয়ে নিয়ে যায়প্রকৃতি চায় 

এরা একত্র হােকদুজনে মিলে মূল ডিজাইনটি তৈরী করুকপ্রকৃতির না চাওয়ার কারণ আছে মূল ডিজাইন তৈরী হওয়া মানে এ্যাবসলিউট বিউটির মুখােমুখি হওয়াপ্রকৃতি মানুষকে তা দিতে রাজি নয়প্রকৃতির ধারণ মানুষ এখনাে তার জন্যে তৈরী হয় নিতােমাকে এত সব বলার অর্থ একটিই আমি সব সময় ভেবেছি তোমার কাছে ডিজাইনের যে অর্ধাংশ আছে তার বাকিটা আমার কাছে .… 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

এই পর্যন্ত লিখে শওকত সাহেবের মনে হল তিনি মিথ্যা কথা লিখছেনরেনুর কাছে মূল ডিজাইনের অর্ধাংশ নেইরেনুর কাছে তিনি কখনাে মিথ্যা বলেননি আজ কেন বলবেন

স্যার, স্যার। 

শওকত সাহেব বের হয়ে এলেনবাবু ছাতিম গাছের নীচে দাড়িয়েআছেতার হাতে কুকুরের বাচ্চার মত একটা কি যেন দেখা যাচ্ছেবাচ্চাটা কুঁই কুঁই করছে। 

কি চাও তুমি

এটা স্যার শিয়ালের বাচ্চাআমি একটা শিয়ালের বাচ্চা ধরে ফেলেছিআচ্ছা স্যার শিয়ালের বাচ্চাকে কি কুকুরের মত ট্রেনিং দেওয়া যায়

শওকত সাহেব তীব্র তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আর কখনাে তুমি আমার আশেপাশে আসবে নাকখনাে না।। 

বাবু অবাক হয়ে বলল, রাগ করতেছেন কেন স্যার? তিনি ক্ষিপ্তের মত চেঁচালেন, যাও তুমি, যাও বলছিএমন করতেছেন কেন? আপনের কি হইছে

হৈ চৈ শুনে লােক জমে গেলশওকত সাহেব বজরার ভেতর ঢুকে গেলেনসারা বিকাল বিছানায় শুয়ে রইলেনসন্ধ্যার আগে আগে করিম সাহেব এলেন চা নিয়েহাসি মুখে বললেন, দারুন খবর পাওয়া গেছে স্যারমঠ একটা নাআরাে দুটা আছেদেখতে একই রকম, তবে সাইজে ছােট। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

শওকত সাহেব বললেন, করিম সাহেব আপনি এখন যানআমার শরীরটা ভাল লাগছে না। 

কি হয়েছে জ্বর জ্বারি নাকি?” 

ভবেশ বাবুকে খবর দিব? কাউকে খবর দিতে হবে নামঠে কবে যাবেন বললে ব্যবস্থা করে ফেলিকরিম সাহেব, আমি চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবচা খাবেন না ? ‘না। আমি রাতেও কিছু খাব নাখাবার পাঠাবেন না। 

করিম সাহেব চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন। 

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলবজরার মাঝি এল বাতি জ্বালাতেতিনি তাকে ফিরিয়েদিলেনঅন্ধকারে বজরার ছাদে বসে রইলেনচারদিকে ঝিঝি ডাকছেবিদ্যুৎ চমকাচ্ছেআজো কি সেদিনের মতে ঝড় হবে

রাতে খাবার নিয়ে এল পুষ্প। সে একা আসনি, বাবুকে নিয়ে এসেছেবাবুরহাতে হারিকেন। 

পুষ্প বজরায় উঠে বাবুকে বিদেয় করে দিলসহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শওকত সাহেবকে বলল, আপনার খাবার এনেছি। 

তিনি চুপ করে রইলেন। 

পুষ্প বলল, খাওয়া শেষ করে আপনি আমার সঙ্গে যাবেনআজ রাতে বাসায় থাকবেনআজো দিনের মত ঝড় হবেদিনের অবস্থা ভাল না

 

Read more

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *