আমার দাদাজান সেই আমলে লাখপতি হয়ে বাড়ি বানিয়েছিলেন, তারপর অপঘাতে মারা গেলেন। অবস্থা পড়ে গেল। এই বাড়িটা ছাড়া — এখন আমাদের আর কিছুই নাই। বাড়িটাও হয়েছে বাসের অযােগ্য। আমি নীচের তিনটা ঘরে থাকি। উপরটা তালাবন্ধ থাকে।
আপনার জন্যে উপরের একটা ঘর ঠিক ঠাক করে রেখেছি। ‘বাড়ির চারদিকে কি এক সময় কদম গাছ ছিল? ‘জ্বি না। একটা কদম গাছ বাড়ির সামনে ছিল। তিন বছর আগে গাছের উপর বজ্রপাত হল। চলুন স্যার আপনার ঘরটা দেখিয়ে দেই।
‘চলুন। ‘সিড়িতে সাবধানে পা ফেলবেন। মাঝে মধ্যে ভাঙ্গা আছে। ‘বাথরুম আছে তাে। “জ্বি আছে। বাথরুম আছে, আপনার ঘরের সাথেই আছে। ‘খাবার পানি কোখেকে আনেন? নদীর পানি ?” ‘জ্বি না। টিউব ওয়েল আছে। বজলুর রহমান সাহেব চিঠিতে জানিয়েছেন – আপনাকে পানি ফুটিয়ে দিতে। পানি ফুটিয়ে বােতলে ভরে রেখেছি।
‘ভাল করেছেন। ‘স্যার আপনি কি গােসল করবেন? গােসলের পানি গরম করে দেব? ‘পানি গরম করতে হবে না। ঠাণ্ডা পানিতেই গােসল করব। ‘খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা স্যার আমার এখানে করেছি। দরিদ্র অবস্থায় যা পারি – সামান্য আয়ােজন।
‘মােফাজ্জল করিম সাহেব, কিছু মনে করবেন না আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি একজন বাবুর্চির ব্যবস্থা করুন। যে আমার জন্যে রান্না করবে। আমি টাকা দিয়ে দেব।”
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
‘তা কি করে হয়?”
‘তাই হতে হবে। আমি তাে বজলুর রহমান সাহেবকে বলেছিলাম আপনাকে এই ভাবে চিঠি দিতে। চিঠি দেন নি। ‘জ্বি না, এইসব কিছু তাে লিখেন নাই। “উনি আমাকে বলেছেন, বাবুর্চির ব্যবস্থা হয়েছে, আমি তাই মনে করে এসেছি। নয়ত আসতাম না।
‘আপনি একজন অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি। আপনার সামান্য সেবা করার সুযােগ পাওয়াতাে স্যার ভাগ্যের কথা : ‘ভাই আপনাকে যা করতে বলছি করুন।
রাতে মােফাজ্জল করিম সাহেব, শওকত সাহেবকে খাবার জন্যে ডাকতে এলেন। নীচু গলায় বললেন, বাবুর্চির ব্যবস্থা স্যার কাল পরশুর মধ্যে করে ফেলব। অজ পড়া গাঁ জায়গা। বাবুর্চিতা পাওয়া যাবে না। একটা মেয়েটেয়ে জোগাড় করতে হবে। আজ গরীবখানায় সামান্য আয়ােজন করেছি।
শওকত সাহেব বললেন, আপনি একটা কাজ করুন, খাবারটা এখানে পাঠিয়ে দিন। ‘কিছু বিশিষ্ট লােককে দাওয়াত করেছিলাম স্যার। হেড মাস্টার সাহেব, ময়নাতলা থানার ওসি সাহেবও এসেছেন। ময়নাতলা থানার ওসি সাহেব বিশিষ্ট ভদ্রলােক। সাহিত্য অনুরাগী।
‘আমি এখন আর নীচে নামব না। আপনি কিছু মনে করবেন না। ‘স্যার উনারা আগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন। ‘অন্য কোন এক সময় তাঁদের সঙ্গে কথা বলব।
মােফাজ্জল করিম সাহেব খুবই অপ্রস্তুত মুখ করে নীচে নেমে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এলেন। শওকত সাহেব বললেন, কি ব্যাপার?
“স্যার আপনার বােতলটা এসে পৌঁচেছে। এই যে স্যার বােতল। ‘টেবিলের উপর রেখে দিন। “আপনার খাবার কি স্যার নিয়ে আসব?’ ‘অতিথিরা চলে যাক। তারপর আনবেন। আমি বেশ রাত করে খাই। যদি সম্ভব হয় এক কাপ চা পাঠাবেন। ‘জি আচ্ছা। ‘চিনি বেশী করে দিতে বলবেন। আমি চিনি বেশী খাই।” ‘জ্বি আচ্ছা।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম দর্শনে বাড়িটা যত খারাপ লেগেছিল এখন তা লাগছে না। ভাল লাগছে। শুধু ভাল না। বেশ ভাল লাগছে। তিনি বসে আছেন বারান্দায়। বারান্দায় এই অংশে রেলিং আছে বলে বসে থাকতে কোন রকম অস্বস্তি বােধ করছেন না। তাঁর সামনে গােল টেবিল। টেবিলের উপর কুরুশ কাঁটার টেবিল ক্লথ। টেবিলের ঠিক মাঝখানে ফুলদানীতে চাঁপা ফুল। মিষ্টি গন্ধ। আসছে সেখান থেকে। বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় অসংখ্য তারা ফুটেছে। ঢাকার আকাশে তিনি কোনদিন এত তারা দেখেন নি। আকাশের তারার
চেয়েও তাঁকে মুগ্ধ করেছে জোনাকী পােকা। মনে হচ্ছে হাজার হাজার জোনাকী ঝাক বেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে মহাকবি বজলুর রহমানের মত চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে – পাগল হয়ে যাব।
চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলােয় দূরের নদী দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। চাঁদের আলাে ঘােলাটে নয়, পরিষ্কার। এই আলােয় কেমন যেন জল জল ভাব আছে।
সবচে যা তাঁকে বিস্মিত করল তা হচ্ছে – নীরবতা। কোন রকম শব্দ নেই। ঘরে একটা তক্ষক আছে। তক্ষকটা মাঝে মাঝে ডাকছে। শব্দ বলতে এই। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু বর্ষাকাল চারদিকে অসংখ্য ব্যাঙ ডাকবে। তা ডাকছে না। এই অঞ্চলে কি ব্যাঙ নেই ?
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
মােফাজ্জল করিম সাহেব হাতে কেরােসিনের টেবিল ল্যাম্প নিয়ে উঠে এসেছেন। ল্যম্পটা বেশ বড়। কাঁচের চিমনী ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রচুর আলাে আসছে।
‘স্যার ওসি সাহেব, আপনার জন্য টেবিল ল্যাম্পটা পাঠিয়েছেন। আপনি নিশ্চয়ই রাতে লেখালেখি করবেন। হারিকেনের আলাে কম। টেবিল ল্যাম্প
আপনার ঘরে দিয়ে আসি?”
‘জি দিয়ে আসুন। ‘আপনার চা একবার বানিয়েছিল তিতা হয়ে গেছে। আবার বানাচ্ছে। ‘ঠিক আছে। কোন তাড়া নেই। আচ্ছা করিম সাহেব আপনাদের এদিকে ব্যাঙ ডাকে না?”
‘ডাকে তাে। ডাকবে না কেন? ব্যাঙের ডাকে ঘুমাতে পারি না এই অবস্থা। ‘আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত শুনিনি। “তাই নাকি। বলেন কি?
শওকত সাহেব হেসে বললেন, ব্যাঙ না ডাকার জন্যে আপনাকে খুব লজ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
মােফাজ্জল করিম কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ব্যাঙ না ডাকায় তার আসলেই খারাপ লাগছে। শহর থেকে এসেছেন – লেখক মানুষ। ব্যঙের ডাক, ঝিঝির ডাক এইসব শুনতে চান।
‘স্যার, একটা হারিকেন কি বাইরে দিয়ে যাব? অন্ধকারে বসে আছেন। ‘অসুবিধা নেই অন্ধকার দেখতেই বসেছি। আলাে নিয়ে এলে তাে আর অন্ধকার যাবে না। তাই না?
‘অবশ্যই স্যার। অবশ্যই। আলাে থাকলে — অন্ধকার কি করে দেখা যাবে?
Read more