টেলিফোন আছে, টিভি, ভিসিআর সবই আছে। রূপার বাবা মেয়ের যা লাগে সব দিয়ে রেখেছেন।
‘এটা তাহলে রূপাদের বাড়ি না ?” “আরে না। এটা রূপার এক চাচার বাড়ি। তাদের নিজেদের বাড়ি নেই?”
আছে। সেই বাড়ি সারা বছর তালাবন্ধ থাকে। রূপার বাবা এক বছরে এগার মাস থাকে বাইরে। একটা মেয়ে তাে আর একা একা থাকতে পারে না।
এগার মাস বাইরে কি করে ? ‘ব্যবস–ট্যাবসা করে বােধহয়। বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কও ভাল না। অবশ্যি আমার আন্দাজ। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
অন্য একটা ছেলে এসে একতলার একটা রুম খুলে দিল। সফিকের কথাই সত্যি। গা ছমছমানাে ড্রয়িং রুম। সেখানের সাজসজ্জা এমন যে কিছুতেই পাঁচ দশ মিনিটের বেশি বসা সম্ভব না। পুরাে দেয়ালজুড়ে অনেক পেইনটিং । সবই বিদেশি
ল্যাণ্ডস্কেপ। চেরী গাছ, সামার হাউস, স্নো ফল, ..
সফিক বলল, ছবিগুলি দেখছিস?
ভাল করে দেখে রাখ, পরে এই সম্পর্কে বলব। মনে করিয়ে দিস। আজকাল কিছু মনে থাকে না। প্রায়ই ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
আমরা বসে আছি। সফিক নিচু গলায় বলল – রূপা যদি সত্যি সত্যি নেমে আসে, তাহলে ট্যারা হয়ে যাবি। আই ডিফেক্ট হয়ে যাবে। এরকম মেয়ে চোখে দেখতে পাওয়াও বড় ধরনের অভিজ্ঞতা। তবে নেমে আসে কিনা সেটাও একটা কথা। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ থাকে। তখন দোতলা থেকে নামে না।
আমি বললাম, এতাে বিরাট অপমানের ব্যাপার!
সফিক বলল, দূর দূর, অপমানের কিছু না। রূপার স্বভাবই এরকম। পরিচয় হলেই তুই বুঝবি।
‘যখন দেখা করে না, তখন কি করিস?” | ‘চা–টা খেয়ে চলে যাই। কি আর করব। রূপার একটা ভাল গুণ কি জানিস? কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেই চা দিতে বলে। দেখা করুক আর না করুক। চায়ের সঙ্গে সমুচা থাকে। অপূর্ব! রবীন্দ্রনাথের ছােটগল্পের মতাে। শেষ হয়েও শেষ হয় না, জিভে স্বাদ লেগে থাকে।
মেয়েটা দেখা করে না। তারপরেও তুই এখানে আসিস ? ‘। এত সুন্দর মেয়ে, খানিকক্ষণ কথা বললে মনটা ভাল হয়ে যায়। তাই আসি। এখানে এলে লেখার একটা ইন্সপিরেশন হয়। লেখকদের জন্যে ইন্সপিরিশন খুব দরকার। ইন্সপিরিশনের জন্যে একজন লেখক যা ইচ্ছা করতে পারে। হট হজ এ্যালাউড।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপা নামল না। তবে একজন কাজের ছেলে ট্রেতে করে চা এবং সমুচা নিয়ে এল। সফিক বলল, তােকে বলেছিলাম না চা চলে আসবে। অবশ্যি এটা খারাপ সাইন। তার মানে রূপা নামবে না। চা খা। চা খেয়ে চলে যাব। এই সমুচাগুলি এ বাড়ির স্পেশাল। ভেরি ভেরি গুড। খেয়ে দেখ।
চা শেষ করবার আগেই রূপা নেমে এল। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। জীবনে এত অবাক হইনি। মানুষ এত সুন্দর হয় ! সফিক নিচু গলায় বলল, বলেছিলাম না ট্যারা হয়ে যাবি ? এইভাবে তাকিয়ে থাকিস না, চোখে লাগছে। খুব ক্যাজুয়েলি তাকিয়ে থাক। যেন কিছুই না।
রূপা সফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনাে কাজে এসেছেন, না চা সমুচা। খাবার জন্যে এসেছেন?
‘কাজে এসেছি।
“বলে ফেলুন। আমি খুব বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না। এ সফিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আমি আমার এই বন্ধুকে বলেছিলাম—এমন একজন মেয়ের কাছে তাকে নিয়ে যাব যাকে দেখলেই তার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, আপনার চোখ কি ট্যারা হয়েছে ? ১১আমি কিছু বললাম না। তাকিয়ে রইলাম।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
মেয়েটি সফিকের কথায় মােটেও বিব্রত বােধ করছে না। আমার দিকে তাকিয়ে আছে অসঙ্কোচে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, আচ্ছা আপনি কি কবি?
আমি বললাম, না। ‘বাঁচালেন। কবি হলে খানিকটা সমস্যা হত।
বলেই সে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আগ্রহের কারণ, সে অপেক্ষা করছে আমি জিজ্ঞেস করব—কি সমস্যা? আমি তা করলাম না। রূপা বলল, কি সমস্যা জানেন? কবি হলেই পরের দিন আপনি আবার আসতেন, পকেটে থাকত কবিতা। সেই কবিতা আমাকে নিয়ে লেখা। আমাকে শান্তমুখে সেই কবিতা শুনতে হত। এবং আবেগজর্জরিত কবিকে সমুচা খাওয়াতে হত। আপনি কি সমুচা খেয়েছেন?
এ কেমন লাগল?’ is
আমি জবাব দিলাম না। রূপা বলল, সফিক সাহেবের মতে সমুচাগুলি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতাে। আমি রবীন্দ্রনাথের ছােটগল্প পড়িনি, কাজেই বলতে পারছি না ব্যাপারটা কি? আপনি কি পড়েছেন ?
একটা পড়েছি। শুধুই একটা ?” ‘হুঁ, হৈমন্তী। পাঠ্য ছিল।
সফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মজার ব্যাপার কি জান? হৈমন্তী গল্পটা রঞ্জুর মুখস্থ। দাড়ি সেমিকোলনসহ।
‘হ্যা, সত্যি। তার যখন কিছু পছন্দ হয় সে মুখস্থ করে ফেলে। সে রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প পড়েছে, কিন্তু সেটা তার মুখস্থ।
ই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না – সত্যি?
আমি জবাব দিলাম না। সফিককে বললাম, চল উঠি।
রূপা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, এখনই উঠবেন কি। বসুন। আরেক কাপ চা খান। হৈমন্তী গল্পটা মুখস্থ বলুন। প্লীজ। প্লীজ। বাসায় গল্পগুচ্ছ আছে, আমি বই। নিয়ে মিলিয়ে দেখব। যদি সত্যি সত্যি পারেন তাহলে ...
‘তাহলে কি ? রূপা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে আপনার জন্য একটা প্রাইজ আছে।
সফিক বলল, ও পারবে, ওর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ভাল। আমার বরাবরই খারাপ ছিল। এখন আরাে খারাপ হয়েছে।