রহমান বলল, আমি খাব না। আমার বমি-বমি আসছে। হাসপাতালের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। মনসুর দাত বের করে হাসল— হাসপাতালে ফুলের গন্ধ থাকবে নাকি রে শালা ? হাসপাতালে থাকবে ওষুধের গন্ধ, রােগের গন্ধ। যেখানকার যা নিয়ম। এর মধ্যেই মনসুর আবিষ্কার করল, ফ্যানের রেগুলেটরটা খারাপ, ধরলেই শক দেয়।
বাথরুমের ফ্লাশ কাজ করে না। দরজার ছিটকিনি কাজ করে না। সে নােটবই বের করে লিখে ফেলল। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই নাকি সে সব ঠিক করে ফেলবে। টাকা খাওয়াতে হবে । টাকা খাওয়ালেই সব ঠিক। টাকাটা সে কাকে খাওয়াবে কে জানে! আমি বললাম, আরেকজন রােগী থাকার কথা না ?
রােগীর বিছানা-বালিশ সবই আছে, রােগী নেই। মনসুর গম্ভীর হয়ে বলল, রুমমেট যাকে পেয়েছিস, মালদার পার্টি। জিনিসপত্র দেখ-না। থার্মোফ্লাস্কটা দেখেছিস ? মিনিমাম এক হাজার টাকা দাম।
রহমান সত্যি সত্যি অস্বস্তি বােধ করছে। দুবার বলল, ফিনাইলের গন্ধে তার মাথা ধরে যাচ্ছে। কিন্তু মনসুরের ওঠার কোনাে তাড়া দেখা গেল না। সে রােগী সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেল। সেই সঙ্গে একজন আয়া নিয়ে আসবে, যে নাকি সব দেখেশুনে রাখবে। এটা-সেটা এনে দেবে। অসুবিধা হলে রাত-বিরেতে ডাক্তারকে খবর দেবে। মনসুর বিজ্ঞের মতাে বলল, হাসপাতাল কি ডাক্তাররা চালায় ? হাসপাতাল চালায় আয়ারা। একজন ভালাে আয়া পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। রহমান বিরক্ত হয়ে বলল, ছেলেদের ওয়ার্ডে আয়া আসতে দেবে নাকি ? কী যে সব কথাবার্তা!
প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-১৪)
আয়া নয়, একজন বেঁটে ছােকরাকে সে ধরে নিয়ে এলাে। খুব নাকি ওস্তাদ। ছােকরার নাম মঞ্জু মিয়া।
নতুন জীবন শুরু হলাে।
আমার পাশের বেডের রােগীর নাম জুবায়ের। আনকমন নাম। ভদ্রলােকও বেশ আনকমন। দারুণ ফরসা এবং দারুণ রােগী। লম্বাও প্রায় ছ’ফুটের মতাে। যখন শুয়ে থাকেন তখন কেন জানি সাপের মতাে লাগে। সাপের উপমাটি ঠিক হলাে না। সাপের মধ্যে একটা ঘিনঘিনে ব্যাপার আছে। একটা গতি আছে। এর মধ্যে তা নেই। এর চারদিকে একটা আলসে জ্ঞাব আছে। রােগের জন্যেই হয়তাে। বয়সও ধরা যাচ্ছে না, পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে হবে। রােগা মানুষের বয়স ধরা যায় না। ভদ্রলোক কথা বলেন খুবই কম। আমি যখন বললাম, আমি আজ বিকেলে এসেছি। আপনি অন্য কোথাও ছিলেন, আপনার সঙ্গে সে জন্যেই দেখা হয়নি। আমার নাম ফরিদ। তিনি শুধু বললেন, আমার নাম জুবায়ের। আর কোনাে কথা হলাে না।।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হবার পর ভদ্রলােকের স্ত্রী এলেন। তিনি আমার সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দিলেন— এ অ্যানি, আমার স্ত্রী।
অ্যানি নামের মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। নরম স্বরে বললেন, আপনাকে কিন্তু ও খুব জ্বালাবে। রাত জেগে বই পড়বে। আগে যে রােগীটি ছিল সে রােজই কমপ্লেইন করত।
আমি করব না। কারাে বিরুদ্ধে আমার কোনাে অভিযােগ নেই। কেন? আপনি সন্ন্যাসী ?
মেয়েটির মুখ হাসি-হাসি। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। উত্তর জানতে চায় হয়তাে।
কী, বলুন? আপনি কি সংসার-বৈরাগী ? জি-না।
সন্ন্যাসী হওয়া ঠিক না। রাগ, ঘৃণা, অভিমান, অভিযােগ এসব থাকা উচিত। এসবের দরকার আছে।
মেয়েরা এত গুছিয়ে কথা বলতে পারে তা জানা ছিল না। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভদ্রমহিলার বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। কালাে রঙ। মাথা ভর্তি চুল, বেণী করা নেই, পিঠময় ছড়িয়ে দেয়া। এর দিকে তাকিয়ে বলে দেয়া যায় অনেক ছেলে এই মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। মেয়েটি এদের সবাইকে ছেড়ে ফরসা ও রােগা লােকটির কাছে এসেছে। এসেছে কেন ? কী আছে লােকটির মধ্যে ?
প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-১৪)
অ্যানির অন্য সব প্রেমিকদের আমার দেখতে ইচ্ছে করল। মেয়েটি বসেছে বিছানার পাশে। কথা বলছে মৃদু স্বরে। কিন্তু কথা বলছে সে একাই। লােকটি শুধু শুনে যাচ্ছে। এমনকি হা-হু পর্যন্ত বলছে না। শুয়ে শুয়ে ওদের কথা শােনা ঠিক হচ্ছে না। আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ বড় বারান্দা। রােগী দেখতে আসা লােকজনরা হাঁটাহাঁটি করছে। একটা লাল স্যুয়েটার-পরা বাচ্চা টুকটুক করে দৌড়াচ্ছে। এই গরমে তাকে স্যুয়েটার পরিয়েছে কেন কে জানে! আমি ডাকলাম– এই খােকা, এই! ছেলেটি অবাক হয়ে আমাকে দেখল, তারপর খেলতে লাগল নিজের মনে। শিশুদের মন পাওয়া খুব কঠিন। অ্যানি বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এলাে।
ফরিদ সাহেব! যান, ভেতরে যান। আমরা এমন কিছু বলি না যে অন্য কেউ শুনতে পারবে না। আপনি শুধু শুধু কুই করে বাইরে এলেন।
ওর চোখ ভেজা। কাঁদছিল হয়তাে।
অনেক দিন ধরে সে আর কথা বলে না, শুধু শশানে। কথা বলি আমি একা । আচ্ছা, আজ চলি।
ওনার কী হয়েছে ? কী হয়েছে শুনে কী করবেন ? ও মারা যাচ্ছে।
দ্রলােক রাত একটা পর্যন্ত বই পড়লেন। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। কেন জানি খুব ক্লান্ত লাগছে। এই অপরিচিত জায়গায় আমার ঘুম আসার কথা নয়, তবু আজ বােধহয় ঘুম আসবে। ভদ্রলােক বাতি নিবিয়ে নরম স্বরে ডাকলেন, ফরিদ সাহেব।
বলুন। ঘুমান নি ?
জি–না। নতুন জায়গায় ঘুম আসে না।
আমারও আসে না। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন, হাসপাতালের প্রথম রাতে আমি মরার মতাে ঘুমিয়েছিলাম। ওষুধপত্র ছাড়াই দীর্ঘ ঘুম।
তাই নাকি? হ্যা। ফরিদ সাহেব, আপনারও কি ঘুম পাচ্ছে ?
প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-১৪)
জি।
ঘুমাবেন না। কষ্ট করে হলেও জেগে থাকেন। হাসপাতালের অনেকরকম কুসংস্কার আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে যে হাসপাতালের প্রথম রাতে আরাম করে ঘুমায় সে আর হাসপাতাল ছেড়ে জীবিত অবস্থায় বের হয় না।
তাই নাকি? এই কুসংস্কারটা আগে জানতাম না। জানলে আমি জেগে থাকতাম।
ভদ্রলােক অন্ধকারের মধ্যেই হাসলেন। যিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কোনাে কথা বলেন নি তিনি আমার সঙ্গে এত কথা বললেন কী জন্য ?
ফরিদ সাহেব। জি ? আপনার সঙ্গে সিগারেট আছে ? জি, আছে।।
দিন একটা। আমার খাওয়া নিষেধ, কিন্তু এখখেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনার কি ঘুম পাচ্ছে নাকি?
মনে হয় পাচ্ছে। ঘুমাবেন না, উঠে বসুন(ভুল করবেন না। কুসংস্কারটাকে আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?
ভদ্রলােক জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলেন। সিগারেটের আলাে এক-একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তাঁর ফরসা মুখ দেখা যাচ্ছিল। এত ফরসাও মানুষ হয়!
ফরিদ সাহেব। বলুন। অ্যানির সঙ্গে আমার ক’দিন হয় বিয়ে হয়েছে বলুন তাে? বলতে পারব না। অনুমান করুন। দু’ বছর ?
তিন মাস। আমি নিজে আমার অসুখের কথাটা জানি। কিন্তু সেটা গােপন করেই ওকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু কিছু-কিছু মেয়ে থাকে ফরিদ সাহেব, যাদের জন্যে যে-কোনাে ধরনের অন্যায় করা যায়।
Read more