প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-৯)

যাবার আগে টাকা ধার চায়। না, শুধু মেমসাহেবের ছবি নয়, পুরো ফ্যামিলির ছবি। বিদেশিনী একটি বাচ্চাকে নিয়েছে ঘাড়ে, অন্যটিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। বাবুল তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ম্ভীর মুখে। বাবুলের চেহারা বিশেষ বদলায় নি। শুধু মােটা হয়েছে। একটু গম্ভীর হয়েছে। কিন্তু মেমসাহেব ছবিতে খুব হাসিখুশি। মনে হচ্ছে এই মেয়েটি কথায়-কথায় হাসে। ছবি অবশ্যি কখনাে সত্যি কথা বলে না। আমার নিজের ছবিতে আমাকে খুব হাসিখুশি দেখায়, বাস্তব জীবনে আমি বিশেষ হাসি না। হাসি আসে না।প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ 

বাবা, ছেলে দুটি কি ওদের ? 

ওদের না তাে কার ? রাস্তার বাচ্চা ধরে এনেছে না-কি ? কী যে বেকুবের কথাবার্তা! চেহারাও তাে বাবুলের মতাে। 

মেয়েটার চেহারা তাে ভালােই। 

মেয়েটা বলছিস কেন? সম্পর্ক দেখবি না ? সম্পর্ক যা হয় তাই ডাকবি। ভাবি ডাকবি। 

এলে ডাকব।। আসবে-টাসবে না। 

আমি উঠে পড়লাম। বাবা বললেন, খেয়ে যা। আজ চিতল মাছ এনেছে, বড় চিতল। পেটির মাছটা দিয়ে কোপ্তা করেছে, আর বড় বড় পেটি। 

আপনি জানলেন কীভাবে ? রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসলাম। অসুবিধা কী? আমার সাথে কেউ পর্দা করে । বুড়াে মানুষের সাথে আবার পর্দা কী ? | বাবা আমাকে বাসে উঠিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এলেন। অনুর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা হলাে না। এখানকার খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে যেতে তাঁর বােধহয় খানিকটা দ্বিধা আছে। বেশ কয়েকবার খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গ এলাে। 

বুঝলি, এদের খাওয়াটা ভালাে। মাসে দু’বার পােলাও হয়। তাই নাকি? 

প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-৯)

নাজির পােলাও খায় না, তার পেটের ট্রাবল। তার জন্যে পােলাওয়ের চালের ভাত। মােহনভােগ চাল। দিনাজপুর থেকে আসে। 

ভালােই তাে। নাজিরের বউ রাধেও ভালাে। রান্নাটা নিজেই করে, চাকরের হাতে দেয় না। তাই বুঝি ? হুঁ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খুল্ক সব জিনিস নিজের হাতে পােয় । আপনি সারাদিন রান্নাঘরে বসে থাকেন নাকি ? রান্নাঘরে বসে থাকব কেন ? মাঝেমধ্যে যাই। 

বাসস্ট্যান্ডটা অনেকখানি দূরে। দেখলাম, বাবার কষ্ট হচ্ছে। বয়স হয়েছে। কষ্ট হওয়ারই কথা। আমি বললাম- চলে যান। আসতে হবে না। গােসল করে খাওয়া-দাওয়া করেন। বাবা তার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতেই থাকলেন। বেচারা। 

ফরিদ ।। বলুন। 

কড়া করে একটা চিঠি লেখ বাবুলকে। বাপ-মা’র হক আছে ছেলেপুলের উপর। আছে না ? 

তা তাে আছেই। 

খুব কড়া করে চিঠি দে। লিখে দে— বাবা অন্যের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতাে অবস্থান করিতেছেন। 

আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম। ভিক্ষুকের মতাে অবস্থান। কঠিন শব্দের প্রতি বাবার খুব টান। একবার চিঠি লিখলেন- বড় বউমার আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছি। গ্লাস ভাঙার বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করা তার উচিত হয় নাই। আমি তার পিতৃস্থানীয়। গ্লাস এমন কোনাে মূল্যবান বস্তু নহে ! জগই 

অনিত্য। 

দারুণ ফিলসফি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিক ভাবটা বাবার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠেছে। কথায় জীবনদর্শন চলে আসছে। 

চিঠি কিন্তু দিবি বাবলুকে। দেব । আর বেশি করে পানি খাবি । কেন? পানিটা পেটের জন্য ভালাে। জল-চিকিৎসা। খুব উপকার হয়। ঠিক আছে, খাব। আর শােন, একটা বিয়েশাদি কর। বুড়াে হয়ে গেলি তাে! রােজগারপাতি নাই। 

রােজগারপাতি নাই বলেই সংসার করবি না ? ভিক্ষুকরাও তাে বিয়েটিয়ে করে। করে না? 

প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-৯)

আবার একটা কঠিন শব্দ ভিক্ষুক ।  হাসপাতাল থেকে ফিরেই বিয়ে করে ফেল। চিঠি লিখে দে বাবুলকে টাকা পাঠাতে। তুই ছােট ভাই, তাের হক আছে। বিয়ের খরচ দিতে বল। 

ঠিক আছে, লিখব। 

বাড়ি ফেরার জন্যে বাবাকে একটা রিকশা করে দিলাম। দু টাকা দিয়ে দিলাম রিকশাওয়ালাকে। বাবা আকাশ থেকে পড়লেন। 

এখান থেকে ওখানে রিকশা? পাগল নাকি! রােদের মধ্যে কষ্ট করবেন কেন ? চলে যান। হুড তুলে দেন। 

বাবা খুবই অবাক হলেন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। এত অবাক হবার কী আছে? একজন বুড়াে মানুষের প্রতি আমি একটু মমতা দেখাতে পারি ? মমতার পরিমাণ খুবই সামান্য, তাতে কী? কিন্তু বাবা এমনভাবে 

তাকাচ্ছেন, যেন কেঁদে ফেলবেন। 

কত নম্বর বেড বললি ? একুশ নম্বর। আচ্ছা, একদিন যাব। তুই বাবুলকে চিঠি লিখবি মনে করে। লিখব। খুব কড়া করে লিখবি। আচ্ছা লিখব। 

বাবা ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে চলে গেল। বাবা বেশ হাত-পা ছড়িয়ে বসেছেন। হুড তােলেন নি। কড়া রােদ। তবু আমার মনে হলাে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে না। গিয়েই হয়তাে গােসল সেরে চিতল মাছের পেটি নিয়ে বসবেন। খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমুবেন। সন্ধ্যাবেলা টিভি সেটের সামনে বসবেন। 

প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-৯)

আজকের দিনটা বাবার সঙ্গে কাটালেই হতাে। ফিরে যাবার একটা ক্ষীণ ইচ্ছা হতে লাগল। যাব নাকি ফিরে ? বললেই হবে, শরীরটা ভালাে লাগছে না। বিকেলে বাসায় যাব । কিংবা হয়তাে থেকেই গেলাম আজ রাতটা। দোটানা ভাব দীর্ঘস্থায়ী হলাে না। বাসে উঠে পড়লাম। পাশের দ্রলােক একটা চিত্রালী কিনেছেন। প্রথম পাতায় কোনাে-একজন নায়িকার ছবি ছাপা হয়েছে। মােটা মােটা ঠোট। ইয়া লাস। বডি বিল্ডারদেরুজতাে ফিগার। এমন একটি ধুমসী মেয়ে কী করে খুকিদের মতাে কামিজ পরে আছে কে জানে ? নাম কী নায়িকাটির ? নাম-ধাম লেখ নেই। হয়তাে এত পরিচিত যে নামের প্রয়ােজন নেই। আমি আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলােককে জিজ্ঞেস করলাম, এই নায়িকার নাম কী ? ভদ্রলােক অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। কেন হলেন কে জানে ! বিরক্ত কি আমার অজ্ঞতার জন্যে ?

 

Read more

প্রথম প্রহর-হুমায়ূন আহমেদ -(পর্ব-১০)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *