প্রিয়তমেষু পর্ব:০২ হুমায়ূন আহমেদ

প্রিয়তমেষু পর্ব:০২

শোবার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া রকিবের স্বভাব। মশারির ভেতর থেকে আধখানা শরীর বের করে আয়েশ করে সিগারেট খায়। সিগারেটের শেষ অংশ হাতে থাকতে থাকতেই তার ঘুম এসে যায়। আজ রুটিনের সামান্য ব্যতিক্রম হচ্ছে। রকিব খাতাকলম নিয়ে বসেছে। পুষ্প বলল, চিঠি লিখছ? উঁহু, একটা হিসাব। জটিল হিসাব।কিসের হিসাব? বার শ টাকা যদি বাড়িভাড়া হয়, তা হলে সেভিংস কিছু থাকে কি না। আমার খরচটা ধরি–বাসভাড়া, হাত-খরচ, পান-সিগ্রেট–ধর দুই শ।দু শ-তে হবে না, তিন শ।আচ্ছা, ধর তিন শ। চাল আমাদের কতটুকু লাগে? আধ মণ লাগে?

আধ মণ তো লাগার কথা না। ধর আধ মণই। আধ মণের দাম কত? সরেসটা ধরবে, না প্লেইন? ইরি কত করে মণ।সাড়ে চার শ টাকা মণ। আধ মণ হচ্ছে দুই শ পঁচিশ।ধরলাম দুই শ পঁচিশ।পুষ্প বলল, এস শুয়ে পড়ি। সকালে হিসাবনিকাশ করবে। ঘুম পাচ্ছে। বাবু দুপুরে ঘুমুতে দেয় নি।কতক্ষণ আর লাগবে। খুব টাইট বাজেটের ভেতর দিয়ে চললে আমার মনে হয় কিছু সেভ করা যাবে।পুষ্প মশারির ভেতর ঢুকে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, শোয়ামাত্র তার ঘুম কেটে গেল। মনে হতে লাগল তার মতো সুখী মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই। ছোট্ট সংসার। ভালোমানুষ ধরনের স্বামী। শাশুড়ি-ননদের কোনো ঝামেলা নেই। এর চেয়ে বেশি সুখী একটি মেয়ে কী করে হয় তার জানা নেই।

পুষ্প।বল।প্রতি মাসে একটা-দুটা প্রাইজবন্ড কিনে রাখব, বুঝলে। লেগে গেলে কেল্লা ফতে। আমাদের অফিসের এক জন দশ হাজার টাকা পেয়ে গেল। হাজার পাঁচেক টাকা সবসময় হাতে থাকা দরকার। কখন কি ঝামেলা হয় কিছুই বলা যায় না।পুষ্প চুপ করে রইল। এক বার ভাবছিল বলবে, আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে। আমার নানি দিয়েছেন। বলল না। নানিজান হজ্বে যাবার সময় তাদের তিন বোনের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব সম্পত্তির পুরোটাই বিলি-ব্যবস্থা করে গেলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল হজ্ব করে তিনি ফিরবেন না। ইশতেখারা করে নাকি এই খবর জেনেছেন। হজ্ব করে তিনি পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন। এখন একেক ছেলের সংসারে কিছু দিন করে থাকেন আর তাঁদের বিরক্ত করে মারেন। কারো সঙ্গেই তাঁর বনে না। পুষ্পের খুব ইচ্ছা নানিজানকে এ–বাড়িতে এনে কিছু দিন রাখে। সাহসে কুলায় না।

কে জানে এসেই যদি নাতজামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেন। তা হলে বড় বিশ্রী ব্যাপার হবে।রকিব মশারির ভেতর এসে ঢুকল। পুষ্প বলল, বাতি নেভালে না? বাতি নিভিয়ে আস।একটু পরে নেব।পুষ্পের লজ্জা করতে লাগল। রকিবের বাতি না-নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢোকার অন্য অর্থ আছে। পুষ্প খুব সাবধানে তার ছেলের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দিল। সে যদি জেগে ওঠে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। পুষ্প ক্ষীণ স্বরে বলল আমি বাতি নিভিয়ে দিয়ে আসি? উঁহু। অন্ধকারে আমার ভালো লাগে না।বাবু উঠে যাবে।উঠবে না।

রকিব পুষ্পকে কাছে টেনে নিল। তার মুখে সিগারেটের কড়া গন্ধ। অন্য সময় এই গন্ধে পুষ্পের বমি আসে। এখন আসছে না। বরং ভালো লাগছে। রকিব কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় আদরের কথা বলছে। এই সময়ের আদরের কথার আসলে তেমন গুরুত্ব নেই, তবু পুষ্পের শুনতে ভালো লাগে। তারও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে বলতে পারে না। লজ্জা লাগে। তবে অর্থহীন কিছু কথাবার্তা এই সময়ে সে বলে। রকিব মন দিয়ে শোনে কি না সে জানে না, তবে প্রতিটি কথারই উত্তর দেয়।পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হল।তাই নাকি? হ্যাঁ, অনেক কথা বললেন। চা খাওয়ালেন। বাবুকে খুব আদর করলেন। বিসকিট দিলেন।ভালোই তো।ওঁকে দেখতে অহঙ্কারী মনে হয়, কিন্তু আসলে অহঙ্কারী না। বাবুর পল্টু নামটা ওঁর পছন্দ হয় নি।তাঁদের ছেলেপুলেদের নাম কি?

ছেলেমেয়ে নাই। যখন হবে খুব সুন্দর নাম নিশ্চয়ই রাখবেন।রাখুক যা ইচ্ছা। আমাদের পর্দুই ভালো। মেয়ে হলে মেয়ের নাম রাখব খুন্তি।কী নাম রাখবে? খুন্তি।কী যে তুমি বল! এই দেখ না বাবু মনে হয় উঠে যাচ্ছে। কেমন পা নাড়াচ্ছে দেখ না।ও ঘুমাচ্ছে মড়ার মতো। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে উঠবে না।না না, বুঝতে পারছ না, ওর ঘুম ভাঙার সময় হয়ে গেছে।উঁহু, হয় নি।বাতিটা নেভাও, তোমার পায়ে পড়ি।নেভাব না।বাবু ঠিক এই সময় জেগে উঠল। বিকট স্বরে কেঁদে উঠল। পুষ্প থমথমে গলায় বলল, এখন শিক্ষা হল তো! রকিব হাসছে। মনে হচ্ছে তার শিক্ষা এখনো হয় নি।

এ-বাড়ির কলিংবেলটা কী সুন্দর করেই না বাজে। যেন একটা পুরনো দেয়াল-ঘড়ি ঢং-ঢং করে বাজছে। প্রথম দু-তিন বার খুব গম্ভীর আওয়াজ, তারপর রিনরিনে আওয়াজ। কলিংবেল বাজলেই এই কারণে পুষ্প অনেকক্ষণ দরজা খোলে না। বাজুক যতক্ষণ ইচ্ছা। কী সুন্দর লাগে শুনতে।পরপর তিন বার বাজার পর পুষ্প উঠল। অসময়ে কে হতে পারে? দুপুর আড়াইটায় কে আসবে? রকিব নাকি? মাঝে-মাঝে অফিস ফাঁকি দিয়ে সে চলে আসে। বিয়ের পরপর এটা সে বেশি করত, এখন অনেক কমেছে। ছোট ভাইয়া না তো? কল্যাণপুরে ছোট ভাইয়ার বাসা। বির সঙ্গে প্রচণ্ড রকম ঝগড়া হলে সে এরকম সময়-অসময়ে চলে আসে। এক বার রাত বারটার সময় সে পুষ্পের শ্বশুরবাড়ি এসে উপস্থিত। ভাবির সঙ্গে ঝগড়া করে বাসে করে চলে এসেছে। হাতে কোনো টাকাপয়সাও ছিল না।কে?

ভাবি আমি। অধমের নাম মিজান। অনেকক্ষণ ধরে বেল টিপছি। যদি মর্জি হয় দরজা খুলুন।পুষ্প লজ্জিত হয়ে দরজা খুলল। তার কাপড় অগোছালো। চুল বাঁধা নেই। এতক্ষণ ঠাণ্ডা মেঝেতে বালিশ এনে শুয়ে ছিল, সেই বালিশ এখনো গড়াচ্ছে।ঘুম থেকে তুললাম নাকি ভাবি? মেঝেতে শয্যা পেতেছিলেন মনে হচ্ছে।আসুন, ভেতরে আসুন। ও তো নেই।সে তো ভাবি জেনেই এসেছি, যাতে খালি বাসায় আপনার সঙ্গে কিছু রঙ্গতামাশা করতে পারি। নাকি আপনার আপত্তি আছে? পুষ্প কী বলবে ভেবে পেল না। কী অদ্ভুত কথাবার্তা!

ভাবি মনে হচ্ছে আমার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছেন? দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে গেছেন। হা হা হ্যাঁ। খুব ঠাণ্ডা দেখে এক গ্লাস পানি দিন তো! বরফ-শীতল পানি।ঘরে ফ্ৰীজ নেই। পানি খুব ঠাণ্ডা হবে না।তা হলে চা বানিয়ে দিন। আগুন-গরম চা। চিনি দেবেন না।একটুও দেব না? চিনি খান না? যথেষ্টই খাই। তবে আপনার হাতে খাব না। আপনার বানানো চা এমনিতেই মিষ্টি হবে। হা হা হ্যাঁ।আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।আপনার পুত্র কোথায়? পাশের ফ্ল্যাটের আপা নিয়ে গেছেন। ওঁর মার বাসায় গেছেন। সন্ধ্যাবেলা আসবেন।তা হলে শুধু আপনি আর আমি, এই দুজনই আছি? বা ভালোই তো!

পুষ্পের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কী অদ্ভুত কথাবার্তা! সে দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকল। তার কেবলই মনে হতে লাগল রকিবের এই বন্ধু রান্নাঘরে উকি দেবে। তা অবশ্যি দিল না। চা বানিয়ে এনে পুষ্প দেখে ফুল স্পীড ফ্যান ছেড়ে তার নিচে মিজান দাঁড়িয়ে।কি জন্যে এসেছি সেটা আগে বলে ফেলি, নয়ত কি না কি ভাববেন কে জানে। রকিব বাড়ির কথা বলছিল। সোবহানবাগে দুটা বাসা আছে। একটা হাফ বিল্ডিং, উপরে টিন। দুই কামরা, গ্যাস, পানি, ইলেকট্রিসিটিসবই আছে। ভাড়া তের শ। আরেকটা আছে তিন তলার ফ্ল্যাট। ভাড়া সতের শ। মালিকের সঙ্গে আমার চেনাজানা আছে। কিছু কমাবে। অ্যাডভান্স লাগবে না। রকিবকে নিয়ে দেখে এসে মনস্থির করুন। বাহ্, ফাসক্লাস চা হয়েছে।

আপনি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন কেন, বসুন।ভাবি মনে হচ্ছে একটু স্বস্তি পেলেন। এখন ভাবছেন লোকটা রঙ্গ-তামাশা করতে আসে নি। ঠিক করে বলুন তো, তাই ভাবছিলেন না? পুষ্প ফ্যাকাসেভাবে বলল, জ্বি-না।না বললেও বিশ্বাস করব না। চোখমুখ কেমন সাদা হয়ে গেছে। ভাবি চলি।এখুনি যাবেন? যদি যেতে নিষেধ করেন যাব না। সুন্দরী মহিলার নিষেধ অগ্রাহ্য করব এত বড় বোকা আমি না। তবে আজ না ভাবি। ড্রাইভারকে আজ সকাল-সকাল ছেড়ে দিতে হবে। চলি, কেমন? ও আচ্ছা, বাড়ির ঠিকানা তো দেওয়া হয় নি। কাগজ-কলম আনুন।

মিজান ঠিকানা লিখে সত্যি-সত্যি চলে গেল। যাবার আগে বলল, বেয়াদপি হলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন ভাবি। আর রকিবকে আমি খবর দিয়ে দেব যাতে সকালসকাল অফিস থেকে ফেরে। আজই দেখে আসবেন। দেরি করবেন না। বাড়ির খুব ক্রাইসিস।রকিব পাঁচটার আগেই ফিরল। চা খেয়েই বাড়ি দেখতে বেরুল। সঙ্গে পুষ্প। বাবুকে নিয়ে নিশাত এখনন ফেরে নি। রকিব বিরক্ত মুখে বলল, কার-না-কার কাছে বাচ্চা দিয়ে দাও! আগ্রহ করে নিতে চাইলেন।আগ্রহ করে কেউ বাচ্চা নিতে চাইলেই বাচ্চা দিয়ে দেবে? চেন না, জান না! চিনব না কেন? বাবু খুব খুশি হয়ে গেছে। গাড়িতে চড়তে খুব পছন্দ করে। গাড়ি নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় না।

গাড়ি নিয়ে যাওয়া একটা বড় কথা নাকি? মিজানকে বললেই গোটা দিনের জন্য গাড়ি দিয়ে দেবে। খুবই মাই ডিয়ার লোক। বন্ধুদের জন্য খুব ফিলিং। দেখ না নিজে কেমন বাড়ি খুঁজে বের করল। হার্ট অব দা টাউনে।কেমন বাড়ি কে জানে।বাড়ি ভালোই হবে। ওর রুচি ভালো। এলেবেলে জিনিস দেখবে না।দুটি বাড়ির মধ্যে টিনের বাড়িটা পুষ্পের খুব মনে ধরল। কী ছিমছাম। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে অল্প খানিকটা জায়গা। এর মধ্যে দুটা কামিনী গাছ, একটা পেঁপে গাছ এবং একটা কাঁঠাল গাছ। বড়-বড় কাঁঠাল ধরে আছে। রান্নাঘরের পাশে ছোট একটা স্টোররুম আছে। বাড়ির মেঝে কালো সিমেন্টের। তাকালেই কেমন ঠাণ্ডাঠাণ্ডা ভাব আসে। রকিব বলল, মন্দ নয়, কী বল? নেওয়া যায় না?

খুব নেওয়া যায়। সুন্দর বাড়ি। খুব সুন্দর।গরমে কষ্ট পাবে। টিনের ছাদ।টিনের ছাদের বাড়ি রাতের বেলা আরাম হয়। ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তা ছাড়া কেমন। সুন্দর বারান্দা। তুমি বিকালে বরান্দায় বসে চা খাবে।রকিব শব্দ করে হেসে উঠল।হাসছ কেন? বারান্দায় চা খাওয়ার মধ্যে কী আছে? নিশাত আপারা বারান্দায় চা খায়। দেখতে কী ভালো লাগে।বারান্দা তো তোমারও আছে, তুমি বসে খেলেই পার।মেঝেতে বসে-বসে খাব? আমাদের কি এঁদের মতো চেয়ার-টেবিল আছে? হবে, সব হবে। ধীরে ধীরে হবে। আগামী জুন মাস নাগাদ একটা প্রমোশনের কথা আছে।সত্যি? হুঁ। তেলাতেলির ব্যাপার আছে। ঐটা করতে হবে ভালোমতো।কর। সবাই যখন করছে।করব তো বটেই। তৈল কাহাকে বলে, কত প্ৰকার ও কী কী এখন ব্যাটারা বুঝবে।

রকিব সিগারেট ধরিয়ে মহা সুখে টানতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে বাড়ি তারও পছন্দ হয়েছে। পুষ্প মনে-মনে বাড়ি সাজাতেও শুরু করেছে। সুন্দর করে পর্দা দেবে। কয়েকটা বেতের চেয়ার কিনবে। বাসনপত্র কিনবে। জমানো টাকার কিছুটা সে খরচ করবে। একটা ফ্যান কিনতে হবে। সিলিং ফ্যানের কী রকম দাম কে জানে। বলতে গেলে এই প্রথম তার নিজের সংসার। বিয়ের পর দু বছর কাটল শ্বশুরের সঙ্গে ময়মনসিংহে। রকিব আসত সপ্তাহে-সপ্তাহে। কী কষ্ট বেচারার। খাওয়ার কষ্ট। একাএকা থাকার কষ্ট। ঢাকায় ফিরে যাবার সময় কী যে মন-খারাপ করত।

পুষ্প।কি? বাইরে খাবে? কোথায়? কোনো একটা রেস্তোরাঁয়? কী যে তুমি বল।চল যাই। মাঝেমধ্যে একটু বাইরে খাওয়া দরকার। রোজ-রোজ ঘরের খাওয়া একঘেয়ে হয়ে যায়। চল, নানরুটি আর কাবাব খাই।মাত্র তো সন্ধ্যা! এখন নানরুটি আর কাবাব খাবে? নিউ মার্কেটে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি, তারপর না-হয় যাব।আর বাবু? বাবুর কী হবে? কী আর হবে?

যারা নিয়েছে তারা দেখবে। মজা বুঝক। ভবিষ্যতে তা হলে আর নেবে না।নিউ মার্কেটে তারা বেশ খানিকক্ষণ ধুরল। ঠাণ্ডা পেপসি খেল। পুষ্পকে খুবই অবাক করে দিয়ে রকিব একটা শাড়ি কিনে ফেলল। নীল ফুলের ছাপ দেওয়া সুতি শাড়ি। এতেই আনন্দে পুষ্পের চোখে পানি এসে যাবার মত হল। পুষ্প বলল, বাবুর জন্যে কিছু কিনবে না? কোন খেলনাটেলনা? আরে, ও খেলনার কী বোঝে। খেলনার সময় হোক, কিনে দেব।নিশাত ঘুমন্ত পল্টুকে তার বিছানায় শুইয়েছে। জহির বলল, নিচে একটা অয়েলক্লথ দরকার না? আমার তো মনে হচ্ছে বিছানা ভাসিয়ে দেবে।নিশাত বলল, অয়েলথ এখন পাব কোথায়?

ওর বাবা-মার আক্কেলটা দেখ না। রাত নটা বাজে, এখনো ট্রেস নেই।দুজনে মিলে বেড়াচ্ছে। সুযোগ হয় না বোধহয়। তোমাকে কফি করে দেব? না।খুব কঠিন স্বরে না বললে। তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ? রাগ করব কেন? এই যে পরের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা করছি।তা কিছুটা অবশ্যি করছ। তোমার যখন এত শখ–লেট আস হ্যাভ অ্যা বেবি। ওটা তো তেমন কঠিন কিছু না।নিশাত কিছু বলল না।জহির বলল, আমি অবশ্যি এখনন আমাদের অরিজিন্যাল প্ল্যানে বিশ্বাসী। প্রথম পাঁচ বছর ঝামেলাহীন জীবন। দু জন শুধু থাকব, ঘুরে বেড়াব। এক জন অন্য জনকে ভালোমতো জানব……….

এখনন আমাকে জানতে পার নি? না।কোন জিনিসটা জানবার বাকি আছে? তোমার মুডের ব্যাপারটা জানি না। অতি দ্রুত তোমার মুড পাল্টায়। কখন কি জন্যে পাল্টায় সেটা ঠিক ধরতে পারি না। কিছুটা রহস্য থেকেই যায়।কিছু রহস্য থাকাই তো ভালো। জীবন থেকে রহস্য চলে গেলে তো মুশকিল।জহির বলল, এক কাপ কফি খাওয়া যেতে পারে।নিশাত রান্নাঘরে ঢুকে পারকুলেটর চালু করল। আর ঠিক তখন কলিংবেল বাজল। পুষ্প এসেছে হয়ত। নিশাত নড়ল না। জহির দরজা খুলে দেবে। ঠিক এই মুহূর্তে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে এসে তার বাচ্চা নিয়ে চলে যাক। জহির ঠিকই বলেছে, তার মুড খুব দ্রুত পাল্টায়। এত দ্রুত যে তার সঙ্গে তাল রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে।

আপা।এস পুষ্প।বাবুকে নিতে এলাম। আমরা আবার বাড়ি দেখতে চলে গিয়েছিলাম।তাই নাকি? জ্বি। বাসা পছন্দ করে এসেছি। হাফ বিল্ডিং, উপরে টিনের ছাদ।টিনের ছাদও বর্ষাকালে খুব মজা হবে। ঝুমঝম করে টিনের ছাদে বৃষ্টি হবে। কফি খাবে পুষ্প? খাব। আমরা আজ বাইরে খেয়ে এসেছি। ও বলল, চল বাইরে খাই।খুব ভালো করেছ।আবার কি মনে করে যেন আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিল। টাকাপয়সার এ-রকম টানাটানি, এর মধ্যে আবার হঠাৎ শাড়ি। শাড়িটা দেখবেন আপা? নিয়ে আসি?

আন।পুষ্প কফির কাপ নামিয়ে ঝড়ের মতো ছুটে গেল। যাবার সময় বাবুকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। জহির পাশেই ছিল। জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত করেছে।জহির হালকা গলায় বলল, আমাকে কোনো বিরক্ত করে নি। নিশাতকে হয়তো বা করেছে। আমি ঠিক জানি না। জহিরের মনে হল দরে থেকে মেয়েটাকে গেঁয়ো মনে হলেও মেয়েটা গেঁয়ো নয়। তার মধ্যে স্বাভাবিক একটা সহজ ভাব আছে, এবং মেয়েটি রূপবতী। নিশাতও রূপবতী, তবে নিশাতের রূপে কেমন একটা ঠাণ্ডা ভাব আছে। এর মধ্যে সেই শীতল ভাবটা নেই।নিশাত পুষ্পের জন্য অপেক্ষা করছে। দু চুমুক দিয়ে সে কফির কাপ নামিয়ে রেখে গেছে। কফি ঠাণ্ডা হচ্ছে। কাপটা কি একটা পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখবে?

ঐ মহিলা তোমাকে ভাবি না ডেকে আপা ডাকে কেন? জানি না কেন।মেয়েটিকে কথাবার্তায় খুব গেঁয়ো কিন্তু মনে হয় না।গেয়ো বলতে তুমি কী মীন করছ? রাস্টিক। রিফাইনমেন্টের অভাব। আরো ব্যাখ্যা চাও? নিশাত কিছু বলল না।দাঁড়াও, আরেকটা ব্যাখ্যা দিই। মনে কর একটা প্লেটে লাল টুকটুকে একটা আপেল। এক জন সেই আপেলের সৌন্দর্য প্রথম দেখবে, অন্য জন আপেলটাকে দেখবে শুধুই খাদ্য হিসেবে।আপা আসব? এস, তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।আমি কফি খাব না আপা, ভালো লাগে না।

পুষ্পের হাতে শাড়ির প্যাকেট। সে অস্বস্তি বোধ করছে। আড়চোখে তাকাচ্ছে। জহিরের দিকে। এই মানুষটির সামনে শাড়ির প্যাকেট খোলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। নিশাত জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি দয়া করে পাশের ঘরে যাবে? আমরা একটা মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে আলাপ করব, তোমার হয়ত ভালো লাগবে না।জহির পাশের ঘরে চলে গেল। দরজা ভিড়িয়ে দিল। নিশাত নিজেই শাড়ির প্যাকেট খুলছে।বাহ্, চমৎকার তো! বাংলাদেশে শাড়ির ডিজাইন অনেক উন্নত হয়েছে। সিম্পলের মধ্যে এরা ভালো জিনিস করছে।আপনার পছন্দ হয়েছে আপা?

খুব পছন্দ হয়েছে। চমৎকার! নীল ব্যাকগ্রাউণ্ডে সাদা ফুল থাকলে মনে হয় আরো সুন্দর হত। আকাশে তারা ফুটে আছে, এরকম একটা এফেক্ট পাওয়া যেত। আমি বেশ কটা শাড়ির ডিজাইন জমা দিয়েছিলাম বিসিকে। একবার খোঁজ নিতে হবে ওরা নিল কি না।আপনি শাড়ির ডিজাইন জমা দিয়েছিলেন? ও মা, কী বলছেন।কেন জমা দেব না। আমি কমার্শিয়াল আর্টের ছাত্রী। একদিন তোমাকে আমার আঁকা ছবি দেখাব।পুষ্প মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। নিশাত সেই মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আরেক বার মনে-মনে বলল, কী সুন্দর মেয়েটি।

 

Read more

প্রিয়তমেষু পর্ব:০৩ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *