সত্যজিৎ রায় এর ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-২৭)

হরিদ্বার যেতে হয় ডুন এক্সপ্রেসে। লখনৌ থেকে সন্ধ্যায় গাড়ি ছাড়ে, আর হরিদ্বার পৌঁছায়  সাড়ে চারটায়। লখনৌ আসার আগে যখন হরিদ্বার যাবার কথা হয় তখন আমার খুব মজা লেগেছিল।

ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ডকারণ পুরী ছাড়া আমি কোনও তীর্থস্থান দেখিনি। কিন্তু লখনৌতে এসে আংটির ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় আর সে রহস্যের এখনও কোনও সমাধান না হওয়ায়, আমার এখন আর লখনো ছেড়ে যেতে খুব বেশি ইচ্ছা করছিল না। | কিন্তু ফেলুদার দেখলাম উৎসাহের কোনও অভাব নেই। ও বলল, হরিদ্বার, হৃষীকেশ আর লছমনঝুলা–এই তিনটে জায়গা পর পর দেখতে দেখবি কেমন ইন্টারেস্টিং লাগে। কারণ তিন জায়গার গঙ্গা দেখবি তিন রকম।

যত উত্তরে যাবি তত দেখবি নদীর ফোর্স বেড়ে যাচ্ছে। আর ফাইন্যালি লছমনঝুলায় গিয়ে দেখবি একেবারে উত্তাল পাহাড়ে নদী। তোড়ের শব্দে প্রায় কথাই শােনা যায় না।’ আমি বললাম, তােমার এ সব দেখা আছে বুঝি ? ‘সেই যেবার ক্রিকেট খেলতে লখনৌ এলাম, সেবারই দেখা সেরে গেছি।’ 

ধীরুকাকা অবিশ্যি আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না, তবে উনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের সকলকে স্টেশনে নিয়ে এলেন। কামরাতে মালপত্র রাখতে না রাখতে আরেকজন ভদ্রলােক এসে পড়লেন, তিনি হচ্ছেন ডাঃ শ্রীবাস্তব। আমি ভাবলাম উনিও বুঝি ধীরুকাকার মতাে সি-অফ করতে এসেছেন, কিন্তু তারপর দেখলাম, কুলির মাথা থেকে সুটকেস নামাচ্ছেন। আমাদের সকলেরই অবাক ভাব দেখে শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘ধীরুবাবুকে বলিয়েছিলাম যেন আপনাদের না বােলেম। উনি জানতেন আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বােলেন তো! +

ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-২৭)

বাবা দেখলাম খুশি হয়েই বললেন, ‘খুব ভালই হল। আমি ভাবতে পারিনি আপনি আসতে পারবেন, তা না হলে আমি নিজেই আপনাকে বলতাম। | শ্রীবাস্তব বেঞ্চির একটা কোণ ঝেড়ে সেখানে বসে বললেন, ‘সত্যি জানেন কী–কদিন বড় ওয়ারিড আছি। আমাকে বাইরে থেকে দেখলে বুঝতে পারবে না । পিয়ারিলালের দেওয়া জিনিসটা এইভাবে গেল—ভাবলে বড় খারাপ লাগে। শহর ছেড়ে দুদিনের জন্য আপনাদের সঙ্গে ঘুরে আসতে পারলে খানিকটা শান্তি পাব।’ 

পাঁচ মিনিটের মধ্যে বনবিহারীবাবুও এসে পড়লেন। তাঁর মালপত্তর যেন একজনের পক্ষে একটু বেশিই মনে হল। ভদ্রলােক হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, এইবার রগড় দেখবেন। পবিত্ৰানন্দস্বামী চলেছেন এ-গাড়িতে। তাঁর ভক্তরা তাঁকে বিদায় দিতে আসছেন। ভক্তির বহরটা দেখবেন এবার।’ 

 সত্যিই, কিছুক্ষণ পরে অনেক লােকজন ফুলের মালাটালা নিয়ে একজন মােটামতাে গেরুয়াপরা লম্বা চুলওয়ালা সন্ন্যাসী এসে আমাদের পাশের ফার্স্টক্লাস গাড়িটায় উঠলেন। ওঁর সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন গেরুয়াপরা লােক উঠল–আর কিছু গেরুয়াপরা, আর অনেক এমনি পােশাক পরা লােক কামরার সামনে ভিড় করে দাঁড়াল।

বুঝলাম এরাই সব ভক্তের গাড়ি ছাড়তে আর পাঁচ মিনিট দেরি, তাই আমরা সব উঠে পড়েছি, ধীরুকাকা কেবল জানালার বাইরে থেকে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন, এমন সময় একজন গেরুয়া পরা লােক হঠাৎ ধীরুকাকার দিকে হাসিহাসি মুখ করে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল। ‘ধীরেন না ? চিনতে পারছ ? 

ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-২৭)

ধীরুকাকা কিছুক্ষণ হতভম্বের মতাে চেয়ে থেকে, হঠাৎ—“অম্বিকা নাকি ?’বলে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলােককে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। বাপরে বাপ!-তােমার আবার এ-পোশাক কী হে ? | ‘কেন, এ তাে প্রায় সাত বছর হতে চলল।’ ধীরুকাকা তখন ভদ্রলােকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অম্বিকা হল আমার স্কুলের সহপাঠী।

প্রায় পনেরাে বছর পরে দেখা ওর সঙ্গে। গার্ড হুইসল দিয়েছে। ঘ্যাঁচ করে গাড়ি ছাড়ার শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই শুনতে পেলাম অম্বিকাবাবু ধীকাকাকে বলছেন, “আরে, সেদিন বিকেলে তােমার বাড়ি গিয়ে প্রায় আধঘণ্টা বসে রইলাম। তুমি ছিলে না। তােমার বেয়ারা তোমাকে সে কথা বলেনি ?

ধীরুকাকা কী উত্তর দিলেন সেটা আর শােনা গেল না, কারণ গাড়ি তখন ছেড়ে দিয়েছে।আমি অবাক হয়ে প্রথমে ফেলুদা, আর তারপর বাবার দিকে চাইলাম। ফেলুদার কপালে দারুণ ভূকুটি । বাবা বললেন, ‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ। বনবিহারীবাবু বললেন, ওই ভদ্রলােককেই কি আপনারা আংটিচোর বলে সাসপেক্ট করছিলেন ? বাবা বললেন, ‘সে-প্রশ্ন অবিশ্যি আর ওঠে না। কিন্তু আংটিটা তা হলে গেল কোথায় ? কে নিল ? 

ট্রেনটা ঘটাং ঘটাং করে লখনৌ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে বেরােল। স্টেশনের মাথার গম্বুজগুলাে ভারী সুন্দর দেখতে, কিন্তু এখন আর ও সব যেন চোখেই পড়ছিল না। মাথার মধ্যে সব যেন কীরকম গণ্ডগােল হয়ে যাচ্ছিল। ফেলুদা নিশ্চয়ই মনে মনে খুব অপ্রস্তুত বােধ করছে। ও-তাে সেই সন্ন্যাসীর খোঁজ নিতে নিতে একেবারে লখনৌ সেন্টশন অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। 

কিন্তু তা হলে স্টেশনের সেই অ্যাটাচি-কেসওয়াল সন্ন্যাসী কে ? আজকে যাকে দেখলাম সে তাে আর ছদ্মবেশধারী সন্ন্যাসী নয়—একেবারে সত্যিকার সন্ন্যাসী । সে কি তা হলে আরেকজন লােক ?  সেও কি ধীরুকাকার বাড়ির আশেপাশে ঘােরাফেরা করছিল ? আর সেটার কারণ কি এই আংটি, না অন্য কিছু ? আর ফেলুদার গায়ে ‘খুব হুঁশিয়ার’ লেখা কাগজ কে ছুঁড়ে মেরেছিল—আর কেন ?

ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-২৭)

মেলুদার মাথাতে কি এখন এই সব প্রশ্নই ঘুরছেনা সে অন্য কিছু ভাবছে ? ওর দিকে চেয়ে দেখি ও সেই গ্রিক অক্ষরে হিজিবিজি লেখা খাতাটা বার করে খুব মন দিয়ে পড়ছে—আর মাঝে মাঝে কলম দিয়ে আরও কী সব জানি লিখছে । বনবিহারীবাৰু হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন : “আচ্ছা, ডক্টর শ্রীবাস্তব–পিয়ারিলাল মারা যাবার আগে আপনিই বােধহয় শেষ তাঁকে দেখেছিলেন, তাই না ?’ শ্রীবাস্তব একটা থলি থেকে কমলালেবু বার করে সকলকে একটা একটা করে দিতে দিতে 

বললেন, ‘আমি ছিলাম, ওনার বিধবা বােন ছিলেন, ওনার বেয়ারা ছিল, আর অন্য একটি চাকরও ছিল। | বনবিহারীবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ই। …ওঁর অ্যাটাকটা হবার পর আপনাকে খবর দিয়ে আনানাে হয় ? “আজ্ঞে হ্যাঁ। ‘আপনি কি হার্টের চিকিৎসাও করেন ? ‘হাড়ের চিকিৎসা করলে হার্টের যে করা যায় না এমন তাে নয় বনবিহারীবাবু ! আর ওঁর ডাক্তার গ্ৰেহ্যাম শহরে ছিলেন না, তাই আমাকে ডেকেছিলেন। 

কে ডেকেছিল ? ‘ওঁর বেয়ারা। ‘বেয়ারা ? বনবিহারীবাবু ভ্ৰ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন। ‘হ্যাঁ! প্রীতম সিং। অনেক দিনের লােক ! খুব বুদ্ধিমান, বিশ্বস্ত, কাজের লােক। বনবিহারীবাৰু মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কমলালেবুর একটা কোয়া মুখে পুরে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বলেছেন পিয়ারিলাল আংটিটা দিয়েছেন প্রথম অ্যাটাকের পর। আর দ্বিতীয় অ্যাটাকের পর আপনাকে ডাকা হয়, আর সেই অ্যাটাকেই তাঁর মৃত্যু হয়। ‘ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। ‘আংটিটা দেবার সময় ঘরে কেউ ছিল কি ? 

‘তা কী করে থাকবে বনবিহারীবাবু ? এ সব কাজ কি আর বাইরের লােকের সামনে কেউ করে ? বিশেষ করে পিয়ারিলাল কী রকম লােক ছিলেন তা তাে আপনি জানেন। ঢাক বাজিয়ে নােবল কাজ করার লােক তিনি একেবারেই ছিলেন না। ওনার কত সিক্রেট চ্যারিটি আছে তা জানেন ? লাখ লাখ টাকা হাসপাতালে অনাথাশ্রমে দান করেছেন, অথচ কোনও কাগজে তার বিষয়ে কখনও কিছু বেরােয়নি। 

ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-২৭)

শ্রীবাস্তব বনবিহারীবাবুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, আপনি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছেন ? বনবিহারীবাবু বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন—এই আংটি দেওয়ার ঘটনার অন্তত একজন সাক্ষী রাখলে আপনি বুদ্ধিমানের কাজ করতেন। এমন একটা মূল্যবান জিনিস হাত বদল হল–অথচ কেউ জানতে পারল না । শ্রীবাস্তব একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে হঠাৎ হাে হাে করে হেসে বললেন, “বাঃ বনবিহারীবাবু, বাঃ । আমি পিয়ারিলালের আংটি চুরি করলাম, আমিই ধীরেনবাবুর কাছে সেটা রাখলাম, আবার আমিই সেটা ধীরেনবাবুর বাড়ি থেকে চুরি করলাম ? ওয়ান্ডারফুল ! 

বনবিহারীবাবু তাঁর মুখের ভাব একটুও না বদলিয়ে বললেন, ‘আপনি বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন। আমি হলেও তাই করতাম। কারণ আপনার বাড়িতে ডাকাত পড়াতে আপনি সত্যিই ভয় পেয়েছিলেন, তাই আংটিটা ধীরুবাবুর কাছে রাখতে দিয়েছিলেন। 

 

Read More

সত্যজিৎ রায় এর ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-২৮)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *