বলপয়েন্ট পর্ব-০৭ হুমায়ূন আহমেদ

বলপয়েন্ট

প্রফেসর জেনো উইকস আমার প্রফেসরদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আমি আমার লেখক পরিচয় দিয়েছিলাম। গুলতেকিন তার সঙ্গে দেশ থেকে আমার প্রতিটি বইয়ের কয়েকটা করে কপি নিয়ে এসেছিল। আমি তাঁকে বইগুলি দেখালাম। তিনি বললেন, কোন ভাষায় লেখা? আমি বললাম, বাংলা। তিনি বললেন, তোমাদের অক্ষরগুলি তো চায়নিজদের চেয়েও জটিল। বসো আমার সামনে। আমি বসলাম। তিনি ল্যাবরেটরির সব ছাত্রছাত্রীকে ডেকে পাঠালেন।

আমাকে লজ্জায় ফেলে আমার লেখক পরিচয় দিলেন।তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, পড়ে শোনাও।আমি বললাম, স্যার, কেউ তো কিছু বুঝবে না।প্রফেসর বললেন, না বুঝলে নাই। তোমাকে পড়তে বলছি তুমি পড়। আমি শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসের কয়েক পৃষ্ঠা পড়লাম। আমার প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তিনি খুবই আনন্দ পাচ্ছেন। পাঠ শেষ হলে প্রফেসর ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন লাগল?

কেউ কিছু বলল না, সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।শুধু কোরিয়ান ছাত্র ‘হান’ বলল—মনে হচ্ছে মাথার ভেতর কিছু ছোট ছোট পোকা ঢুকে কিলবিল করছিল। প্রফেসর বললেন, এই লেখক সপরিবারে আজ রাতে আমার বাসায় ডিনার করবে। তোমাদের নিমন্ত্রণ। A special night with a writer. দেশে ফিরে আমি আমার একটা বই উৎসর্গ করলাম প্রফেসর জেনো উইকসকে। সেই বই তাঁকে পাঠাই নি এবং খবরটাও জানাই নি। আমি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা আমার পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়েছি। এটাই যথেষ্ট।

১২.

যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়, তারা দেশে ফিরে ডিগ্রি নিয়ে। কেউ M.S কেউ Ph.D. আমি একটা Ph.D এবং সঙ্গে নতুন দুটি মেয়ে নিয়ে দেশে ফিরলাম। শীলা এবং বিপাশা। বিপাশার তখনো জন্ম হয় নি। সে তার মায়ের পেটে। শীলার মা দেশে ফেরাটা নিতে পারছিল না।তার কথা, দেশে আমি যা বেতন পাব তা দিয়ে সবাইকে তিনবেলা খাওয়াবার সামর্থ্যও থাকবে না। আমার

একটাই যুক্তি, বিদেশে পড়াশোনা করতে এসেছি।পড়াশোনা শেষ–এখন দেশে ফিরব। অন্যদের মতো বিদেশে স্থায়ী হব না। যে দেশের স্বাধীনতার জন্যে আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, সে দেশকে অস্বীকার করে অন্যদেশের নাগরিকত্ব আমি নিতে পারব না। খুব খারাপ অবস্থায় দেশে ফিরলাম। পকেটে আমেরিকার

দীর্ঘ প্রবাস জীবনের সঞ্চয় দুশ ইউএস ডলার। একটা ফ্রিজও কিনেছিলাম। সেই ফ্রিজ জাহাজে করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। যে সময়ের কথা বলছি তখন বিদেশফেরতরা ফ্রিজ এবং টেলিভিশন আনতেন।টেলিভিশন কেনার টাকা ছিল না বলে শুধুই ফ্রিজ।দেশে ফিরে আমার বড় মেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলো। যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। শুধু থালা হাতে নিরন্ন মানুষের দল

বাড়িতে আসছে ভাতের জন্যে এই দৃশ্য সে নিতে পারল না। তার ক্ষুদ্র জীবনে এই দৃশ্য সে দেখে নি। তার একটাই প্রশ্ন, এদের ফুড নেই কেন? বাসায় কোনো ভিখিরি এলেই নোভা দৌড়ে যেত রান্নাঘরে। যা পেত একটা থালায় সাজিয়ে ছুটে যেত নিচে। আমাকে যে প্রশ্ন করত এই প্রশ্ন সে ভিখিরিদেরও করত। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইত, তোমাদের বাসায় ফুড নেই কেন?

বড় মেয়েটির এই কাণ্ড তার দাদি খুব পছন্দ করতেন। তিনি তাকে ডাকতেন মাদার তেরেসা নামে।আমেরিকা থেকে ফিরে নুরজাহান রোডের একটা বাসায় উঠলাম। একটা ঘরে আমার পরিবার। অন্য ঘরে আমার মা, শাহীন এবং ছোটবোন মনি। আমার ঘরে একটা খাট পাতার পর আর জায়গা হয় না। সেই খাটে আমার পরিবারের সবার জায়গা হয় না। আমরা ঘুমাই আড়াআড়ি (ময়মনসিংহের ভাষায় ফাত্তাইরা হয়ে)।বাসায় কোনো টেলিভিশন নেই। নোভা-শীলা টেলিভিশন দেখার জন্যে পাশের ফ্ল্যাটে যায়! টেলিভিশনে বাংলাদেশ প্রোগ্রাম দেখতে তাদের না- কি খুব ভালো লাগে। তখন এত চ্যানেল হয় নি। বিটিভি সবেধন নীলমণি।

এক রাতের কথা। মেয়েরা খুব আগ্রহ করে টিভি দেখতে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে এসে জানালো, ঐ ফ্ল্যাটে মেহমান এসেছে। কাজেই তাদেরকে আজ টিভি দেখতে দেয়া হবে না। বাচ্চারা খুবই মন খারাপ করল। তাদের চেয়েও মন খারাপ করল বাচ্চাদের মা। কেন বাংলাদেশে এসেছি? কী পাচ্ছি বাংলাদেশে? একটা টিভি কেনার সামর্থ্য নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। রাতে ভাত খাবার সময় বড় মেয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাদের একটা টিভি কিনে দেবে? আমি বললাম, দেব।রঙিন টিভি? আমি বললাম, অবশ্যই রঙিন টিভি। কবে কিনে দেবে?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। তবে একটা রঙিন টিভি যেভাবেই হোক কিনতে হবে এটা মাথায় ঢুকে গেল।বিটিভির নওয়াজীশ আলি খান সাহেবের সঙ্গে তখন আমার সামান্য পরিচয় হয়েছে। আমার একটি নাটক তিনি বিটিভিতে প্রচার করেছেন। নাম খুব সম্ভব ‘প্রথম প্রহর’।তিনি আমাকে একটি ধারাবাহিক নাটক লিখতে বলছেন। আমি ধারাবাহিক নাটক লিখতে রাজি হলাম। ঠিক করলাম, একটি রঙিন টিভি কিনতে যত টাকা লাগে তত টাকার ধারাবাহিক নাটক লেখা হবে। যে নাটকটি লিখলাম তার নাম ‘এইসব দিনরাত্রি’।

নাটকটির পরিচালক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। আমার রঙিন টিভি কেনার টাকা হওয়া মাত্র নাটকের একটি চরিত্র টুনির মৃত্যু দিয়ে নাটক শেষ করে দিলাম। এই নাটকটির প্রতি আমি নানাভাবে ঋণী। নাটকটির কারণে আমি আমার বাচ্চাদের একটা শখ মিটালাম— রঙিন টিভি কিনলাম।একটিমাত্র ধারাবাহিক নাটকের কারণে দর্শকদের কাছে হুমায়ূন আহমেদ নামটি পরিচিতি পেল। তারা এই নাট্যকারের লেখা গল্প-উপন্যাস হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করল।

এই নাটক প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি। মুস্তাফিজুর রহমান সাহেব একদিন টেলিফোনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। একটা মজার জিনিস না-কি দেখাবেন। আমি মজার জিনিস দেখতে গেলাম।মুস্তাফিজ সাহেব বললেন, একতলায় আমাদের একটা বিলবোর্ড আছে। বিলবোর্ডটা দেখে আসুন। আনন্দ পাবেন। আনন্দ পাবার জন্যে বিলবোর্ড দেখতে গেলাম এবং আনন্দ পেলাম। বিলবোর্ডে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত Statesman পত্রিকার একটি খবর সেঁটে দেয়া আছে। সেখানে লেখা আজ রাতে এইসব দিনরাত্রির শেষ পর্ব প্রচার হবে। এরপর আমরা কী দেখব? বিটিভিতে নাটক লিখে খুব আনন্দ পেয়েছি। একের পর

এক ধারাবাহিক নাটক—অয়োময়, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই। ঈদের হাসির নাটক। এক ঘণ্টার নাটক। আমি খুব সূক্ষ্মভাবে নাটকের ভাষা বদলানোর একটা চেষ্টা চালালাম। আগে কোলকাতার ভাষা (নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা বলাই ঠিক হবে) ছিল বিটিভি নাটকের ভাষা। যাই নি, খাই নি, জুতো, নৌকো। আমি চেষ্টা করলাম ঢাকার ভাষা বলে আলাদা কিছু দাঁড়া করাতে।

আমার ধারণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি।আজকের নাটকের ভাষা নদীয়া-শান্তিপুর মুক্ত।বিটিভির একটি কর্মকাণ্ডে আহত হয়েছিলাম। বলপয়েন্ট লেখা মানেই আনন্দ অভিজ্ঞতার বয়ান না। মনোকষ্টের বয়ানও তো বটে! বিটিভি তার পঁচিশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে রজতজয়ন্তির বিশাল অনুষ্ঠান করছে। পনেরোদিন ধরে অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বিটিভির নানান দিকের সাফল্য

তুলে ধরা হচ্ছে। সেই বিপুল উৎসবে একটি নাম অনুচ্চারিত হুমায়ূন আহমেদ। অথচ তখন আমার সব কটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত। টিভি নাটকে আমি কী করেছি কতটুকু করেছি তা ‘বিটিভি’র কর্তাব্যক্তিরা জানেন। আমি এক কর্তাব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, আমি তো আপনাদের ‘ভাসুর’ না। আমার নাম মুখে নিতে সমস্যা কী ছিল?

তিনি বললেন, আপনি খুব ভালোভাবেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। পরে আপনাকে বাদ দেয়া হয়েছে।আমি বললাম, কেন? কর্তাব্যক্তি মধুর ভঙ্গিতে হাসলেন। কিছু বললেন না। বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে প্রচুর আছে। সাহিত্যের অধ্যাপকদের অনেক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সাহিত্য। সেখানে সবাই আছে, আমি নেই। হতেই পারে সাহিত্যের অধ্যাপকরা আমাকে লেখক মনে করেন না।

এমন একজন মনে করেন যে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন করেন।তাদের কাছে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন মানে সাহিত্যের মহান বোধের অবমাননা। এই নিয়ে আমি ঝামেলাতেও পড়েছি। উদাহরণ দেই— এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিক নাটকটি প্রচার হবার পর এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এই ধারাবাহিক নাটকটি লেখার পেছনে আপনার মূল প্রেরণ কী ছিল? আমি বললাম, অর্থ উপার্জন। আমার একটি রঙিন টিভি কেনার প্রয়োজন ছিল বলেই ধারাবাহিক নাটকটি লিখেছি।

সাক্ষাৎকার প্রচার হবার পরপরই এই নাটকে যারা অভিনয় করেছেন তারা আহত হলেন। বিশেষভাবে রাগলেন প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি বললেন, আমরা এত আবেগ নিয়ে এই নাটকে অভিনয় করেছি, আর হুমায়ুন আহমেদ বলে দিলেন তিনি সামান্য একটা রঙিন টিভির জন্যে নাটক লিখেছেন। অভিনেতাদের তপ্ত বক্তব্য পত্রিকায় ছাপা হাতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন আমি আবুল খায়ের সাহেবকে ডেকে পাঠালাম। আমি বললাম, ভাই, আপনি যে অভিনয় করেছেন তার জন্যে কি বিটিভির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?

তিনি বললেন, হ্যাঁ নিয়েছি।আমি বললাম, আমিও ঠিক তাই করেছি। নাটক লেখার জন্যে টাকা নিয়েছি। আপনি হৈচৈ করছেন কেন? একজন লেখক চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচেন না। তাকে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট খেতে হয়। আপনি কেন বললেন, রঙিন টিভি কেনার জন্যে নাটক লিখেছেন? যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। আপনাকে ডেকেছি রঙিন টিভিটা দেখার জন্য। নিজের চোখে দেখুন আমার বাচ্চারা কত আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখছে।

বেতনের টাকা দিয়ে বাচ্চাদের এই টিভিটা কিনে দেবার সামর্থ্য আমার ছিল না।আবুল খায়ের সাহেব খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার বাচ্চাদের সঙ্গে টিভি দেখলেন। একসময় তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভুল করেছি। ক্ষমা চাই।খায়ের ভাইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। নতুন কোনো নাটক বানাতে গেলেই আমার তার কথা মনে পড়ে। খায়ের ভাইয়ের সমকক্ষ অভিনেতা বাংলাদেশে আছে বলে আমি মনে করি না।

১৩.

বলপয়েন্টে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। এই ঘটনার পর এই ঘটনা ঘটল লিখে লেখকজীবনের ইতিহাস লেখায় আমি যাচ্ছি না। যখন যা মনে আসছে তাই লিখছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার নেই। চিঠিপত্র বা ফটোগ্রাফ জমানোর মধ্যেও নেই। আমার সমস্ত সঞ্চয়ই স্মৃতিতে। আমার মৃত্যুর পর পত্রিকাওয়ালারা একটা সমস্যায় পড়বেন। ‘হুমায়ূন আহমেদের ডায়েরি’ বা ‘অপ্রকাশিত জার্নাল’ নামে কিছু ছাপাতে পারবেন না।সাহিত্যের লাইনের গ্রান্ডমাস্টারদের কেউ কেউ আমাকে চিঠি লিখেছেন। সেইসব চিঠিও জমা করে রাখি নি।

আমার মানসিকতায় নিঃসঙ্গতা ব্যাধি আছে।নিঃসঙ্গতা ব্যধিগ্রস্তরা তাদের পাশে কিছুই জমা করতে ভালোবাসে না। প্রাণপণ চেষ্টা করে সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে। উদাহরণ দেই। ঔপন্যাসিক বিমল মিত্র এসেছেন বাংলাদেশে। উঠেছেন সোনারগাঁও হোটেলে। কৈশোরে বিমল মিত্রের বিশাল বই কড়ি দিয়ে কিনলাম খাটের তলায় বসে পড়ে শেষ করেছি। ক্ষণে ক্ষণে অশ্রুবর্ষণ করেছি।

সবার সামনে এই বই পড়ার উপায় ছিল না, কারণ Out book হিসেবে একজন কিশোরের কাছে সেই। বই নিষিদ্ধ।কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম-এর বিমল মিত্র ঢাকায় শুনেই ভালো লাগল। এক সন্ধ্যায় বিমল মিত্রের কাছ থেকে টেলিফোন, হুমায়ূন, আসো আমার সঙ্গে দেখা করে যাও। আমার আনন্দিত হয়ে ছুটে যাওয়া দরকার ছিল। তা না করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি কারোর সঙ্গে দেখা করি না।

আমি আসছি না। আপনি কিছু মনে করবেন না। যত বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলি বলা হোক, বিমল মিত্রের কাছে তা সুখকর নিশ্চয়ই ছিল না। আমার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা—-লেখককে চিনব তার লেখা দিয়ে।ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনার কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব লেখকের প্রতি আমার একধরনের বিরাগও ছিল।তারা পিঠ চাপড়ানো কথা বলতে ভালোবাসেন। নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবেন। বাংলাদেশের লেখকদের জল-চল জাতের উপরে কিছু ভাবেন না।এখনো যে সেই অবস্থার ইতরবিশেষ হয়েছে তা-না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম ঢাকায় আসার ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। চারদিকে ফিসফাস ভাব। সুনীল এসেছেন। পাঠকদের হাত থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। খবর পেলেই পাঠকরা প্রিয় লেখকের ওপর হামলে পড়বেন। তিনি কোথায় আছেন তা সম্পূর্ণ গোপন। যাদের সঙ্গে আছেন তারা মহাভাগ্যবান।হিসেবে চিহ্নিত। তারা কিছু Exclusive পার্টির ব্যবস্থা করছেন। অতি ভাগ্যবানরা সেই পার্টিতে যাবার সুযোগ পাচ্ছেন। আমি তেমন এক পার্টিতে যাবার সুযোগ পেলাম।

জনৈক প্রকাশকের বাড়িতে পার্টি। আমাকে কয়েকবার টেলিফোনে জানানো হলো যেন একা যাই। কাউকে সঙ্গে না নিয়ে যাই। এবং ঘটনাটা প্রচার না করি। প্রচার হয়ে গেলে জনতা সামলানো কঠিন হবে। ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম দেখলাম। হাতে সিগারেট এবং হুইস্কির গ্লাস। আশেপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হলো না। তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সুনীলের পাশে বসেন নি। তার হাতে কোনো গ্লাস নেই। তাঁকে খানিকটা বিব্রত মনে হচ্ছে। ঘরে আলো কম।

অন্য ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। কঠিন পরিবেশ যাকে বলে। পার্টিতে নিমন্ত্রণপ্রাপ্তরা বেশিরভাগই লেখক। তারা তাদের সব বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। বই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। তিনি পাতা উল্টে পাশে রেখে দিচ্ছেন। সাহিত্য এবং কাব্য আলোচনা চলছে। এমন কৃত্রিম কথাবার্তা এবং আচরণ আমি আমার জীবনে কম দেখেছি। শুরু হলো ফটোসেশন।একেকজন লেখক যাচ্ছেন, নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ফিরছেন। মন ভরছে না। তিনি আবারো যাচ্ছেন।

গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণায়মান উপগ্রহদের ভেদ করে আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। তাকে দেবার জন্যে আমি আমার একটা উপন্যাস নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা তাঁকে দেয়া হলো না। গোপনে ফেরত নিয়ে চলে এলাম। আসরে ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের ব্যবহার একটু অদ্ভুত মনে হলো। সে দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সমানে তুমি তুমি করে সম্বোধন করছে। সমরেশ মজুমদার একবার এলেন। মিলন তাঁকেও দেখি তুমি করে বলছে।একদিন মিলনকে বললাম, এঁরা বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। তুমি অবলীলায় তাদের তুমি বলছ কীভাবে?

মিলনের উত্তর শুনে আনন্দ পেলাম। সে বলল, হুমায়ূন ভাই, এঁরা বাংলাদেশে এসে সবাইকে তুমি তুমি করেন। কাজেই আমিও করি। সম্বোধনে সমান সমান। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কাউকেই তুমি করে বলতে পারি না। তুমি তুমি বলার বন্ধু আমার নেই। সবার সঙ্গেই ফর্মাল সম্পর্ক। একদিন শাওন বলল, তোমার যে কোনো বন্ধু নেই এটা কি তুমি জানো? তোমার পরিচিতজন আছে, বন্ধু নেই। তুমি অতি নিঃসঙ্গ মানুষদের একজন।

আমি চিন্তা করে দেখলাম ঘটনা তো সেরকমই। বন্ধু নেই একজন মানুষ বাঁচে কীভাবে? আমি তো ভালো আছি এবং সুখেই আছি। কিছুক্ষণ চিন্তা করেই রহস্যের সমাধান বের করলাম (আমি আবার মিসির আলি তো)। আমার মাথায় সবসময় গল্প কিংবা উপন্যাস থাকে। গল্প-উপন্যাস যখন যেটা লিখছি তার চরিত্রই বন্ধু হিসেবে থাকে। বাইরের বন্ধুর প্রয়োজন সে কারণেই হয় না। ইমদাদুল হক মিলনের কাছে ফিরে যাই। তার সঙ্গে প্রথম দেখা বইমেলায়।

আমেরিকা থেকে ফেরার পর প্রথম বইমেলায় গিয়েছি। একটা স্টলের সামনে ভিড়। লেখকের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেয়া হচ্ছে। লেখক দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট। মাথা সম্ভবত কামানো। লেখকের চেহারা মোটেই লেখকসুলভ নয়। দেখাচ্ছে পাড়ার মাস্তানদের মতো। আমি এই লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচিত নই। নামের সঙ্গেও না। আমি তার একটা বই কিনলাম (ও রাধা ও কৃষ্ণ) এবং লাইনে দাঁড়ালাম অটোগ্রাফের জন্যে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে একবারই কারো কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছি।

মিলন খুব সম্ভব নিজেকে প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছিল। কম বয়সের জনপ্রিয়তার এই একটা সমস্যা। লেখক পাঠকদের চাহিদার কাছে নতজানু হন। মিলনের লেখার ক্ষমতার বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হবার ব্যবস্থা সে করে রেখেছে, তারপরেও তার ক্ষমতার ভুল ব্যবহার দেখে অনেকবার ব্যথিত হয়েছি। ওয়ার্ড কমিশনাররা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেন। আমি ওয়ার্ড কমিশনারের মতো মিলনকে একটা সার্টিফিকেট দিচ্ছি— যার জন্যে প্রযোজ্য

লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে অতি, অতি বিনয়ী। ঘরোয়া আড্ডায় কখনো তাকে উত্তেজিত হতে দেখে নি। বাংলা সাহিত্যের পড়াশোনা তার ব্যাপক। বাংলা ভাষায় এমন কোনো বই লেখা হয় নি যা সে পড়ে নি। তার চরিত্রে জল-স্বভাব প্রবল। যে-কোনো পাত্রেই তাকে রাখা যায়। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে সে জড়িত না। আমি তার সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি। সার্টিফিকেট প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন আমি নিজে একটা সার্টিফিকেট যে পেয়েছিলাম সেই গল্পটা বলি।

একদিন এক যুবক ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।সে বলল, তার হাতের লেখা অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতো।সে কিছু নমুনাও নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ তোমাকে পেলে লুফে নিতেন।একের পর এক রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ করতেন। আমি তাকে দিয়ে নিজের জন্যে রবীন্দ্রনাথের একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলাম। সেখানে লেখা শ্রীমান হুমায়ূন আহমেদ, তোমার কিছু রচনা পাঠ করিয়া বিমলানন্দ পাইয়াছি। তোমার কিছু শব্দের বানান বিষয়ে আমার কথা আছে। সাক্ষাতে বলিব। শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৪.

নামের আগে ড. লাগিয়ে বসে আছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। কিন্তু সংসার চালিয়ে নিতে পারছি না। পত্রিকায় পড়ার মতো কোনো খবর নেই এই অজুহাত দেখিয়ে বাসায় পত্রিকা রাখাও বন্ধ। আমেরিকায় গুলতেকিন নানান কাজকর্ম করে কিছু রোজগার করত। বাংলাদেশে সেই রোজগারও বন্ধ। সে কোথাও যে চাকরি নেবে তাও সম্ভব না।

শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। S.S.C পাশের পর বিয়ে হয়েছে।আমেরিকায় তাকে পড়াশোনা করানো সম্ভব হয় নি। [তবে সে দেশে ফিরে পড়াশোনা শুরু করেছিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম, এ ডিগ্রি নিয়েছিল।] আগের কথায় ফিরে যাই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।

কী করা যায় বুঝতে পারছি না। একদিন শুনলাম সেবা প্রকাশনীর আনোয়ার হোসেন সাহেবকে বই অনুবাদ করে দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ নগদ টাকা দেন। গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমার হাতে একটা ইংরেজি বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন, অনুবাদ করে নিয়ে আসুন। পড়ে দেখি কেমন হয়েছে। ভালো হলে ছাপব। নগদ টাকা দেব।বইটার নাম Man on fire. সাতদিনের মাথায় অনুবাদ শেষ করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলাম। বইটার নাম দিলাম অমানুষ। আমার ধারণা ছিল অনুবাদ পড়লে এই বই তিনি ছাপবেন না। কারণ আমি মূল

উপন্যাসের কাঠামো ঠিক রেখে সম্পূর্ণই আমার মতো করে লিখেছি। বাঙালি এক যুবকের গল্প, যার নাম জামশেদ। আনোয়ার হোসেন সাহেব পাণ্ডুলিপি না পড়েই সেদিন আমাকে তিনশ’ টাকা দিলেন। সেবা প্রকাশনীর জন্যে আমি আরো দুটা বই অনুবাদ করেছি। একটির নাম সম্রাট, আরেকটির নাম দ্যা এক্সেসরিস্ট। ভূতের গল্প।শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যে লেখালেখি করাকে অনেকেই ছোট চোখে দেখেন।

আমি অর্থ উপার্জনের জন্যে বই অনুবাদ করেছি। এই সত্য প্রকাশে কোনোরকম লজ্জা বোধ করছি না। আমার ভাগ্য খানিকটা বদলালো, শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলাম। হাউস টিউটর মানে ফ্রি বাসা। ফ্রি ইলেকট্রিসিটি, ফ্রি গ্যাস ও পানি। আমি মহানন্দে শহীদুল্লাহ হলের গেটে সংসার পাতলাম। হলের গেটের দু’পাশে দুই হাউস টিউটরের বাসা। তারা এক অর্থে হলের গেটকিপার। হলের ভেতরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তারাই প্রথম জানবেন।

ঢাকা শহরের সুন্দর কিছু জায়গার একটি শহীদুল্লাহ হল। হলের সামনে প্রাচীন কিছু বৃক্ষ। সেখানে বাস করে রাজ্যের টিয়া পাখি। একসঙ্গে এত টিয়াপাখির বাস বাংলাদেশে আর কোথাও আছে বলে আমি জানি না।সন্ধ্যাবেলা সব পাখি একসঙ্গে ডাকাডাকি করে চারপাশ রহস্যময় করে তোলে।হলের পাশের বিশাল দিঘিটাও রহস্যময়। প্রতিবছরই সেই দিঘিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে কেউ-না-কেউ মারা যায়। দিঘির পাড়ে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ সাইনবোর্ডও লাগানো আছে।

দিঘির পানি কাঁচের চেয়েও পরিষ্কার। রহস্যময় এই দিঘিতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ জেনেও আমি আমার তিন মেয়েকে এই দিঘিতেই সাঁতার কাটা শিখিয়েছি। অনেক পূর্ণিমার রাতে দিঘির জলে সপরিবারে নেমেছি। একই সঙ্গে জলস্নান এবং চন্দ্রম্নান। আমার তিন মেয়ে শহীদুল্লাহ হলের দিঘিতে শুধু যে সাঁতার শিখেছে তা না, তারা হলের সামনের মাঠে সাইকেল চালাতেও শিখেছে। ট্রেইনার আমি। বড় মেয়ে নোভা প্রথম যেদিন সাইকেল চালানো শিখল, সেই দিনের দৃশ্য আমার এখনো চোখে ভাসে। সে প্যাডেল করছে। আমি সাইকেলের পেছনটা ধরে আছি।

সে একটু পরপর বলছে—ড্যাডি, আমাকে ছেড়ে দিও না। ছেড়ে দিলেই আমি পড়ে যাব। আমি বললাম, মা, আমি শক্ত করে ধরে আছি। ছাড়ব না। তুমি এক চক্কর ঘুরে আস।… আমি ততক্ষণে সাইকেল ছেড়ে দিয়েছি। নোভা যে একা একা যাচ্ছে তা সে জানে না। পুরো চক্কর দিয়ে এসে হঠাৎ সে আমাকে দেখল—আমি সিগারেট টানছি। নোভা বিকট চিৎকার দিল, বাবা, আমি সাইকেল চালানো শিখে গেছি। বলেই সে সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *