বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

এই গানের সঙ্গে সঙ্গে জাল ফেলা হবেক্যামেরা মাঝির মুখ থেকে কাট করে চলে যাবে জালেসেখান থেকে কাট করে পানিতে, কাট করে লং শটে নৌকাকাট মিড ক্লোজ আপ তাের মুখ। 

বহুব্রীহিআমার মুখ মানে

জেলের স্ত্রীর ভূমিকায় তুই অভিনয় করছিসদুঃখ, অভাব অনটনে পর্যদস্ত বাংলার শাশত নারীহৃদয়ে মমতার সমুদ্র, পেটে ক্ষুধার অগ্নি। 

মামা, তােমার এইসব ঝামেলায় কিন্তু আমি নেইআমি কি বাইরে থেকে আর্টিস্ট আনব নাকি? নিজেদেরই কাজ করতে হবেআমি পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবঅভিনয়ের জানে না এমন সব মানুষ নিয়েও ছবি হয় এবং ক্লাব ছবি হয়ডায়ালগ মুখস্ত করে ফেলবি, পরশু থেকে রিহার্সেল। 

মিলি বিরক্ত গলায় বলল, তােমার এই পাগলামীর কোন মানে হয় মামা? মুখে বললেই ছবি হয়ে যাবে? টাকা পয়সা লাগবে না?‘ 

আমার কি টাকা পয়সার অভাব? দুলাভাইয়ের কাছে আমার কত টাকা জমা আছে তুই জানিস? প্রয়ােজন হলে মগবাজারের বাড়ি বিক্রি করে দেবমরদকা বাত, হাতীকা দীতএকবার যখন বলে ফেলেছি 

হবে নাশুধু শুধু আগেই টের পেয়ে গেছিস শেষ পর্যন্ত কিছু হবে না? জীবন সম্পর্কে এমন পেসিমিষ্টিক ভিউ রাখবি নামনটাকে বড় কর। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

আর কে কে অভিনয় করছে তােমার ছবিতে? এখনাে ফাইন্যাল হয় নিডাক্তার ছােকরাকে বলে দেখব, আর দেখি নতুন ভাড়াটে আনিস রাজি হয় কিনা। 

ওরা ছবিতে অভিনয় করবে কেন

শিল্পের প্রতি মমত্ববােধ থেকে করবেমহৎ কাজে শরিক হবার স্পিরিট থেকে করবেআনিস ছােকরাকে আজ রাতেই ধরব| মিলি তাকিয়ে আছে মামার দিকেসে যে খুব উৎসাহ বােধ করছে তা মনে হচ্ছে না। 

আনিস আছ নাকি

আনিস দরজা খুললফরিদকে দেখে অবাক হলেও ভাব ভঙ্গিতে তার কোন প্রকাশ হল নাসে হাসি মুখে বলল, স্নামালিকুম। 

ওয়ালাইকুম সালামতুমি করে বললামকিছু মনে করনিতাে? আমি মিলির মামাজ্বি আমি জানিআসুন ভেতরে আসুন| ভেতরে যাব নাকাজের কথা সেরে চলে যাবখুব ব্যস্তছবির স্ক্রীপ্ট করছি, মাছ নিয়ে শর্ট ফ্লিম বানাচ্ছিনাম হচ্ছেহে মাছ। 

তাই না কি? হ্যাঁ! তাইএখন কথা হচ্ছে তুমি কি ছবিতে অভিনয় করবে? এক গাদা কথা বলার দরকার নেইবল হ্যা কিংবা না” 

আনিস হকচকিয়ে গেলকেউ তাকে অভিনয়ের জন্যে ডাকতে পারে তা তার মাথায় কখনাে আসে নিফরিদ বলল, আমার ছবিতে একটা চোরের ক্যারেক্টার আছেএই জন্যেই তােমার কাছে আসা নয়ত আসতাম নাতোমার চেহারায় একটা চোর চোর ভাব আছে। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

আনিস হতভম্ব হয়ে বলল, আমার চেহারায় চোর চোর ভাব আছে? হ্যা আছে। 

আনিস বিস্মিত গলায় বলল, নিজের সম্পর্কে আজে বাজে কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু আমার চেহারা চোরের মত এটা এই প্রথম শুনলাম। 

সত্যি কথা আমি পেটে রাখতে পারি নাবলে ফেলিতুমি আবার কিছু মনে করনি তাে? জ্বি না, কিছু মনে করিনিঅভিনয় করবে নাকরবেনা

করবজীবনে অনেক কিছুই করেছিঅভিনয়টাই বা বাদ থাকবে কেন?” 

ফরিদ হৃষ্ট চিত্তে নীচে নেমে এলএখন ডাক্তার ছােকরা রাজী হলেই কাজ শুরু করা যায়তবে ছকরার ব্রেইন বলে কিছু নেইতার কাছ থেকে অভিনয় আদায় করা কষ্ট হবেব্যাটা হয়তাে রাজিও হতে চাইবে নাফরিদের ধারণা ডাক্তার এবং ইনজিনীয়ার এই দুই সম্প্রদায়, অভিনয় কলার প্রতি খুউৎসাহী নয়আজ রাতেই ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেললে কেমন হয়

ফরিদ কাদেরকে পাঠাল মনসুরকে ডেকে আনতেমনসুর সঙ্গে সঙ্গে চলে এলমনে হল যেন কাপড় পরে বাড়িতে আসার জন্যে তৈরী হয়েই ছিলমনসুরের সঙ্গে ফরিদের নিম্নলিখিত কথােপকথন হল। 

ফরিদঃ তােমাকে একটি বিশেষ কারণে ডেকেছিঅসুখ বিসুখের সঙ্গে এর কোন 

সম্পর্ক নেইমনসুর : জ্বি বলুন। 

ফরিদঃ আচ্ছা স্ত্রী হিসাবে মিলি কি তােমার জন্যে মানানসই হবে বলে মনে হয়

মিলি আবার একটু বেঁটে, ভেবে চিন্তে বলমনসুরঃ (তােতলাতে তােতলাতে) জ্বি মামা, অবশ্যই হবেবেঁটে কি বলছেন

বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

পারফেক্ট হাইটমানে আমার ধারণা মানে ফরিদঃ মিলির স্বামী হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? মনসুরঃ অবশ্যই পারবএকশ বার পারবফরিদঃ তাহলে কাল থেকে রিহার্সেল শুরু করে দাওমনসুরঃ (বিঘিত) কিসের রিহার্সেল ? ফরিদঃ মিলি করবে জেলের স্ত্রীর ভূমিকা আর তুমি হচ্ছ জেলেমনসুরঃ মি মামা কিছুই বুঝতে পারছি নাফরিদঃ ছবি বানাচ্ছিশর্ট ফ্লিমসেখানে তােমার ভূমিকা হচ্ছে অভাব অনটনে পর্যুদস্ত 

জেলে, আর মিলি তােমার স্ত্রীমনসুরঃ ছবির কথা বলছেন? ফরিদঃ অফকোর্স ছবির কথা বলছিতুমি কি ভেবেছিলে? মনসুরঃ (শুকনাে গলায়) একগ্লাস ঠান্ডা পানি খাবএকগ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, মিস মিলি কি আমার সঙ্গে অভিনয় করতে রাজী হবেন

সেতো রাজী হয়েই আছে। 

তাই নাকিআরেক গ্লাস পানি খাব। | মনসুর দ্বিতীয় গ্লাস পানি খেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জানাল যে সে অতি আগ্রহের সঙ্গে মিস মিলির সঙ্গে অভিনয় করবে। 

তুমি আগে অভিনয় করেছ? জ্বি নাঅসুবিধা হবে নাআমি শিখিয়ে দেবঅভিনয় কঠিন কিছু নাজাল ফেলতে জান? জি নাশিখে নেবেজি আচ্ছামাথাটা কাল পরশু কামিয়ে ফেলডাক্তার হকচকিয়ে গেলঢোঁক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল, কি বললেন মামা

মাথাটা কামিয়ে ফেলতে বললামজেলেদের মাথায় থাকে কদমছাট চুলমাথা না কামালে জিনিস পাব কোথায়? কোন অসুবিধা আছে

জ্বি নাকোন অসুবিধা নেইআপনি যা বলবেন তাই করব। 

ভেরি গুড়অভিনয় নিয়ে মিস মিলির সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি

ফরিদ বিরক্ত হয়ে বলল, তার সঙ্গে আবার কি কথা? সে অভিনয়ের জানে কি? যা জানতে চাইবে আমাকে প্রশ্ন করলেই জানবে। 

ডাক্তার বলল, জ্বি আচ্ছা। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ

ফজরের নামাজ শেষ করে সােবাহান সাহেব তসবি হাতে বাগানে খানিকক্ষণ হাঁটেনআজও তাই করছেনহঠাৎ মনে হল কে যেন গেটে টোকা দিচ্ছেএত ভােরে কে আসবে বাড়িতে? তিনি বিস্মিত হয়ে গেট খুললেনবিলু দাঁড়িয়ে আছেব্যাপারটা বিশ্বাসই হল নাবিলুর মেডিকেল কলেজ খােলাদিন পরই পরীক্ষাএই সময় সে ঢাকায় আসবে কেন? আনন্দ বিস্ময়ে সােবাহান সাহেব অভিভূত হয়ে গেলেন| আরে তুই? বিলু মা, তুই

বিলু বেবীটেক্সী ভাড়া মেটাতে মেটাতে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলভােরবেলার আলােয় হলুদ রঙের শাল জড়ানাে বিলুকে অপ্সরীর মত লাগছেতার এই মেয়ে বড় সুন্দরস্বর্গের সব রূপ নিয়ে এই মেয়ে পৃথিবীতে চলে এসেছে| ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার উপরই বিলু নীচু হয়ে বাবার পা স্পর্শ করলনরম গলায় বলল, তুমি এতাে রােগা হয়েই কেন বাবা? সােবাহান সাহেবের চোখে পানি এসে গেলতার বড় মেয়ের সামান্য কথাতেই তীর চোখ ভিজে উঠেতিনি ধরা গলায় বললেন

কলেজ ছুটি নাকি মা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *