নারী কণ্ঠ আবারাে তীক্ষ্ণ গলায় বললে–আপনি
“আমার নাম আনিস। আমি এ বাড়ির ভাড়াটে। আপনি কি ভয় পেয়েছেন? ” ‘ভয়ের কিছু নেই। আমি মানুষ। ভূত কখনাে কবিতা বলে না। তাছাড়া ভূতের ছায়া পড়ে না। এই দেখুন আমার ছায়া পড়েছে।
নারীমূর্তি কিছু বলল না। গায়ের চাদর টেনে দিল। তাতে তার মুখ আরাে ঢাকা পড়ে গেল। আনিস বলল, আপনি কে জানতে পারি কি?
‘আমার নাম বিলু। আমি এ বাড়ির বড় মেয়ে। ‘ছাদে কি করছেন? ‘কিছু করছিনা। টবের গাছগুলি দেখতে এসেছিলাম। মাঝখানে আপনিভয় দেখিয়ে দিলেন।
সত্যি ভয় পেয়েছেন? ‘হা।
কেন বলুনতাে? | বিলু সহজ গলায় বলল, রহিমার মার ধারণা এ বাড়ির ছাদে না–কি ভূত আছে। সে প্রায়ই দেখে। আপনাকে হঠাৎ দেখে–আচ্ছা যাই।
বিলু সিড়ির দিকে রওনা হল। আনিস বলল, আপনার টবের গাছ দেখা হয়ে গেল?
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনার আরাে কিছুক্ষণ ছাদে থাকার ইচ্ছা ছিল, আমার কারণে চলে যাচ্ছেন।
‘আপনার ধারণা ঠিক না। আমার শীত শীত লাগছে। তাছাড়া অনেকক্ষণ ছাদে ছিলাম। আনিস সহজ গলায় বলল, আপনাকে ভয় দেখানাের জন্যে দুঃখিত। বিলু হেসে ফেলল। বেশ শব্দ করে হাসল। আনিস হাসি শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এই হাসি তার পরিচিত। এ জীবনে অনেকবার শুনেছে। রেশমা এম্নি করেই হাসত, কিশােরীদের ঝনঝনে গলা, যে গলায় একই সঙ্গে আনন্দ এবং বিষাদ মাখানাে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
বিলু বলল, যাই কেমন?
আনিস দ্বিতীয়বার চমকাল। রেশমাও কোথাও যাবার আগে মাথা কাত করে বলত, যাই কেমন? যেন অনুমতি প্রার্থনা করছে। যদি অনুমতি পাওয়া না যায় তাহলে যাবে না।
বিলু তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। সিড়ির মাথায় মূর্তির মত আনিস দাঁড়িয়ে। সে ফিসফিস করে বলল, আলােটুকু তােমায় দিলাম। ছায়া থাক আমার কাছে।
তার ভাল লাগছে না। কোথাও কিছু একটা ঘটে গেছে। অনেক অনেক দূরের দেশ থেকে যেন হঠাৎ রেশমা উঠে এল। এ কেমন করে হয়? যে চলে গেছে সে আর আসে না। মানুষের কোন বিকল্প হয় না। কি যেন কথাগুলি? এ পৃথিবী একবার পায় তারে কোন দিন পায় নাকো আর, লাইনগুলি কি ঠিক আছে না ভুল টুল কিছু হল?
এমদাদ এবং তার নাতনীকে থাকার জন্যে যে ঘরটা দেয়া হয়েছে সে ঘর এমদাদের খুবই পছন্দ হল। সে তিনবার বলল, দক্ষিণ দুয়ারী জানালা লক্ষ্য করে দেখ। ঘুম হবে তােফা। পুতুল শুকনাে গলায় বলল, ঘুম ভাল হইলেই ভাল। আরাম কইরা ঘুমাও।
খাটও দুইটা আছে। একটা তাের একটা আমার। বাবস্থা ভালই। কি কস পুতুল? | পুতুল চুপ করে রইল। এমদাদ বলল, ভয়ে ভয়ে ছিলাম বুঝলি। কিছুই বলা যায় না। যদি চাকর বাকরের ঘর দিয়া বসে। দিয়া বসতেও তাে পারে। মানী লােকের মানতাে সবাই দেখে
আরে আরে কারবার দেইখ্যাযা। ঘরের লগে পেসাবখানা। এলাহী কারবার।
আনন্দে এমদাদের মুখ ঝলমল করছে। শুধু পুতুল মুখ কাল করে রেখেছে। কিছুতেই তার মন বসছে না। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হবার কষ্ট ও যন্ত্রণা সে তার ক্ষুদ্র জীবনে অনেকবার ভােগ করেছে। এখন আবার শুরু হল। ইচ্ছা মৃত্যুর ক্ষমতা যদি মানুষের থাকতাে তাহলে বড় ভাল হত। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হত না।
বহুব্রীহি পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
‘কি দাদাজান? ‘ঘর ভালই দিছে ঠিক না?
এখন খিয়াল রাখবি সবের সাথে যেন ভাল ব্যবহার হয়। যে যা কয় শুনবি আর মুখে বলবি–জ্বি কথা ঠিক। এই কথার উপরে কথা নাই। গেরাম দেশে লােক বলে মুখের কথায়। চিড়া ভিজে না–মিথ্যা কথা, মুখের কথায় সব ভিজে। তাের মুখ এমন শুকনা দেহায় ক্যানরে পুতুল?
এইখানে কদ্দিন থাকবা ? ‘আসতে না আসতেই কন্দিন থাকবা? থাকা না থাকা নিয়া তুই চিন্তা করবি না। এইটা। আমার উপরে ছাইড়া দে। যা হাত মুখ ধুইয়া আয় চাইরভা দানাপানি মুখে দেই। এই বাড়ির খাওয়া খাদ্যও ভাল হওনের কথা।
এমদাদের আশংকা ছিল হয়ত চাকর বাকরদের সঙ্গে মেঝেতে পাটি পেতে খেতে দেবে। যদি দেয় তাহলে বেইজ্জতির সীমা থাকবেনা। দেখা গেল খাবার টেবিলেই খেতে দেয়া হয়েছে। বাড়ীর কত্রী স্বয়ং তদারক করছেন। চিকন চালের ভাত, পাবদা মাছ, একটা শজি, মুগের ডাল। খাওয়ার শেষে পায়েস। তােফা ব্যবস্থা। মিনু বললেন, পেট ভরেছে তাে এমদাদ সাহেব? ঘরে যা ছিল তাই দিয়েছি। নতুন কিছু করা হয়নি। | কোন অসুবিধা হয় নাই। শুধু একটু দৈ থাকলে ভাল হইত। খাওয়ার পর দৈ থাকলে হজমের সহায়ক হয়। তার উপর আপনার ছােটবেলা থাইক্যা খাইয়া অভ্যাস।
বহুব্রীহি পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
ভবিষ্যতে আপনার জন্য দৈয়ের ব্যবস্থা রাখব। ‘আলহামদুলিল্লাহ্। এখন মা জননী অবস্থা পইড়া গেছে। একটা সময় ছিল খােন্দকার বাড়ির সামনে দিয়া লােকজন ছাতা মাথায় দিয়ে যাইত না। নিয়ম ছিল না। জুতা খুইল্যা হাতে নিতে হইত বুঝলেন মা জননী।
‘তাই বুঝি!
‘জ্বি। একবার কি হইল শুনেন মা জননী। খােলকার বাড়ির সামনে দিয়ে এক লােক যাইতেছে হঠাৎ খক করে কাশ ফেলল। সাথে সাথে দারােয়ান ঘাড় ধরে নিয়া আসল–বলল হারামজাদা এত বড় সাহস। খােন্দকার বাড়ির সামনে কাশ ফেলস। নাকে খত দে। মাটিতে চাটা দে–তারপরে যা যেখানে যাবি। | পুতুলের এইসব কথা শুনতে অসহায় লাগে। না শুনেও উপায় নেই। দাদাজান যেখানে যাবে সেইখানেই এইসব বলবে। পুতুলের ধারণা সবই মিথ্যা কথা। সে খাওয়ার মাঝ পথে উঠে পড়ল। এমদাদের তাতে সুবিধাই হল। সে জরুরী একটা কথা বাড়ির কত্রীর সঙ্গে বলতে চাচ্ছে। পুতুল থাকায় বলতে পারছে না। এখন সুযােগ পাওয়া গেল।
মা জননীকে একটা কথা বলতে চাইতেছিলাম। “বলুন। ‘বলতে শরম লাগছে। আবার না বলেও পারতেছি না। তারপর ভেবে দেখলাম আপনাদের না বললে কাদের বলব? আপনারা হইলেন বটবৃক্ষ।
‘ব্যাপারটা কি? ‘টেইন থাইক্যা নামার সময় বুঝলেন মা জননী পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়া দেখি পকেট কাটা।
‘পকেট কাটা মানে?
বহুব্রীহি পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
‘ব্লেড দিয়ে পকেট সাফা করে দিছে। মানিব্যাগে চাইর’শ তেত্রিশ টাকা ছিল, সব শেষ। এখন পকেটে একটা কানা পয়সা নাই। কি বেইজ্জতী অবস্থা চিন্তা করেন মা জননী।
‘আচ্ছা ওর একটা ব্যবস্থা হবে। ‘হবে তাতাে জানিই! বটবৃক্ষতাে শুধু শুধু বলি না। চাইলতা গাছও তাে বলতে পারতাম। পারতাম না?
‘আপনাকে কি মিষ্টি দেব? ঘরে মিষ্টি আছে।”
‘দেন। আমার অবশ্য ডায়াবেটিস। মিষ্টি খাওয়া নিষেধ। এত নিষেধ শুনলে তাে আর হয় না। কি বলেন মা জননী? মিষ্টি খাইতে পারবা না, ভালমন্দ খানা খাইতে পারবা না, সিগ্রেট খাইতে পারবা না–তাইলে খামুটা কি? বাতাস খামু? | দীর্ঘদিন পর এমদাদের খুব চাপ খাওয়া হয়ে গেল। পেট দম সম হয়ে আছে। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা দরকার। এদের বাড়ি ঘর, লােকজন সবার সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার।
সে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। নাতনীটাকে এ বাড়িতে গছিয়ে যেতে হবে। কাজেই পরিবারের সদস্যদের নাড়ি নক্ষত্র জানা থাকা প্রয়ােজন। তার কাছে অবশ্যি বেশির ভাগ সদস্যকেই বােকা কিসিমের বলে মনে হচ্ছে। এটা খুবই ভাল লক্ষণ। যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক থাকে বােকা সেই পরিবার সাধারণত সুখী হয়।
বহুব্রীহি পর্ব (১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
এমদাদ ফরিদের ঘরে উঁকি দিল। ফরিদ চিন্তিত মুখে বিছানায় বসে আছে। ছবির পরিকল্পনা ভেঙ্গে যাওয়ায় তার মন খুবই খারাপ। এমদাদ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, বাবাজী কি জেগে আছেন? | ফরিদ কড়া চোখে তাকাল। থমথমে গলায় বলল, আপনি কি এর আগে কাউকে চোখ মেলে বসে বসে ঘুমুতে দেখেছেন যে আমাকে এ রকম একটা প্রশ্ন করলেন। দেখেছেন এইভাবে কাউকে ঘুমুতে?