বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ

 দিন আপনারে নিয়া 

বিরাট ঝগড়া মিলির সঙ্গেডাক্তারঃ (খানিকটা উৎসাহী) মিলির সঙ্গে ঝগড়া

বহুব্রীহি

এমদাদঃ জিডাক্তারঃ কি জন্যে বলুন তাে? এমদাদঃ মেয়েছেলের কারবারতােমিলি একদিন বললডাক্তার সাহেব বেকুব 

কিসিমের লােক এই শুইন্যা পুতুল রাগ করলডাক্তারঃ (হতভম্ব) আমাকে বেকুব কিসিমের লােক বলল? এমদাদঃ বাদ দেনবাদ দেনমেয়েছেলের কারবার, তামশা কইরা বলছে। 

মেয়েছেলেরা তামশা কইরা অনেক কথা কয়হে হে হেএমদাদ চেষ্টার চুড়ান্ত করছে, কিন্তু একা একা কত করবে? পুতুলের নিজেরও তাে সাহায্য দরকারসে যদি কাঠের টুকরার মত থাকে তাহলে হবে কিভাবে? শাড়িটা বদলাতে বললে বদলায় নাচুলটা আঁচড়িয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ক্ষতিতাে কিছু নাই

তাছাড়া অবস্থা এমন কিছু করারও সময় নাএকজন ঝিম ধরে পড়ে আছেএখন যায় তখন যায় অবস্থাক্ষুধা কি জিনিষ বুঝতে চায়আরে বাবা আল্লাহতালার ইচ্ছা না ক্ষুধা কি 

জিনিষ তুমি বােঝযদি আল্লাহতালার সেই রকম ইচ্ছা থাকত তােমারে গরীব বানিয়ে পাঠাতখামাখা ভাড়ং

বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ

বাড়িতে এমদাদের সব সময় মুখ শুকনা করে থাকতে হয়ভাব দেখাতে হয় যে চিন্তায় চিন্তায় অস্থিরএইসব কি ভাল লাগে? আর বুড়া যদি সত্যি সত্যি মরে যায় তাহলে তাে সাড়ে 

সর্বনাশসে যাবে কোথায়

সন্ধ্যাবেলা আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করলকালবৈশাখীর প্রথম ঝাপ্টাহাওয়ায় ঘরের দরজা জানালা উড়িয়ে নিয়ে যাবার মত অবস্থাটগর এবং নিশীর আনন্দের সীমা নেইবৃষ্টির মধ্যে খুব লাফাচ্ছেবৃষ্টির জল অসম্ভব ঠান্ডাশীতে একেকজন থর থর করে কাঁপছে তাতেও আনন্দ বাঁধ মানছে নাআনিস ঘর থেকে এই দৃশ্য দেখছে তবে চুপচাপই আছেতার মুখের মৃদু হাসি দেখে মনে হচ্ছে সেও বেশ মজাই পাচ্ছে হয়ত সে পানিতে নামবেটগর বলল, বাবা পানিতে নামবে

আনিস হাসি মুখে বলল, ঠান্ডা কেমন তার উপর নির্ভর করছেনিশা শীতে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একদম ঠান্ডা না বাবাগরম পানি

খুব গরম? হ্যা খুব গরম। 

আনিসও নেমে পড়লশীতে জমে যাবার মত অবস্থাতবু বাচ্চাদের সঙ্গে হৈ চৈ করে ভিজতে ভাল লাগছেসবার ঠান্ডা লেগে যাবে বলাই বাহুল্যনিশা এখনই হাঁচি দিচ্ছে। 

আর বােধ হয় মেয়েটাকে পানিতে থাকতে দেয়া উচিত হবে না কিন্তু ওঠে যেতে বলতেও খারাপ লাগছে। করুক, একটু আনন্দকরুক। 

নিশা শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, বাবা আজ সারা রাত আমরা পানিতে ভিজবকেমন? আমার আপত্তি নেই। 

বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ

পানিতে বেশীক্ষণ ভেজা গেল নাশীলা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলদৌড়ে বাইকে ঘরে ঢুকতে হলতিনজনেই শীতে থর থর করে কাঁপছেনিশার গায়ে সম্ভবত জ্বর উঠেই গেছেসে একটু পর পরই হাঁচি দিচ্ছেবিলুর কাছ থেকে অষুধ এনে খাইয়ে দেয়া দরকারআনিনকে বিলুর কাছে যেতে হল নাবিলুনিজেই এসে উপস্থিত। | বিলু মুখ শুকনাে করে বলল, আপনারা মনে হচ্ছে খুব মজা করলেন! আনিস বলল, হ্যাঁ করলাম। অনেকদিন পর পানিতে ভিজলামযাকে বলে শৈশবে ফিরে যাওয়া। 

আপনার সঙ্গে একটা কথা বলার জন্যে এসেছিলাম আনিস সাহেববলুনআপনার বাচ্চাগুলির গা মুছিয়ে শুকনাে কাপড় পরিয়ে দিন তারপর আমার সঙ্গে নিচে আসুনবলছি। 

মনে হচ্ছে খারাপ খবর। 

আমাদের জন্যে খারাপ খবর আপনার জন্যে কেমন তা জানি নাবাবার ব্লাড প্রেসার খুব ফল করেছে। 

বলেন কি? বাড়ির একটা মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে পড়ে আছে এবং তা পড়ে আছে আপনার উল্টা পাল্টা কথা শুনে অথচ আপনি একদিনও তাঁকে দেখতে যান নি। 

আনিস বলল চলুন যাই দেখে আসি। 

ঠাট্টা করছেন? আমি ঠাট্টা করি নাএকজন মানুষ ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাচ্ছে এটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে বলেই আমি চুপ করে আছি। 

একজন মানুষ মরে যাবে তারপরও আপনি চুপ করে থাকবেন

আনিস হাসি মুখে বলল, মানুষ এত সহজে মরে নাচলুন যাই অনশন ভাঙ্গিয়ে দিয়ে আসিবিলু বিশিত গলায় বলল, আমরা সবাই মিলে যা পারলাম না আপনি তাই করবেনঅনশন ভাঙ্গাবেন

আনিস সোবাহান সাহেবের সঙ্গে কি কথা বলল কেউ জানল না কারণ ঘরে তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল নাকিন্তু দেখা গেল আনিস ঘর থেকে বেরুবার পর পরই সােবাহান সাহেব বললেন, আমাকে এক গ্লাস দুধ দাও। 

বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ

খবর শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ফরিদএটা কি কথা? চিত্রনাট্য এখন কমপ্লিট আর এখনি কিনা অনশন ভঙ্গআর দুদিন পর ভাঙ্গলে অসুবিধাটা কি হত? এই দুদিনে ইম্পর্টেন্ট কিছু সট নিয়ে নেয়া যেত! মহৎ কাজে পদে পদে বাধা আসে এটাই হচ্ছে খাটি কথামহাপুরুষদের যে বাণীতােমার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় এটাই হচ্ছে আদি সত্যরাগ করে রাতে ফরিদ ভাত খেল নাএই রাগ তার নিজের উপর না, দুলাভাইয়ের উপরও

এই রাগ হচ্ছে প্রকৃতির উপরযে প্রকৃতি পদে পদে মানুষকে আশাহত করেসােবাহান সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেনমিলি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেডাক্তার পাশেই আছেডাক্তারের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে কারণ এই অনশনের কারণে খুব ঘন ঘন সে বাড়িতে আসতে পেরেছেএখন অনশন ভাঙ্গায় একটু সমস্যা হয়েছে আর হয়ত ঘন ঘন আসা সম্ভব হবে না

তবে ভাগ্য যদি ভাল হয় তাহলে হয়ত তৃষ্ণার্ত মানুষের কষ্ট বােঝার জন্যে এই লােক পানি খাওয়া বন্ধ করবেনসেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছেমিলি বলল, ডাক্তার সাহেব আপনি এখনাে বসে আছেন কেন চলে যানমনসুর বলল, না আমার কোন অসুবিধা নেইএগারােটার দিকে প্রেসারটা মেপে তারপর যাব। 

বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ

তাহলে আসুন আমাদের সঙ্গে চারটা ভাত খানজ্বি আচ্ছা| মিলি হাসতে হাসতে বলল, কেউ ভাত খেতে বলতেই আপনি বুঝি রাজি হয়ে যান? রকম চট করে রাজী হওয়াটা কি ভাল? আমাদের হয়ত ভাত খাওয়াবার ইচ্ছা নেই ভদ্রতা করে বলেছি। 

মিলি কেমন হাসতে হাসতে কথাগুলি বলছেশুনতে কি ভালই না লাগছেআচ্ছা এই মেয়ের সঙ্গে তার যদি কোনদিন বিয়ে হয় তাহলে সেকি কোনদিন তার সঙ্গে কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করবে? না করবে নাকোনদিন নাএই মেয়েকে সে কোনদিন কোন কড়া কথা বলতে পারবে নাএই মেয়ের খুব কঠিন কথায়ও সে রাগ করতে পারবে না। 

ডাক্তার সাহেব। 

আপনি আনিস সাহেবের ছােট মেয়েটাকে একবার দেখে যাবেনবৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছেআপনি বরংউপর থেকে রুগী দেখে আসুনআমি ভাত দিতে বলি। 

জি আচ্ছা‘ 

নিশার জ্বর তেমন কিছু নাএকশকিছু বেশীতবে লাংস পরিস্কার নাকেমন যেন ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছেআনিস বলল, কেমন দেখলেন

মনসুর বলল, ভালসত্যি ভাল তাে? আপনার গলায় তেমন জোর পেলাম না। 

সাংসে কেমন ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে বুকে বােধ হয় কফ জমে গেছেসকাল পর্যন্ত দেখবতারপরএন্টিবায়ােটিক দেব” 

আপনার ভিজিট কত ডাক্তার সাহেব?‘ 

মনসুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আনিস সাহেবআমি বাচ্চাদের সঙ্গে খুব ভাল মিশতে পারি নাকিছু কিছু মানুষ আছে ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে নাআমি সেই রকমআমি আপনার বাচ্চা দুটাকে যে কি পরিমাণ পছন্দ করি তা ওরা জানে না কিন্তু আমি জানি, আমার হৃদয় জানেআপনি ভিজিটের কথাটা তুলে খুব কষ্ট দিলেন। 

বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ

আনিস লজ্জিত স্বরে বলল, ভাই কিছু মনে করবেন নানা আমি কিছু মনে করিনি। 

আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমিও আপনাকে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনাকে খানিক সাহায্য করতে পারি। 

মনসুর অবাক হয়ে বলল, আমাকে সাহায্য করতে পারেন? হাঁ পারিআমার মনে হয় আপনার কিছু উপদেশের প্রয়ােজন আছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *