বহুব্রীহি পর্ব ( ৩)- হুমায়ূন আহমেদ

 আলিশান দালান তুলতে হবে– 

আমার এত সব দরকার নেইআমি সুখেই আছি। সুখে আছ? য় সুখেবহুব্রীহি

মনসুর আসলেই সুখে আছেতার উপর সংসারের দায় দায়িত্ব কিছু নেইতার বাবা ময়মনসিংহ শহরে ওকালতী করেনদেশের বাড়ির অবস্থা মন্দ নয়ময়মনসিংহের এত বড় বাড়িতে মানুষ বলতে বাবামা এবং ছােট বােন নীলিমামনসুরকে টাকা রােজগার করে সংসার চালানাের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে নাউল্টা প্রতিমাসে মনসুরের বাবা এক হাজার করে টাকা পাঠিয়ে ছােট একটা চিঠি লিখেনপ্রতিটি চিঠির ভাষা এবং বক্তব্য এক। 

বাবা মনু,

টাকা পাঠালামশরীরের যত্ন নেবেতুমি ঢাকা শহরে কেন পড়ে আছ তা বুঝতে পারছি নাতােমার নিজের শহরে প্র্যাকটিস করতে অসুবিধা কি? একটা ভাল 

জায়গায় তােমার জন্য চেম্বার করে দেবার সামর্থ পরম করুণাময় আল্লাহতালা আমাকে দিয়েছেনপত্রপাঠ মন স্থির করে আমাকে জানাবে। 

ইতি তােমার আবাপুনশ্চ ১৪ আরাে টাকার দরকার হলে লিখবেএই নিয়ে সংকোচ করবে নাটাকা পয়সা 

তােমাদের জন্যেইপুনশ্চ ২ঃ তােমার মার ইচ্ছা তােমার একটি বিবাহ দেনব্যাপারটা ভেবে দেখতােমার এখন 

পঁচিশ চলছেআমি চৰ্বিশ বছর বয়সে তােমার মাকে বিবাহ করিবিবাহের জন্যে 

এটাই উপযুক্ত বয়সপুনশ্চ ৩ঃ তােমার নিজের কোন পছন্দ থাকলে আমাদের কোনই আপত্তি নাই, এটা তােমাকে 

বলে রাখলাম| বাবার চিঠির সঙ্গে মাচিঠি থাকেসেই চিঠিতে নানান অবান্তর কথার সঙ্গে একটি মেয়ের কথা থাকেপুরাে চিঠি জুড়ে থাকে সেই মেয়ের রূপ এবং গুণের বর্ণনা, এবং সেই রূপবতী এবং গুণবতীর কয়েকটি রঙ্গীন ছবি। 

গত সপ্তাহের চিঠিতে যে মেয়ের কথা ছিল তার নাম রূপামনসুরের মা লিখেছেন 

বাবা মনু, এই মেয়েটির দিকে একবার তাকাইলে চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা করে নাবড়ই রূপবতী মেয়েআচার ব্যবহারেও চমৎকারএই সবই হয়েছে বংশের গুণমেয়ের মাতুল বংশ খুবই উচ্ছনান্দাইল রােডের সরদার পরিবারএক ডাকে সবাই চিনেমেয়ে মমিনুন্নেসা কলেজে বি ফাষ্ট ইয়ারে পড়েমেট্রিক ফাষ্ট ডিভিসন এবং জেনারেল অংকে লেটার পেয়েছিলঅসুখ নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ায় ফল বেশী ভাল হয় নাইমেয়ে খুব ভাল গান গায়কলেজের সব ফাংশানে নজরুল গীতি গায় এবং খুব প্রশংসা পায়মেয়ের তিনটি ছবি পাঠালামতােমার পছন্দ হলে আরাে কথা বার্তা বলব। 

চিঠির সঙ্গে খুব সেজেগুজে তােলা তিনটা ছবিএকটা ছবিতে সে টেলিফোন তুলে কার সঙ্গে কথা বলছেএকটীয় অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে অথাৎ ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছেঅন্য ছবিটা ফুলের বাগানে তোেলাআউট অব ফোকাস হওয়ায় মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, ফুলগুলি বড় সুন্দর এসেছে। 

এইসব চিঠি এবং চিঠির সঙ্গে ছবি পেতে মনসুরের মন্দ লাগে নাভালই লাগেকোন এক লজ্জাবনত তরুনীর সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে এই কল্পনাও তার কাছে মধুর বলে মনে হয়। 

গ্রীন ফার্মেসীর জীবন এবং তার সঙ্গে মধুর কিছু কল্পনায় তার সময় ভালই কাটছিলএকটা মেয়ে হঠাৎ করে এসে সব এলােমেলাে করে দিলমেয়েটার কারণে দিন ধরেই মনসুরের মনে হচ্ছেমানব জীবন একটা যন্ত্রণা বিশেষতার রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে নাহজমের অসুবিধা হচ্ছেঘটনাটা রকম 

গত বুধবারে খুব মেঘলা হিলদুপুরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হলকুদ্স সাহেব ভাত খেতে গেছেনদোকানের এক কর্মচারী মজনু বলল, স্যার আপনি একটু বসেন আমি লন্ডী থেকে কাপড় নিয়ে আসিমনসুর বলল, যাও আমি আছিমজনু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে এসে ঢুকলপরণে সাধারণ নীল রঙের একটা শাড়িমাথার চুল খােপা করাখােপা ভাল করে করা হয়নিচুল এলােমেলাে হয়ে আছেমেয়েটির দিকে তাকিয়েই মনসুরের কেমন যেন লাগতে লাগলএমন সুন্দর মানুষ এই পৃথিবীতে আছে? ছেলেবেলার রূপকথার বইযে সব বন্দিনী রাজকন্যার ছবি থাকে এই মেয়ে তারচেয়েও লক্ষগুণ সুন্দরকেমন। 

মায়া মায়া চোখ, সমস্ত চেহারায় কি অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ ভাবমেয়েটা এত সুন্দর যে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত মনসুরের কষ্ট হচ্ছে। 

মেয়েটা নরম স্বরে বলল, আপনাদের কাছে স্যাভলন বা ডেটল জাতীয় কিছু আছে? মনসুর কীপা কাঁপা গলায় বলল, জ্বি আছেমাজারি সাইজের একটা ফাইল দিন। 

এক্ষুণী দিচ্ছিআপনি বসুনচেয়ারটায় বসুনমেয়েটি বিস্মিত গলায় বলল, বসতে হবে কেন? জিনিসটা দিন চলে যাইদাম কত? মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, দাম লাগবে নামেয়েটি আরাে অবাক হয়ে বলল, দাম লাগবে না কেন

না মানে কোম্পানী থেকে আমরা অনেক স্যাম্পল ফাইল পাইতােএটা হচ্ছে একটা স্যাম্পল ফাইল| মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল, স্যাম্পল ফাইল আমাকে দেবার দরকার নেই অন্য কাউকে দেবেনদাম কত বলুন। 

দামতো আমি জানি নাদাম জানেন না মানে? আমাদের কর্মচারী লীতে গেছেওসব জানেএক্ষুণী এসে পড়বেআপনি তাহলে কে?আমি ডাক্তারমানে এই ফার্মেসীতে বসিসকাল বিকাল দুবেলাই থাকিআপনি চেয়ারটায় বসুন। 

বসতে পারব না আমার তাড়া আছেআমার মা বটিতে হাত কেটে ফেলেছেনহাতে ডেটল দিতে হবে। 

মনসুর অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে বলল, চলুন যাই ড্রেস করে দিয়ে আসিকাটা ছেড়া ছােট হলেও একে অবহেলা করা ঠিক নাসেপটিক হয়ে যেতে পারে। 

মেয়েটি খুবই অবাক হলকেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাতে লাগলশান্ত গলায় বলল, মাহাতের কাটা এমন কিছু না| মজনু এই সময় ফিরে এলমেয়েটা টাকা দিয়ে স্যাভলনের শিশি হাতে নিয়ে চলে গেলমনসুরের সারাটা দিন আর কোন কাজে মন বসল নাআশ্চর্যের ব্যাপার সেই রাতে সে ঘুমুতে পারল নাএকটা মেয়েকে একবার দেখে কারাের এমন হয়

দ্বিতীয় দিনে মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখাবই খাতা নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলভাগ্যিস ঠিক সেই সময়ে মনসুর বের হয়েছিল সিগারেট কিনতেমনসুর জীবনে যা কোনদিন করেনি তাই করল, এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার মা ভাল আছেন

মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে বলছেন? মনসুর থতমত খেয়ে বলল, জ্বিআপনাকে তাে আমি চিনতে পারছিনাআমি গ্রীণ ফার্মেসীতে বসিডাক্তারআপনি এক বােতল স্যাভলন কিনে নিয়ে গেলেনআপনার মাহাত কেটে গিয়েছিল। 

আচ্ছা মনে পড়েছেমা ভাল আছেনআমি এখন যাই, কেন

মেয়েটি তাকে চিনতে পারল না এই দুঃখে দ্বিতীয় রাতে কম এi ! দুসিডাকসিন খেয়েও সে সারা রাত জেগে কাটালমেয়েটির সম্পকে যাৰ তথ্য সে এখন 

জানেতার নাম মিলিভাল নাম ইয়াসমীনইকনমিক্সে অনার্স পড়েসেকেন্ড ইয়ারযে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির নাম নিরিবিলি! বাড়ির গেটে একটা সাইনবাের্ড ঝুলে, সেখানে লেখাকুকুহইতে সাবধানযদিও সে বাড়িতে কুকুর নেইমেয়েটি বিকেলে বাড়ির ছাদে একা হাঁটাহাটি করেসে ইউনিভার্সিটিতে যায় সকাল আটটায়রাস্তার মােড় পর্যন্ত হেঁটে যায়তারপর রিকশা নেয়রিকশার হুড তুলে নাসব সময় শাড়ি পরেমেয়েটার নিশ্চয়ই অনেক শাড়ি! এখন পর্যন্ত এক শাড়ি দুবার পরতে মনসুর দেখেনিমেয়েটি ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরেঅবশ্যি সে বেশ লম্বা, হিল পরবার তার প্রয়ােজন নেই| মেয়েটি তাকে চিনতে পারে কিনা এটা পরীক্ষা করবার জন্যে আজ সকালে সে মেয়েটার ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় সামনাসামনি পরে গেলমেয়েটি চোখ তুলে তাকে দেখলমনসুর কীপা গলায় বলল, ভাল আছেন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *