বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম শেষ : পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম

কত কাটালাম। একেকবার চাকরি চলে যায়। সঞ্চয় শেষ হয়। স্টেশনে এসে আশ্রয় নেই। কোলকাতায় আমার বড় বড় আত্মীয়স্বজন আছে। তারা খুব চাপাচাপি করে যাতে তাদের কাছে চলে যাই। নিজের দেশ ছেড়ে কেন যাব বলুন তো! তারা মোটামুটি নিরিবিলি একটা জায়গা খুঁজে বের করল। চোখের উপর আলো পড়বে না। পাবলিক টয়লেট কাছেই। খবরের কাগজের উপর চাদর বিছিয়ে বিছানা। হেদায়েত বলল, যথেষ্ট আরামদায়ক ব্যবস্থা।

পরিমল বাবু বললেন, আরাম ভাবলেই আরাম। পুরো ব্যাপারটাই ভাবের উপর। একই পরিস্থিতিতে কষ্টে আছি ভাবলে কষ্টে থাকবেন। আনন্দে আছি ভাবলে আনন্দে থাকবেন।হেদায়েত বলল, অংকেও এরকম ব্যাপার আছে। ইমাজিনারি সংখ্যার গুণিতক নিয়ে ব্যাপার। একই পরিস্থিতিতে উত্তর পজেটিভ হবে আবার নেগেটিভও হবে। যিনি অংকটা করছেন তার উপর নির্ভর করবে তিনি কোন উত্তরটা নেবেন।

বাহ ভালো তো। আসুন চা খাই। চা-সিগারেট খেতে খেতে অংক নিয়ে আলাপ। যদিও আমি অংক ভয় পাই। জীবনে কোনো পরীক্ষায় অংকে চল্লিশের উপর পাই নাই। আপনার মতো শিক্ষক পেলে কাজ হতো।হেদায়েত বলল, আপনি চাইলে আমি আপনাকে অংক শেখাতে পারি। গোড়া থেকে শুরু করতে পারি।পরিমল বাবু বললেন, এটা খারাপ না। শেষ বয়সে শিখলাম কিছু অংক।প্রথমে মুখে মুখে শুরু করি তারপর কাগজ-কলমে যাব।তাই ভালো। অংক করতে করতে ঘুম।

হেদায়েত বলল, আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পরেও আমাকে বেশ কিছু সময় জেগে থাকতে হবে। আমি মনে মনে একটা অংক করছি তো তার জন্যে। আত্মার ইকুয়েশন বের করার চেষ্টা করছি।আত্মার ইকুয়েশন? বলেন কি! অনেকদূর এগিয়েছি– কিছু বাকি আছে। বাকিটাও হয়ে যাবে। বড় বড় অংকবিদরা আমাকে সাহায্য করছেন।পরিমল বাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

হেদায়ে বলল, আত্মা বাস করে Planck জগতে। সব আত্মা একসঙ্গে বাস করে বলেই আত্মার সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ থাকে। এই যোগাযোগ অনন্তকালের।পরিমল বাবু বললেন, আমার আত্মা আমার ভেতর থাকে না? আপনার প্রশ্নের উত্তর— থাকে আবার থাকেও না। ইকুয়েশনটা বের করে ফেলতে পারলে বুঝাতে সুবিধা হবে।পরিমল বাবু বললেন, তাহলে অপেক্ষা করি আপনি ইকুয়েশনটা বের করুন।হেদায়েত বলল, একটা সমস্যা আছে।কী সমস্যা?

ইকুয়েশনটা বের করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যাবে। কাউকে কিছু বুঝাতে পারব না।তাহলে তো ইকুয়েশনটা নিয়ে চিন্তা না করাই ভালো।উপায় নাই। অনেকদূর এগিয়েছি। এখন আর থামা যাবে না। ব্যাপারটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। একবার শুরু হলে আর থামানো যায় না। শেষ হয়… হেদায়েতের কথা শেষ হবার আগেই হুড়মুড় করে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকল। হেদায়েত মুগ্ধ হয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকজনের উঠানামা দেখছে। তার খুবই ভালো লাগছে। একটা বাচ্চা মেয়ে বাবার হাত ধরে গুটগুট করে হাঁটছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে বাহ্! প্রথম রাতেই হেদায়েতের হাওয়াই মেঠাইয়ের মেশিন, পরিমল বাবুর হ্যান্ডব্যাগ এবং কাপড়ের পুঁটলি চুরি হয়ে গেল। পরিমল বাবু বললেন, সম্পূর্ণ ঝামেলা মুক্ত হয়ে গেলাম। ভিক্ষাবৃত্তির নতুন জীবন শুরু করব। এর আলাদা আনন্দ আছে।

হেদায়েত বলল, কী আনন্দ! জুয়াখেলার আনন্দের মতো আনন্দ। উত্তেজনার আনন্দ। যার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি সে ভিক্ষা দিবে, না দিবে না— এই উত্তেজনার আনন্দ।নতুন জীবনে হেদায়েত অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ঘুমুতে যাবার আগে সে পরিমল বাবুকে অংক শেখায়। তখন বাইরের কিছু মানুষও কৌতূহলী হয়ে পাশে বসে। হেদায়েতের ভালো লাগে। পরিমল বাবু ছাত্র হিসাবে বেশ ভালো। তিনি দ্রুত ব্যাপারলি ধরছেন। এটাও আনন্দের ব্যাপার।

একদিন রেলস্টেশনেই প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিমের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি রাতের ট্রেনে চিটাগাং যাচ্ছিলেন। পানির বোতল কিনতে এসে হেদায়েতকে দেখে বললেন, আপনার এ কী অবস্থা! হেদায়েত বলল, ভালো অবস্থা স্যার।কী করছেন আজকাল? ভিক্ষাবৃত্তি।তার মানে? আমি আর পরিমল বাবু সারাদিন ভিক্ষা করি। রাতে স্টেশনে শুয়ে ঘুমাই।এনায়েত করিম বললেন, আমি আপনরি কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। স্টেশনে ঘুমান মানে কী?

হেদায়েত মানে বোঝাতে পারল না। তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিম দৌড়ে ট্রেনে উঠলেন। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কারণ হেদায়েত ট্রেনের সঙ্গে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।হেদায়েত এইমাত্র আত্মার ইকুয়েশন বের করে ফেলেছে। সে এই খবরটাই প্রিন্সিপাল সাহেবকে দিতে চাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের লোকজনও তাকিয়ে আছে। তারা অবাক হয়ে মানুষটার দৌড় দেখছে। মানুষটা ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছে না। অকারণে দৌড়াচ্ছে— এর মানেটা কী?

তেতাল্লিশদিন পর বেলায়েত ফিরেছে। তার মুখভর্তি দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। পরনে লুঙ্গি, ঘিয়া কালারের পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। হাতে বেতের বাঁকা লাঠি। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, বাথরুমে গরম পানি দাও, সাবান দাও। হেভি গোসল দেব। তোমরা ভালো? হেনা বিড়বিড় করে বলল, ভালো।চশমাপরা কুস্তিগির টাইপ এক মেয়ে দেখলাম ঘুরঘুর করছে, সে কে?

হেনা বলল, আমার দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হয়। তুমি নাই। একা ভয় ভয় লাগে, এইজন্যে তাকে রেখেছি।আমি নাই তো কী হয়েছে? পরিমল বাবু তো ছিলেন। খবর দিলে হেদায়েত চলে আসত। বুদ্ধি খোয়ায়া সারাজীবন কিছুই করতে পারল না।হেনা বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? বেলায়েত বলল, ময়মনসিংহে এক পীর সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম হেদায়েতের ব্যাপারে। তার সমস্যাটা যেন দূর হয় এই দোয়া নিতে।

পীর সাহেব বললেন, আপনার ভাইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। সংসার-টংসার সব ছেড়ে আমার সঙ্গে চল্লিশদিনের জন্যে চিল্লায় চলেন সব ঠিক করে দেব। আমি বললাম, ঠিক আছে। পীর সাহেব বললেন, এই চল্লিশদিন বাড়িঘরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা যাবে না। যোগাযোগ করা যাবে না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এই হলো ঘটনা। বুঝেছ? বুঝেছি।হেদায়েতের খবর কী? সে আছে কেমন?হেনা জবাব দিল না। তার কাছে দেবার মতো কোনো জবাব ছিল না।

পরিশিষ্ট

হেদায়েত এখন তার বড়ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। বাড়ির দোতলা কমপ্লিট হয়েছে। সবচেয়ে বড় ঘরটা বেলায়েত তার ভাইয়ের জন্যে ঠিক করে দিয়েছে। ধরে এসি লাগানো হয়েছে। নতুন ফার্নিচার কেনা হয়েছে।হেদায়েতের ঠিক পাশের ঘরটা পরিমল বাবুর। তাঁর এখন একটাই দায়িত্ব, হেদায়েতের দেখাশোনা করা।এই দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয় না। পালন করে সেতু। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে চিনতে পারছ? হেদায়েত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।বলো তো আমি কে?

তুমি মাহজাবিন। রোল নাইনটিন। প্রাইম নাম্বার।ঠিক আছে আমি রোল নাইনটিন। শোন, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না।আচ্ছা।হেদায়েত তার ভাইকে ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারে না।বেলায়েত প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক-দেড় ঘণ্টা ভাইয়ের সামনে বসে থাকে। নানান গল্প করে।ছোটন আমাকে চিনেছিস? হুঁ।বল দেখি আমি কে? তুমি ভাইজান।শুধু ভাইজান বললে হবে না। আমার নাম কী বল?

তোমার নাম বেলায়েত।বেলায়েতের শেষে কী? হোসেন না ইসলাম? হোসেন।তোর নিজের নাম কী বল দেখি।মনে আসছে না ভাইজান।বেলায়েত চোখ মুছতে মুছতে বলল, ভাইজান ছাড়া দুনিয়ার সবকিছু ভুলে খাবি এটা কেমন কথা! ভাইজান সরি! সরি বলার কিছু নাই। তুই আমাকে গাড়ি কিনতে বলেছিলি মেরুন কালারের, সেটা কিনেছি। দুই ভাই মিলে আমরা একদিন গাড়ি নিয়ে বের হব। ড্রাইভার গাড়ি চালাবে। আমরা দুই ভাই পেছনের সিটে বসে থাকব।

আচ্ছা।তোর ভাবি যে যন্ত্রণাটা করেছে সেটা মনে রাখিস না। আমি ক্ষমা করে। দিয়েছি, তুইও দিস। আমাদের দুই ভাইয়ের নীতি হলো মানুষের ভালোটা দেখব, মন্দটা দেখব না। ঠিক না? হ্যাঁ। ভাইজান আমি কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছি? আরে না। পাগল হলে কেউ কি এত সুন্দর করে গল্প করতে পারে?

ভাইজান আমি জানি আমি পাগল হয়ে গেছি। কারণটাও জানি। আমি আত্মার ইকুয়েশনটা বের করে ফেলেছি।মাথা থেকে ইকুয়েশন দূর কর গাধা।আচ্ছা।আর দূর করতে না পারলে আমাকে শিখিয়ে দে। দুই ভাই মিলে একসঙ্গে পাগল হয়ে যাই।

রাতে কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে হেদায়েত ঘুমুতে যায়। তারপরেও কয়েকবার তার ঘুম ভাঙে। যতবারই ঘুম ভাঙে ততবারই দেখে–অতি রূপবতী এক তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটিকে সে চিনতে পারে না, তারপরেও সে জানে এই মেয়ে তার অতি আপনজন। রোল নাইনটিন। প্রাইম নাম্বার।

                                 ( সমাপ্ত )

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *