হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –১৭

বাদশাহ নামদার পর্ব –২০

গুলবদন বললেন, যা কিছু ঘটে আল্লাহ্ পাকের নির্দেশেই ঘটে । এই ভেবে শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করুন ।

সম্রাট বললেন, এই ভেবে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা আমি সবসময় করি । তাতে লাভ হয় নি । মন শান্ত হয় না । মনের উপর কর্তৃত্ব মানুষের নেই । ‘মন’ আল্লাহ্ পাকের হাতে ।

কথা শেষ করেই সম্রাট হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে তাঁর আদরের কন্যাকে ডাকতে লাগলেন, মা আকিকা । আয় আমার কোলে আয় মা।

হতাশ এবং ক্লান্ত হুমায়ূন আগ্রায় ফিরে প্রবল জ্বরের মধ্যে পড়লেন । কোনো চিকিৎসাতেই জ্বরের উপশম হলো না । হুমায়ূনভগ্নি গুলবদন ভাইয়ের রোগমুক্তির জন্যে এক মাস রোজা মানত করলেন ।

জ্বরের দশম দিনে সম্রাট বিছানায় উঠে বসলেন । তিনি ঘোষণা করলেন, শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি এখন সক্ষম । আগামীকাল থেকে দরবার বসবেন ।

হুমায়ূনের রোগমুক্তি উপলক্ষে আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হলো । সম্রাটের ওজনের সমপরিমাণ ওজনের রৌপ্যমুদ্রা গরিব-দুঃখীদের বিতরণ করা হলো ।

সম্রাট দরবারে বসেছেন । তাঁর ভাইরাও উপস্থিত । হুমায়ূন তিন ভাইয়ের জন্যে উপহার ঘোষণা করলেন । প্রত্যেকেই একটি করে ঘোড়া, পোশাক, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পেলেন । তিনজনকেই একটি করে নীলকান্তমণি দেওয়া হলো । দরবারে উপস্থিত আমীররা নীলকান্তমণির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে ‘মারহাবা’ ‘মারহাবা’ ধ্বনি ‍দিলেন । সম্রাট অত্যন্ত আবগময় ভাষায় বললেন, আমার তিন ভাই আমার সর্বশক্তির উৎসস্বরুপ । তারা কিছু ভুল-ভ্রান্তি করেছে । মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করার প্রধান সমস্যা হলো, মাঝে মাঝে ভূল-ভ্রান্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করা । আমি আমার প্রাণপ্রিয় ভাইদের সকল ভুল ক্ষমা করে দিলাম । আমীররা আবারও বললেন, মারহাবা! মারহাবা! সম্রাট সিংহাসন থেকে নেমে এসে তাঁর ভাইদের আলিঙ্গন করলেন । আবারও আনন্দ ধ্বনি-মারহাবা! মারহাবা !

বাদশাহ নামদার পর্ব –১৭

এই দরবার আমজনতার জন্যে উন্মুক্ত না । হুমায়ূনের তিন ভাই ছাড়া আমীররা আছেন, সেনাপতিরা আছেন ।পারস্য-সম্রাটের একজন দূত আছেন । রাজমহিষীরা আছেন চিকের আড়ালে । প্রথম দরবারে কী হয় তা তাঁদের দেখার ইচ্ছা । ভাইদের মিলনদৃশ্য দেখার নাটকীয়তা থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করতে চাচ্ছেন না ।

দরবারের বাইরে প্রধান ফটকে এক নাটক শুরু হয়েছে । নগ্নপদের এক লোক দরবারে ঢুকতে চাচ্ছে । তার গায়ে সস্তা উড়ুনি । গরমের মধ্যেও উড়ুনির উপর একটা নোংরা চাদর । মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি । চোখ রক্তবর্ণ । সে বলছে তার নাম নিজাম । সে ভিসতিয়ালা সম্রাটের জীবনরক্ষাকারী ।

প্রধান প্রহরী বলল, তুমি যথেষ্ট বিরক্ত করেছ । এই মুহূর্তে বিদায় না হলে তোমাকে কারাগারে ঢোকানো হবে ।

নিজাম ভিসতি বলল, সম্রাট আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন । আমাকে একবার সাক্ষাতের সুযোগ দিন ।

সম্রাটের সাক্ষাৎ পেতে যে যোগ্যতা লাগে তা তোমার নেই । তোমার পোশাক মলিন । পা খালি । তুমি সম্রাটের জন্য কোনো উপহার আনো নি । প্রহরীদের পরিতোষক তো অনেক পরের ব্যাপার ।

নিজাম ভিসতি বলল, সম্রাট আমার কাছে ওয়াদা রক্ষা করলেই আমি আপনাদের সবার পারিতোষিকের ব্যবস্থা করব ।

প্রধান প্রহরী বলল, আমি আমার জীবনে অনেক হাস্যকর কথা শুনেছি, এমন শুনি নাই ।

বিশ্বাস করুন, সম্রাট আমাকে দেখামাত্র চিনতে পারবেন । তিনি যদি চিনতে না পারেন তাহলে বাকি জীবন আমি অন্ধকূপে কাটাতে রাজি আছি ।

ভিসতি নিজামের কথা সত্যি হলো । সম্রাট দেখামাত্র তাকে চিনলেন । হাসিমুখে বললেন, তুমি ভিসতি নিজাম না ?

নিজাম কুনির্শ করতে করতে বলল, জি আলামপনা । আপনার স্মৃতিশক্তি প্রশংসারও ঊর্ধ্বে ।

আমি তোমাকে বলেছিলাম একদিনের জন্যে হলেও তোমাকে সিংহাসনে বসাব । আজ অর্ধেকবেলা পার হয়ে গেছে, তারপরেও তুমি চাইলে আজই সিংহাসনে বসতে পার । তুমি কি আজই সিংহাসনে বসতে চাও ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –১৭

সম্রাটের অনুগ্রহ এবং মহানুভবতা সমুদ্রের পানির চেয়েও বেশি । আমি আজই সিংহাসনে বসতে চাই । সম্রাটের তিন ভাই স্তস্ভিত । আমীররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন । কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । সম্রাট বললেন, এই ভিসতিওয়ালা তার মশকের সাহায্যে আমার জীবন রক্ষা করেছে । জীবনরক্ষার পুরষ্কার হিসেবে সে আধাবেলার জন্য সিংহাসনে বসবে । আমীররা তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন । একজন সম্রাটের প্রাপ্য সম্মানের পুরোটাই ভিসতি নিজাম পাবেন । ভিসতি নিজাম ইচ্ছা করলে রাজকীয় ফরমানও জারি করতে পারবেন ।

দরবার কিছুক্ষণের জন্য শব্দহীন হয়ে গেল । সামান্য ভিসতিওয়ালা দিল্লীর সম্রাট ? এ কেমন কথা ? সবার দৃষ্টি ভিসতি নিজামের দিকে । দরবারের শান-শওকত দেখে সে খুব যে বিচলিত তা মনে হচ্ছে না ।তার দৃষ্টি সম্রাটের দিকে নিবদ্ধ ।

কামরান মীর্জা সম্রাটের দিকে এগিয়ে গেলেন । নিচুগলায় বললেন, আমি কি ভারতবর্ষের সম্রাটের সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি ?

হুমায়ূন বললেন, অবশ্যই পার । তবে ভারতবর্ষের সম্রাট এখন আমি না । সম্রাট হলেন ভিসতিওয়ালা নিজাম ।

আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাচ্ছি ।

বলো ।

আমার কথায় কোনো অসৌজন্য প্রকাশ পেলে আগেই মার্জনা চাই । সম্রাট আমার কথায় আহত হলেও কথাগুলি আমাকে বলতে হবে ।

বলো । তবে বারবার আমাকে সম্রাট বলে সম্বোধন করবে না । তোমাকে বলা হয়েছে সম্রাট এখন ভিসতি নিজাম ।

ভিসতি নিজাম এখনো সিংহাসনে বসে নি । দরবারে দাঁড়িয়ে আছে । সে যথন সিংহাসন বসবে তখন তার প্রতি যোগ্য আচরণই আমি করব ।

কী বলতে চাও বলো ?

আমার যা বলার তা আমি আলাদা করে শুধু আপনাকেই বলতে চাই । সবার সামনে বলতে চাই না ।

হুমায়ূন বললেন, পবিত্র কোরান শরীফে একটি আয়াত আছে, সেখানে আল্লাহপাক বলছেন, তোমরা দুজন যখন কথা বলো তখন তৃতীয়জন হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকি ।

বাদশাহ নামদার পর্ব –১৭

কামরান মীর্জা বললেন, অনেক কথা আছে যা আল্লাহপাক শুনলে ক্ষতি নেই, অন্য কেউ শুনলে ক্ষতি আছে । হুমায়ূন কিছুক্ষণের জন্যে দরবার থেকে বিদায় নিয়ে চিকের পর্দার আড়ালে গেলেন । সেখানে রাজমহিষীদের অনেকেই ছিলেন । তাঁরা কৌতূহলী চোখে ভিসতি নিজামকে দেখছেন এবং তাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছেন । সম্রাটকে আসতে দেখে সবাই সরে গেলেন, শুধু গুলবদন থেকে গেলেন । তিনি হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, আপনাদের আলোচনায় আমি কি থাকতে পারি ? সম্রাট কিছু বলার আগেই কামরান মীর্জা বললেন, আমার বোন থাকতে পারে । আমি কী বলছি তার একজন সাক্ষী থাকারও প্রয়োজন । হুমায়ূন হাতের ইশারা করলেন । এই ইশারার অর্থ গুলবদন থাকতে পারে।

কামরান মীর্জা বললেন, এক সামান্য ভিসতিওয়ালাকে দিল্লীর সিংহাসনে বসানোর কিছু নেই । তাকে ধনরত্ন দেওয়া যেতে পারে, জায়গির দেওয়া যেতে পারে । সিংহাসনে কেন বসানো হবে ?

হুমায়ূন বললেন, আমি কথা দিয়েছি এইজন্যে বসানো হবে ।

আপনি ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে কথা দিয়েছিলেন । তখন আপনার মস্তিঙ্ক কাজ করছিল না । আপনি ছিলেন প্রবল ঘোরের মধ্যে । আমরা দুঃসময়ে অনেক কথা বলি, সবই অর্থহীন কথা ।

আমার কাছে অর্থহীন কথাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।

কামরান মীর্জা বললেন, মোগল সাম্রাজ্য বিরাট বিপদের মুখে । এখন আপনার উচিত শের শাহ্ নামের দস্যুকে কীভাবে শায়েস্তা করবেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা । একজন মিসকিনকে সিংহাসনে বসানোর ছেলেখেলার সময় এটা না ।

আধাবেলার ব্যাপার ।

এক পলকের ব্যাপারও হতে পারে না । দিল্লীর সিংহাসন দড়ির চারপাই না । যাকে তাকে সেখানে বসানো যায় না  ।

তোমার কথা কি শেষ হয়েছে ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –১৭

হ্যাঁ ।

আমার নির্দেশ-তুমি দরবারে যাবে এবং নতুন সম্রাটকে কুর্নিশ করে সম্মান প্রদর্শন করবে ।

আপনার নির্দেশে পালন করা আমার কর্তব্য । কিন্তু আমি অপারগ । কারণ আমি অসুস্থ বোধ করছি । শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই অসুস্থ ।

তুমি দরবারে যাবে না ?

না । এবং আমি আশা করব আপনিও যাবেন না । নতুন সম্রাট সিংহাসনে বসবেন আর আপনি অন্যসব দরবারির মতো তাকে সম্মান দেখাবেন তা হতে পারে না । নিজেকে হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত করবেন না ।

গুলবদন বললেন, কামরান মীর্জার কথা যুক্তিপূর্ণ । হুমায়ূন বললেন, যুক্তিই সবকিছু না । যুক্তির উপরে অবস্থান করে হৃদয় ।

কামরান মীর্জা তিক্ত গলায় বললেন, এই বিষয়ে নিশ্চয়েই আপনার শের মুখস্থ আছে । শেরটা বলুন শুনি ।

হুমায়ূন শের আবৃত্তি করলেন । শেরটির ভাবার্থ এ রকম-

হে প্রিয়তমা!

যুক্তি বলছে তোমাকে পাওয়া আকাশের চন্দ্রকে হাতে

পাওয়ার মতোই দুঃসাধ্য । মন বলছে তোমাকে

পেয়েছি । মনের কথাই সত্য । তুমি আমার ।

ভিসতি নিজাম গম্বীর মুখে সিংহাসনে বসে আছেন । তাঁর চেহারা মলিন, পোশাক মলিন । তবে রাজমুকুট এবং পাদুকা ঝকঝক করছে । পাদুকা সরবরাহ করা হয়েছে । রাজমুকুট স্বয়ং হুমায়ূন নিজামের মাথায় পরিয়েছেন । পাদুকা তিনি পায়ে পরেন নি, কারণ তাঁর পা অনেক বড় । মাপে হয় নি । পাদুকার উপর পা রেখে তিনি বসেছেন ।

 

Read more

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –১৮

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *