এই গাছের ফুল মেরুন কিংবা উজ্জ্বল বেগুনি। দেখতে অতি অত। মনে হয়—ফুল না, রঙিন প্রজাপতি বসে আছে। অন্য কোনাে ফুলের সঙ্গে সামান্যতম মিলও নেই। ফুল ফোটে আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে। পাঁচ কোণ বিশিষ্ট ফল ফলে।
সেই লও অত |
গাছটার বােটানিক্যাল নাম Abroyna augusta Lion. পরিবারের নাম Sterculiaceae
প্রাচীন ভেষজ চিকিৎসা গ্রন্থে কোথাও ওলট কম্বলের নাম নেই। বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারীতে (১৯৯২) এর উল্লেখ মাত্র নেই। অবশ্যি আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভাচার্য খুঁজে পেতে এক পুঁদ্ধিতে পেয়েছেন—
‘ওলট কম্বল মিত্যাঘ্যং বনং বনেচরেং প্রিয়ম‘ যার অর্থ ওলট কম্বলের ঔষধি গুণ বনবাসীদের কাছে জ্ঞাত ছিল। তারা প্রকাশ করে নি। ঔষধি গুণ লুকিয়ে রাখার প্রবণতা সব কালচারেই ছিল। এখনাে আছে।
আমার দাদাজ্জাল মরহুম আজিমুদ্দিন আহমেদ কামেলা বা জন্ডিসের একটা টোটকা জানতেন। অনেক অনুরােধেও তিনি তা প্রকাশ করেন নি। তিনি তার শ্রান মৃত্যুর সময় সঙ্গে নিয়ে গেছেন। পরকালে জন্ডিস রােগ থাকলে তার বিদ্যা হয়তাে কাজে লাগবে। এই গাছটির ঔষধি গুণের কথা প্রথম বলেন ভুবন মােহন সরকার । Indian Medical Gazete {১৮৭২–এ তিনি এই তথ্য প্রকাশ করেন। (সূত্র : বাংলার বনফু, নওয়াজেশ আহমেদ) গাছের রসায়ন ওলট কমান্সের পাতায় আছে Taraxol এবং Beta sitosterol. দুলে আছে Alkaloids, Starols, Gum, কিছু ম্যাগনেসিয়াম লবণ। পায়ের কাণ্ডে আছে Friedelin Bota sitosterolbn.
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
ভেষজ ব্যবহার
বার্ধক্য রােধে : পশ্চিমা দেশগুলিতে aging বন্ধ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মুখের বলিরেখা বন্ধ করতে, ঝুলে যাওয়া চামড়া সবল করার। জন্যে তারা যে–কোনাে মূল্য দিতে প্রস্তুত । ওলট কম্বলের মূলের চূর্ণ গােলমরিচের গুড়া মিশিয়ে খেলে বার্ধক্য থমকে দাড়ায়।
বার্ধক্যজনিত রােগ কাছে আসে না। স্ত্রী রােগে : মাসিকের অনিয়ম এবং স্বল্পতা কিংবা বৃদ্ধি। স্রোব এবং তার কারণে গর্ভসঞ্চার না হওয়ার ওষুধ ওলট কম্বল। অনুপাত্র গােলমরিচের কড়া। ছু, তপন কুমার দে বলছেন, ২০০ মিলিগ্রাম ওলট কম্বলের মূল চূর্ণের সলে এক টিপ নস্যি পরিমাণ গােলমরিচ সকাল–বিকাল খেতে। (বাংলাদেশের গঙ্গাজলীয় গছ-গাছড়া)
ওলট চণ্ডাল অগ্নিজিহ্বা
ওলট কম্বলের কথা বলা হয়েছে। ওলট চাল বাদ থাকে কেন? ওলট চরাল, ওলট কম্বল— নাম শুনলে একই গােত্রের মনে হলেও এরা সম্পূর্ণ আলাদা। ওলট চা লতানাে লিলি ফুলের গােত্রের গাছ। ইংরেজি নাম Blory Lily অর্থাৎ গৌরবময় লিলি। বাংলায় এবং সংস্কৃতে এর অনেক নাম আছে। আমার নিজের পছন্দ অগ্নিজিহবা । কারণ ফুলটা দেখতে আগুনের জিবার মতােই।
নুহাশ পল্পীর বাগানে লট চাল ছিল না। বৃক্ষমেলা থেকে একটি চারা জোগাড় কৱেছি। অতিরিক্ত যত্নের কারণেই হয়তাে বেচারা মারা গেছে। গুলই চাল বৃনেজলে, ঝােপে–ঝাড়ে, বাড়ির পেছনে পতিত জমিতে অযত্নে জলে । এত আদরে সে হয়তোবা অভ্যস্থ না ।
প্রাচীন ভেষজবিদরা সাতটি অতি বিষাক্ত গাছের উল্লেখ করেছেন। ওলট চুল তার একটি। চাল নামকরণের এও একটি কারণ হতে পারে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
ওলট চালের বােটানিক্যাল নাম Gonosa superba. গােত্র ; Liliaceae,
আদি নিবাস নিয়ে মতভেদ আছে। ভারতের গাছ হতে পারে। আর তার পপুঞ্জে (যেমন আন্দামান) প্রচুর দেখা যায় । থাইল্যান্ডের দ্বীপগুলিতেও আছে। এই গাছের পাই নাম ‘দাওয়ে ডাং’ (সূত্র : বাংলার কলফুল, লওয়াজেশ আহমেদ)। রসায়ন।
গাছের মূলে আছে কয়েক ধরনের নাইট্রোজেনগঠিত যৌগ (Alkaloids}, ফোলঘানি, গ্লোরিসিল, বেনজয়িক অ্যাসিড, ফাইটোস্টেরল এবং শ্লোকোসাইড। আমেরিকান বিজ্ঞানীরা গাছের মূলের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। মূলের স্টেরল নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে।
ওষধি ব্যবহার . গর্ভপাতে বলা হয়ে থাকে এই গাছের মূল গর্ভপাতে অব্যর্থ। এই কারণেই
ওলট চণ্ডালের আরেক নাম গর্ভপাতিনি। প্রসব হবার পর অনেক মায়ের জরায়ুতে ফুল খােকে যায় । সহজে বের হতে চায় না । ওলট চালের মূল নাকি এই কাজে অব্যর্থ।
কুষ্ঠরােগ : প্রাচীন ভেষজবিদরা এই গাছের মূলের প্রলেপ কুষ্ঠােগাক্রান্ত
জায়গায় লাগিয়ে ভালাে ফল পেয়েছেন। গনােরিয়া ; একসময় গলেরিয়া রােগে বিষাক্ত পারদ ব্যবহার হতাে। ওলট চলের বিষাক্ত মূলও একইভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। | মাথার উকুন; এই গাছের পাতার রসও মনে হয় বিষাক্ত। পাতার রস মাথায় মাখলে উকুনের ভুষ্টি নাশ ঘটে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
কিছুদিন আগে পত্রিকায় ছবি দেখেছি ভুবনখ্যাত এক শডেল মাথায় উকুলের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে মাথা কামিয়ে ফেলেছেন। ওলট চালের পাতার রস ব্যবহার করলে বেচারির মাথায় সুন্দর চুলগুলি হয়তাে থাকতো।
বনকলা না-কি কলাপতি ?
আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে। আমি তখন পড়তাম ক্লাস সিক্সে। এই বয়সের একটি ছেলে যতটুকু দুষ্ট হওয়া সম্ভব, আমি ততটুকু দুষ্টই ছিলাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার দুষ্টামি সহজভাবে নেয় নি। এখন খুব পরিষ্কার মনে পড়ছে না হয় তারাই আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিল, কিংবা বাবাই আমাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন।
আমি ঘরে বসে থাকি। আমার। ছােট দুই ভাইবােন, সুফিয়া ও জাফর ইকবাল, শিষ্ট ছাত্র হিসেবে স্কুলে যায়। ঘরে আর কতক্ষণ থাকা যায়। স্কুলের সময় আমি পাহাড়ি বনে–জঙ্গলে ঘুরতে শুরু করলাম । আমার সঙ্গী মুরং রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্লাসের এক বন্ধু, নাম ওয়ালা ঐ বা এর কাছাকাছি।
ওয়ালা প্রু প্রায়ই পকেটভর্তি তেঁতুল নিয়ে যেত | জঙ্গলে কিছুটা কলাগাছের মতো দেখতে এক ধরনের গাছ খুঁজে বের করত। সেই গাছে কড়ে আঙুল সাইজের কলা ধরে থাকত । কলার থােড়টা থাকত আকাশের দিকে উচু হয়। ওয়ালা প্রু এবং আমি কড়ে আঙুল সাইজের কলা খােসা ছড়িয়ে তেতুল দিয়ে যেতাম। কলার কষে মুখ ঝাঝী করত। তেতুল দিয়ে এই বস্তু কোনাে এক বিচিত্র কারণে অমৃতের মতাে লাগত।
অনেক দিন পর ঐ গাছ কয়েকটা দেখলাম বৃক্ষমেলায়। দোকানি কলাপতি নামে বিক্রি করছে। চারটা গাছ কিনে নুহাশ পল্লীতে লাগিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শৈশবে ফিরে যাবার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল।
যাই হােক, এই গাছের বােটানিক্যাল নাম Musa সেjata, পরিবার হলো Musaceae. ইংরেজি নাম Wikd banana, বুনাে কলা। বার্মা এবং থাইল্যান্ডের জঙ্গলে প্রচুর ফলে। বার্মিজ নাম ইয়াকায়িং, খাই নাম কুয়াইবুয়া। আদি নিবাস
–কি দক্ষিণ আমেরিকা।