বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৫)- হুমায়ূন আহমেদ

তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছেডাক্তাররা বলে দিয়েছে প্রতিদিন খুব কম করে হলেও এক থেকে দেড় ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করতে হবে

বৃষ্টি বিলাসতিনি হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না কারণ মাস তিনেক হলাে ডান পায়ের হাঁটু বাঁকাতে পারছেন নাহাঁটু বাকাতে মালিশ এবং চিকিৎসা চলছে, কোনাে লাভ হচ্ছে নাবরং ক্ষতি হচ্ছে, হাঁটু শক্ত হয়ে যাচ্ছেচিকিৎসার আগে সামান্য বাঁকত, এখন তাও বাকছে নাএকটা লােহার মতাে শক্ত পা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে তিনি নিশ্চয়ই মর্নিং ওয়াক বা ইভিনিং ওয়াক করতে পারেন 

তিনি একটা হুইল চেয়ার কিনেছেনবেশির ভাগ সময় হুইল চেয়ারে বসে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যানআবার ফিরে আসেনসময় কাটানাের জন্যে একটা বাইনােকুলার কিনেছেনবাইনােকুলার চোখে দিয়ে রাস্তার লােক চলাচল দেখেনবাইনােকুলার চোখে লাগালেই রাস্তার লােকজন চোখের সামনে চলে আসেতখন তাদের সঙ্গে গম্ভীর গলায় কথাবার্তা বলেন এই যে চশমাওয়ালা, মাথাটা বাঁকা করে আছেন কেন? ঘাড়ে ব্যথা ? রাতে বেকায়দায় ঘুমিয়েছিলেন

ভদ্রলােক বাড়িতে একা থাকেনস্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হয় নি বলে পনেরাে বছর আগে ডিভোের্স হয়ে গেছেতিনি নিজে ডিভাের্সের পক্ষপাতী ছিলেন নাতাদের সাত বছর বয়সের একটা মেয়ে আছেডির্ভোস হলে মেয়েটা যাবে কোথায় ? কিন্তু মুত্তালিব সাহেবের স্ত্রী হেলেনা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলেন

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

উকিল এনে ডিভাের্সের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তিনি অন্ন স্পর্শ করবেন নাহেলেনা ডিভাের্সের দুবছরের মাথায় আবারাে বিয়ে করেছেনদ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে তাঁর জীবন সুখেই কাটছে বলে মনে হয়এই ঘরে ছেলে মেয়ে হয়েছেদুই ছেলে এক মেয়েবিস্ময়কর মনে হলেও সত্যি তিনি প্রায়ই তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। 

মুত্তালিব সাহেবের একটাই মেয়ে মীনাক্ষিহেলেনার দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি মীনাক্ষীকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দেনমীনাক্ষীর বয়স তখন আটসে এমনই কান্নাকাটি শুরু করে যে তিনি নিজেই মেয়েকে তার মাকাছে রেখে আসেন এবং হুঙ্কার দিয়ে বলেন, তােকে যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখি তাহলে কিন্তু কাঁচা খেয়ে ফেলব

আর খবরদার আমাকে বাবা ডাকবি নাগোঁফওয়ালা যে ছাগলটার সঙ্গে তাের মাবিয়ে হয়েছে তাকে বাবা ডাকবিআমাকে নাম ধরে ডাকবিমিস্টার মুত্তালিব ডাকবিফাজিল মেয়েসেই মীনাক্ষী এখন থাকে স্বামীর সঙ্গে নিউ অর্লিন্সেটেলিফোনে বাবার খোজ খবর প্রায়ই করেমুত্তালিব সাহেব কখনাে টেলিফোন করেন না

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

কারণ তিনি মেয়ের টেলিফোন নাম্বার বা ঠিকানা জানেন নাকখনাে জানার আগ্রহ বােধ করেন নিভদ্রলােক যৌবনে নানান ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য করেছেনকোনােটিই তেমন জমে নিজীবনে শেষ বেলায় তার সঞ্চয় অতীশ দীপংকর রােডে দুতলা একটি বাড়িতেরশ সিসির লাল রঙের একটা টয়ােটা এবং ব্যাংকে কিছু ফিক্সড ডিপােজিটএক সময় ভেবেছিলেন ফিক্সড ডিপােজিটের সুদের টাকায় জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেনএখন তা ভাবছেন নাপ্রায়ই তাকে মূল সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে। 

মুত্তালিব সাহেব শামা মেয়েটিকে অত্যন্ত পছন্দ করেনকোনাে এক বিচিত্র কারণে তিনি চান না তার পছন্দের কথাটা শামা জানুকশামার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি তটস্থ হয়ে থাকেনতার একটাই চিন্তা অস্বাভাবিক মমতার ব্যাপারটা তিনি কীভাবে গােপন রাখবেনতার ধারণা এই কাজটা তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবেই করছেনবাস্তব সে রকম নাশামা ব্যাপারটা খুব ভাল মতাে জানে। 

বিকেলে শামাকে দোতলায় উঠতে দেখে তিনি ধমকের গলায় বললেন, টেলিফোন করতে এসেছিস? তােকে একশবার বলেছি এটা পাবলিক টেলিফোন না। 

শামা বলল, টেলিফোন করতে আসি নিআপনার পায়ের অবস্থা জানতে এসেছিপায়ের অবস্থা কী ? হাঁটু কি বাঁকা হচ্ছে না আগের মতােই আছে

মুত্তালিব সাহেব জবাব দিলেন নাশামা বলল, এরকম রাগী রাগী মুখ করে বসে আছেন কেন

মুত্তালিব সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মাথা ধরেছেতুই কথা বলিস নাতােতাের ক্যানক্যানে গলা শুনে মাথা ধরা আরাে বেড়ে যাচ্ছেতুই যে জন্যে এসেছিস সেটা শেষ করে বিদেয় । 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

আমি কী জন্যে এসেছি

টেলিফোন করতে এসেছিসতৃণা না কতগুলি মেয়ে বান্ধবী ভাল জুটিয়েছিসবেয়াদবের এক শেষ। 

আপনার সঙ্গে কী বেয়াদবি করল ? রাত সাড়ে এগারােটার সময় টেলিফোন করে বলে, আপনাদের একতলায় যে থাকে, শামা নাম, তাকে একটু ডেকে দিনতােকোনাে স্লামালাইকুম নেইকিছু নেই। 

আপনি কী করলেন? খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন? আমি বললাম, রাত সাড়ে এগারােটা বাজেএটা আড়ার সময় না ঘুমাতে 

যাবার সময়বিছানায় যাওঘুমাবার চেষ্টা কর। 

এটা বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন ? 

খট করে রাখলাম না, যেভাবে রাখতে হয় সেভাবেই রাখলামতুই দুনিয়ার মানুষকে আমার টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছিস এটা ঠিক না। 

আর দেব না। যাদেরকে দিয়েছিস তাদের বলে দিবি কখনাে যেন এই নাম্বারে তােকে খোজ করে। 

আচ্ছা বলে দেবআপনি দয়া করে রাগে দাঁত কিড়মিড় করবেন নাআপনার ফলস দাত খুলে পড়ে যাবে। 

শামা হাসছেমুত্তালিব সাহেব ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটা খুবই সুন্দর করে হাসছেদেখলেই মায়া লাগেমুত্তালিব সাহেবের এখন বলতে ইচ্ছে করছেশামা শোন, তার বন্ধুদের বলিস টেলিফোন করতেআমি তােকে ডেকে দেব। 

শামা বলল, চাচা, ডাক্তার যে আপনাকে বলেছে দেয়াল ধরে হাঁটতে, আপনি কি হাঁটছেন?

আসুন আমার হাত ধরে ধরে হাঁটুনপ্রতিদিন আমি আধঘণ্টা করে আপনাকে হাঁটা প্র্যাকটিস করব। 

তার বদলে আমাকে কী করতে হবে

তার বদলে আপনি আমাকে আধঘণ্টা করে টেলিফোন করতে দেবেনঠিক আছে চাচা

, ঠিক নেইআজ বিকেলে তােদের এখানে কে এসেছিল ? খাতাউর সাহেব এসেছিলেনখাতাউরটা কে

এখনাে কেউ না তবে ভবিষ্যতে আমার হাসবেন্ড হয়ে আসরে নামতে পারেনসম্ভাবনা উজ্জ্বল। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

মুত্তালিব সাহেব হুইল চেয়ারে সােজা হয়ে বসলেনকনে দেখার মতাে বড় একটা ব্যাপার ঘটেছে অথচ কেউ তাকে খবর দেয় নি! খবর পাঠালে তিনি কি উপস্থিত হতেন না? হাঁটুতে সমস্যা তাই বলে হাঁটাহাঁটিতে পুরােপুরি বন্ধ না। 

ছেলে কী করে? বাবার অফিসে চাকরি করে। 

দেশ কোথায় ? দেশ হলাে বাংলাদেশকোন জেলা, গ্রামের বাড়ি কোথায় ? জানি নাছেলের নাম কি সত্যি খাতাউর ? জ্বি নাভাল নাম আতাউর তবে সব মহলে খাতাউর নামে পরিচিত। 

শামা আবারাে হাসছেমুত্তালিব সাহেব শামার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে আছেনহাসি খুশি এই মেয়েটা বিয়ের পর নিশ্চয়ই তার কাছে আসবে।

সহজ ভঙ্গিতে গল্প করবে না। 

চাচা

আমি কি আজ শেষবারের মতাে আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি? আমার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই খবরটা বন্ধুদের দেব| মুত্তালিব সাহেব শার্টের পকেট থেকে টেলিফোনের চাবি বের করে দিলেনতিনি তাঁর টেলিফোন সব সময় তালাবন্ধ করে রাখেন। 

শামা সবসময় খুব আয়ােজন করে টেলিফোন করেটেলিফোন সেটের পাশেই ইজি চেয়ারসে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে পড়েটেলিফোন সেটটা রাখে নিজের কোলেকথা বলার সময় তার চোখ থাকে বন্ধচোখ বন্ধ থাকলে যার সঙ্গে কথা বলা হয় তার চেহারা চোখে ভাসেতখন কথা বলতে ভাল লাগে। 

হ্যালাে তৃণা

কী করছিলি ? কিছু করছিলাম নাআচার খাচ্ছিলামকীসের আচার ? তেঁতুলের আচারখাবি ? হুঁ খাব। 

শামা হাসছেতৃণাও হাসছেশামা তার বিয়ের খবরটা কীভাবে দেবে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে নাতৃণা বলল, ১৭ তারিখের কথা মনে আছে ? মীরার 

বিয়ে। 

হু মনে আছে। 

বাসা থেকে পারমিশন করিয়ে রাখবিআমরা সারা রাত থাকবখুব হুল্লোড় করবজিনিয়া বলেছে সে তার বাবার কালেকশন থেকে এক বােতল শ্যাম্পেন নিয়ে আসবেদরজা বন্ধ করে শ্যাম্পেন খাওয়া হবে। 

(চলবে)

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *