ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি লতিফার হাত ধরে বসে রইলামএই প্রথম বুঝলাম লতিফার খুব জ্বরজ্বর আরাে বাড়লােএকসময় জ্বর নিয়ে ঘুমায়ে পড়লােতখন আমি নিজেই শব্দটা শুনলামঝন ঝন শব্দজুতার শব্দ নাঅন্যরকম শব্দঝন ঝন ঝন ঝন। 

ভয়একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লামতিনবার আয়াতুল কুরসি পড়ে হাত তালি দিলে সেই হাত তালির শব্দ যতদূর যায় ততােদূর কোনাে জ্বীভূত আসে নাহাত তালি দেয়ার পর ঝন ঝন শব্দ কমে গেলাে, তবে পুরাপুরি গেলাে নাআমি সারারাত জেগে কাটালাম। 

ভােরবেলা সব স্বাভাবিকরাতে যে এতাে ভয় পেয়েছিলাম মনেই রইলাে নালতিফার গায়েও জ্বর নেইসে ঘর দোয়ার গুছাতে শুরু করলােএকতলার সর্বদক্ষিণের দুটা ঘর আমরা নিয়েছিবারান্দা আছেকাছেই কলঘরলতিফা নিজের সংসার ঠিকঠাক করতে 

ব্যস্ত হয়ে পড়লােদারােয়ান বলরাম সাহায্য করার জন্য চলে আসলােবলরামের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছিআদি বাড়ি নেপালে। দশ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছে আর ফিরে যায়নিএখন পুরােপুরি বাঙালীবাঙালী একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলােসে মেয়ে মরে গেছেবলরামের এক ছেলে আছেখুলনার এক ব্যাংকের দারােয়ানছেলে বিয়েশাদী করেছেবাবার কোনাে খোজখবর করে না। 

ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ

বলরামের সংগে অতি অল্প সময়ে লতিফার ভাববলরাম লতিফাকে মা ডাকা শুরু করলােআমি নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানে চলে গেলামফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলাে। 

বাড়িতে ঢুকে দেখি বারান্দায় পা ছড়িয়ে লতিফা বসে আছেতার মুখ শুকনাআমি বললাম, কি হয়েছে

ভয় লাগছেকিসের ভয়?বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলামএকটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছিকি স্বপ্ন?দেখলাম আমি ঘুমাচ্ছিএকটা লম্বা, কালাে এবং খুব মােটা লােক ঘরে ঢুকলােলােকটার সারা শরীরে বড় বড় ললামকোনাে দাত নেইচোখগুলা অসম্ভব ছােট ছােটদেখাই যায় না এরকমহাতের থাবাগুলিও খুব ছােটবাচ্চা ছেলেদের মতােআমি লােকটাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলামসে বললাে, এই ভয় পাস কেন? আমার নাম কফিল

আমিতাে তাের সাথেই থাকিতুই টের পাস না? তুই বিয়ে করেছিস আমি কিছু বলি নাইএখন আবার সন্তান হবেভালােমতাে শুনে রাখ তাের সন্তানটারে আমি শেষ করে দিবােএখনি শেষ করতামএখন শেষ করলে তাের ক্ষতি হবেএইজন্যে কিছু করছি নাসন্তান জন্মের সাতদিনের ভিতর আমি তারে শেষ করবােএই বলেই সে আমারে ধরতে আসলােআমি চীৎকার করে জেগে উঠলামতারপর থেকে এইখানে বসে আছি। 

আমি বললাম, স্বপ্ন হলাে স্বপ্নকতত খারাপ খারাপ স্বপ্ন মানুষ দেখেসবচেবেশি খারাপ স্বপ্ন দেখে পােয়াতী মেয়েছেলেতাদের মনে থাকে মৃত্যুভয়। 

কথাবার্তা বলে লতিফাকে মােটামুটি স্বাভাবিক করে তুললামসে ঘরের কাজকর্ম করতে লাগলােরান্না করলােআমরা সকাল সকাল খাওয়াদাওয়া করলামতারপর বাগানে হাঁটতে বের হলাম। লতিফা বললাে, এই বাড়িতে একটা দোষ আছে সেইটা কি আপনি জানেন

ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ

কি দোষ

এই বাড়িতে একটা খারাপ কুয়া আছেসিদ্দিক সাহেবের চার বছর বয়সের একটা ছােট্ট মেয়ে কুয়ায় পড়ে মারা গিয়েছিলােকুয়াটা দোষী| কি যে তুমি বলােকুয়া দোষী হবে কেন? বাচ্চা মেয়ে খেলতে খেলতে পড়ে 

গেছে। 

তা না, কুয়াটা আসলেই দোষীকে বলেছে

বলরাম বলেছেকুয়াটার মুখ সিদ্দিক সাহেব টিনদিয়ে ঢেকে দিয়েছেনসেই টিনে রাতের বেলা ঝনঝন শব্দ হয়মনে হয় ছােট কোনাে বাচ্চা টিনের উপরে লাফায়তুমি গত রাতে কোনাে ঝনঝন শব্দ শােনাে নাই

আমি মিথ্যা করে বললাম, নাআমি কিন্তু শুনেছি। 

আমি বলরামের উপর খুব বিরক্ত হলামএইসব গল্প বলে ভয় দেখানাের কোনাে মানে হয়? ঠিক করলাম ভােরবেলায় তাকে ডেকে শক্তভাবে ধমক দিয়ে দেবাে। 

রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ে লক্ষ্য করলাম লতিফার জ্বর এসেছেসে কেমন ঝিম মেরে গেছেমনটা খারাপ হয়ে গেলােহারিকেন জ্বালিয়ে রেখে ঘুমুতে গেলামগভীর রাতে ঘুম ভাঙলােলতিফা আমাকে ঝাকাচ্ছেঘর অন্ধকারলতিফা বললাে, হারিকেন আপনা আপনি নিভে গেছেআমার বড় ভয় লাগতেছে। 

আমি হারিকেন জ্বালালামআর তখনি ঝনঝন শব্দ পেলামএকবার নাবেশ কয়েকবার। 

লতিফা ফিসফিস করে বললাে, শব্দ শুনলেন? আমি জবাব দিলাম নালতিফা কাদতে লাগলােযতােই দিন যেতে লাগলাে লতিফার অবস্থা ততােই খারাপ হতে লাগলােরােজ সে কফিলকে স্বপ্ন দেখেকফিল তাকে শাসিয়ে যায়বারবার মনে করিয়ে দেয় বাচ্চা হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সে বাচ্চা নিয়ে নিবেমনের শান্তি পুরােপুরি নষ্ট হয়ে গেলাে। 

ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি লতিফাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলাম, সে রাজি হলাে নাপ্রয়ােজনে সে এইখানেই মরবে কিন্তু বাবার বাড়িতে যাবে নাআমি ভাই জন্যে তাবিজ কবচের ব্যবস্থা করলাম, বাড়ি বন্ধনের ব্যবস্থা করলামআমি দরিদ্র মানুষ তবু একটা কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করলাম যেন সে সারাক্ষণ লতিফার সংগে থাকে। 

কিছুতেই কিছু হলাে না। 

এক সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে দেখি লতিফা খুব সাজগােজ করেছেলাল একটা শাড়ি পরেছেপান খেয়ে ঠোট লাল করেছেবেণী করে চুল বেঁধেছেবেণীতে চারপাচটা জবা ফুলসে পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছেএকটু দূরে বলরাম এবং কাজের মেয়েটাতারা দুজন ভীত চোখে তাকিয়ে আছে লতিফার দিকে। 

আমাকে দেখেই লতিফা খিলখিল করে হেসে উঠলােহাসি আর থামতেই চায় আমি বললাম, কি হয়েছে লতিফা? লতিফা হাসি থামালাে এবং আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে পুরুষের গলায় বললাে, মৌলানা আসছেমৌলানারে অজুর পানি দেওনামাজের পাটি দেওকেবলা কোন দিকে দেখাইয়া দাওটুপী দেও, তসবি দেও। 

আমি বললাম, এইরকম করতেছাে কেন লতিফা

লতিফা আবার হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে বললাে, ওমা মেয়েছেলের সংগে দেখি মৌলানা কথা বলেছিঃছিঃছিঃমৌলানার লজ্জা নাই। 

আমি আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম। 

আমাকে থামিয়ে দিয়ে লতিফা চিৎকার করে বললাে, চুপ করােআমার নাম কফিলতাের মতাে মৌলানা আমি দশটা হজম কইরা রাখছি। গােটা কোরান শরীফ আমার স্থআমার সংগে পাল্লা দিবি? আয় পাল্লা দিলে আয়প্রথম থাইকা শুরু করি ... হি হিভয় পাইছস? ভয় পাওনেরই কথা

ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ

বেশি ভয় পাওনের দরকার নাতােরে আমি কিছু বলবাে নাতাের বাচ্চাটারে শেষ করবােতুই মৌলানা মানুষ, তুই বাচ্চা দিয়া কি করবি? তুই থাকবি মসজিদেমসজিদে বইস্যা তুই তাের আল্লাহরে ডাকবিপুলাপান না থাকাই তাের জন্যে ভালােহিহিহি

একটা ভয়ংকর রাত পার করলাম ভাইসাব

(চলবে)

ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *