ভয় (পর্ব-৩)-হুমায়ূন আহমেদ

প্রাইভেট কলেজে কলেজে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন বন্ধুদের দেখাদেখি জিআরই পরীক্ষা দিয়ে ফেললামজিআরই পরীক্ষা কি তা কি আপনি জানেন? গ্রাজুয়েট রেকর্ড একজামিনেশনভয়

আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হতে হলে এই পরীক্ষা দিতে হয়আমি জানি” 

এই পরীক্ষায় আমি আশাতীত ভাল করে ফেললামআমেরিকান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে আমন্ত্রণ চলে এলচলে গেলামপি এইচ ডি করলাম প্রফেসর হােবলের সঙ্গেআমার পিএইচডি ছিল গ্রুপ থিওরীর একটি শাখায় নন এ্যাবেলিয়ান ফাংশানের উপরপি এইচ ডির কাজ এতই ভাল হল যে আমি রাতারাতী বিখ্যাত হয়ে গেলামঅংক নিয়ে বর্তমান কালে যারা নাড়াচাড়া করেনতারা সবাই আমার নাম জানেনঅংক শাস্ত্রের একটি ফাংশান আছে যা আমার নামে পরিচিতআর কে এক্সপােনেনশিয়ালআর কে হচ্ছে রাশেদুল করিম। 

পি এইচ ডির পর পরই আমি মন্টানা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলামসেই বৎসরই বিয়ে করলামমেয়েটি মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের ছাত্রী স্প্যানীশ আমেরিকাননাম, জুডি বারনার। 

প্রেমের বিয়ে?প্রেমের বিয়ে বলাটা বােধ হয় ঠিক হবে নাবাছাবাছির বিয়ে বলতে পারেনজুডি অনেক বাছাবাছির পর আমাকে পছন্দ করল। 

আপনাকে পছন্দ করার কারণ কি? . আমি ঠিক অপছন্দ করার মত মানুষ সেই সময় ছিলাম নাআমার একটি চোখ পাথরের ছিল নাচেহারা তেমন ভাল না হলেও দুটি সুন্দর চোখ ছিলআমার মা বলতেন, রাশেদের চোখে জন্ম, কাজল পরাননাসুন্দর চোখের ব্যাপারটা অবশ্য ধর্তব্য নয়আমেরিকান তরুনীরা প্রেমিকদের সুন্দর চোখ নিয়ে মাথা ঘামায় না তারা দেখে প্রেমিক কি পরিমাণ টাকা করেছে এবং ভবিষ্যতে কি পরিমাণ টাকা সে করতে পারবে

সেই দিক দিয়ে আমি মােটামুটি আদর্শ স্থানীয় বলা চলেত্রিশ বছর বয়সে একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি পজিশন পেয়ে গেছিট্যানিউর পেতেও কোন সমস্যা হবে নাজুডি স্বামী হিসেবে আমাকে নির্বাচন করলআমার দিক থেকে আপত্তির কোন কারণ ছিল নাজুডি চমক্কার একটি মেয়েশত বৎসর সাধনার ধন হয়ত নয় তবে বিনা সাধনায় পাওয়ার মত মেয়েও নয়। 

বিয়ের সাতদিনের মাথায় আমরা হানিমুন করতে চলে গেলাম সানফ্রান্সিসকোউঠলাম হােটেল বেডফোর্ডেদ্বিতীয় রাত্রির ঘটনাঘুমুচ্ছিলামকান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাকিয়ে দেখি জুডি পাশে নেই, ঘড়িতে রাত তিনটা দশ বাজছেবাথরুমের দরজা বন্ধ সেখান থেকে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ আসছেআমি বিস্মিত হয়ে উঠে গেলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে বললাম, কি হয়েছে? জুডি কি হয়েছে? কান্না থেমে গেলতবে জুডি কোন জবাব দিল না। 

অনেক ধাক্কাধাক্কির পর সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখতে লাগলআমি বললাম, কি হয়েছে

সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ভয় পেয়েছিকিসের ভয়? জানি না কিসের ভয়। 

ভয় পেয়েছাে তাে আমাকে ডেকে তােলনি কেন? বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ছিলে কেন

জুডি জবাব দিল নাএক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলআমি বললাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বলতাে

সকালে বলবনা এখনি বলকি দেখে ভয় পেয়েছ

জুডি অশষ্ট স্বরে বলল, তােমাকে দেখেআমাকে দেখে ভয় পেয়েছ মানে? আমি কি করেছি

জুডি যা বলল তা হচ্ছে রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়হােটেলের ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল, এই আলােয় সে দেখে তার পাশে যে শুয়ে আছে সে কোন জীবন্তু মানুষ নয়মৃত মানুষযে মৃত মানুষের গা থেকে শবদেহের গন্ধ বেরুচ্ছেসে ভয়ে কাঁপতে থাকে তবু সাহসে হাত বাড়িয়ে মানুষটাকে স্পর্শ করেস্পর্শ করেই চমকে উঠে, কারণ মানুষটার শরীর বরফের মতই শীতলসে পুরােপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমি মারা গেছিতার জন্যে এটা বড় ধরণের শক হলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখায়টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দেয় এবং হােটেল ম্যানেজারকে টেলিফোন করবার জন্যে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নেয়

ঠিক তখন সে লক্ষ্য করে মৃত দেহের দুটি বন্ধ চোখের একটি ধীরে ধীরে খুলছেসেই একটি মাত্র খােলা চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকেজুডি টেলিফোন ফেলে দিয়ে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়এই হল ঘটনা| রাশেদুল করিম কথা শেষ করে সিগারেট ধরালেনহাতের ঘড়ি দেখলেনআমি বললাম, থামলেন কেন

সাতটা বেজেছেআপনি বলেছেন সাতটার সময় আপনার জন্যে চা আসেআমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিচা খেয়ে শুরু করবআমার গল্প শুনতে আপনার কেমন লাগছে? | ইন্টারেস্টিংএই গল্প কি আপনি অনেকের সঙ্গে করেছেন? আপনার গল্প বলার ধরণ থেকে মনে হচ্ছে অনেকের সঙ্গেই এই গল্প করেছেন। 

আপনার অনুমান সঠিকথেকে সাতজনকে আমি বলেছিএর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেনপুলিশের লােক আছে। 

পুলিশের লােক কেন?গল্প শেষ করলেই বুঝতে পারবেন পুলিশের লােক কি জন্যে। 

চা চলে এলচায়ের সঙ্গে পরােটা ভাজিমিসির আলি নাশতা করলেনরাশেদুল করিম সাহেব পর পর দুকাপ চা খেলেন। 

আমি কি শুরু করব ?” 

জি শুরু করুন। 

আমাদের হানিমুন মাত্র তিন দিন স্থায়ী হলজুডিকে নিয়ে পুরানাে জায়গায় চলে এলামমনটা খুবই খারাপজুডির কথা বার্তা কিছুই বুঝতে পারছি নারােজ রাতে সে ভয়ংকর চিৎকার করে উঠেছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়আমি যখন জেগে উঠি তাকে সান্তনা দিতে যাই তখন এমন ভাবে তাকায় যেন আমি একটা পিশাচ কিবা মূর্তিমান শয়তানআমার দুঃখের কোন সীমা রইল নাসেই সময় নন এবেলিয়ান গ্রুপের উপর একটা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলামআমার দরকার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার মত পরিবেশমানসিক শান্তিসব দূর হয়ে গেলঅবশ্যি দিনের বেলায় জুডি স্বাভাবিকসে বদলাতে শুরু করে সূর্য ডুবার পর থেকেআমি তাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম| সাইকিয়াট্রিস্ট প্রথমে সন্দেহ করলেন সমস্যা ড্রাগ ঘটিত

হয়তাে জুডি ড্রাগে অভ্যস্তসেই সময় বাজারে হেলুসিনেটিং ড্রাগ এল এস ডি প্রথম এসেছেশিল্প সাহিত্যের লােকজন শখ করে এই ড্রাগ খাচ্ছেনবড় গলায় বলছেন মাইণ্ড অলটারিং ট্রিপ নিয়ে এসেছিজুডি ফাইন আর্টস এর ছাত্রীট্রিপ নেয়া তারপক্ষে খুব অস্বাভাবিক না। 

দেখা গেল ড্রাগ ঘটিত কোন সমস্যা তার নেইসে কখনাে ড্রাগ নেয়নিসাইকিয়াট্রিস্টরা তার শৈশবের জীবনে কোন সমস্যা ছিল কিনা তাও বের করতে চেষ্টা করলেনলাভ হল নাজুডি এসেছে গ্রামের কৃষক পরিবার থেকেধরণের পরিবারে তেমন কোন সমস্যা থাকে নাতাদের জীবন যাত্রা সহজ এবং স্বাভাবিক। 

সাইকিয়াট্রিস্ট জুডিকে ঘুমের অষুধ দিলেনকড়া ডােজের ফেনােবারবিটনআমাকে বললেন, আপনি সম্ভবত লেখা পড়া নিয়ে থাকেনস্ত্রীর প্রতি বিশেষ করে নববিবাহিত স্ত্রীর প্রতি যতটা সময় দেয়া দরকার তা দিচ্ছেন নাআপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর এক ধরণের ক্ষোভ জন্ম গ্রহণ করেছেসে যা বলছে তা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। 

জুডির কথা একটাই আমি ঘুমুবার পর আমার দেহে প্রাণ থাকে নাএকজন মৃত মানুষের শরীর যেমন অসাড় পড়ে থাকে আমার শরীরও সে রকম পড়ে থাকেঘুমের মধ্যে মানুষ হাত নাড়ে, পা নাড়ে আমি তার কিছুই করি না। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলি নাগা হয়ে যায় বরফের মত শীতল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *