যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ

বাবার রিঅ্যাকশান যথেষ্ট ইন্টারেস্টিংছেলে চলে যাবার পর বাবা আমাকে ডেকে বললেনছেলে যে পাঞ্জাবিটা এনেছে, সেটা বাথরুমে রেখে আয় আমি বললাম, কেন? বাবা বললেন, আমি পাঞ্জাবির উপর পিশাব করব, এই জন্যে

হ্যালাে শােন, তিন মিনিট পার হয়েছেএখন তুমি টেলিফোন নামিয়ে রাখতে পারযে তােমাকে দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে, তার প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ সে টাকাটা পাঠিয়েছে বলেই তুমি আমাকে টেলিফোন করেছ। 

টাকাটা কে দিতে পারে বলাে তাে ? ইমনের মা না তাে ? উনি পরিত্যক্ত স্বামীকে টাকা পাঠাবেন কী জন্যে। 

সে জানে আমি হতদরিদ্রছেলে আসছে আমার সঙ্গে থাকতেছেলের যেন কষ্ট না হয়সরাসরি আমাকে দিতে লজ্জা পাচ্ছিল বলে কাউকে দিয়ে খামে ভরে টাকাটা পাঠিয়েছে। 

হতে পারেসম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় নাআমি কি টাকার ব্যাপারটা তাকে জিজ্ঞেস করব? জিজ্ঞেস না করাই ভালােতিনি যদি টাকাটা দিয়ে থাকেন, তাহলে কোনাে কোনােভাবে সেটা তিনি তােমাকে জানাবেন। 

কেন জানাবে

জানাবেন কারণ কোনাে মানুষ যখন কারাের উপকার করে, তখন তার একটা চেষ্টাই থাকে উপকারের বিষয়টা মনে করিয়ে দেবারকোনাে মানুষই মহাপুরুষ নাএই পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটা জায়গাতে মহাপুরুষরা বাস করেনআর কোথাও বাস করেন না। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ

মহাপুরুষরা কোথায় বাস করেন ? ডিকশনারিতে। 

আনিকা টেলিফোন রেখে দিয়ে উঠে বসলনিজেই কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলজ্বর আগের মতােই আছে নাকি কিছুটা কমেছে বােঝা যাচ্ছে নাবালিশের নিচে থার্মোমিটার আছেইচ্ছা করলেই জ্বর দেখা যায়দেখতে ইচ্ছা করছে নাবরং জ্বর নেইএমন ভাব করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করছেসাজতে ইচ্ছা করছেমিতুর দেয়া শাড়িটা পরে কোনাে একটা পার্লারে গিয়ে চুল বেঁধে এলে কেমন হয় ? আজকাল সব মেয়েরা ফ্যাসিয়েল করেএতে 

কি মুখের চামড়া কমনীয় হয়আনিকা কখনাে এই জিনিস করে নিএকবার করে দেখলে হয়আনিকা গুনগুন করে গাইলােওগাে সুন্দরী, আজ অপরূপ সাজে সাজো সাজো সাজোএকটি লাইন বলেই চুপ করে গেলতার খুব 

সুন্দর গানের গলা ছিলতাদের স্কুলের গানের টিচার শিবু স্যার বলতেন, তাের গানের গলা প্রতিমার চেয়েও মিষ্টিতুই গান করলে খুব নাম করবিগান শিখবি ? আমি তােকে গান শেখাবআমাকে কোনাে টাকাপয়সা দিতে হবে 

নাতুই শুধু ভালাে দেখে একটা হারমােনিয়াম কিনবি । 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ

আনিকা বাবাকে হারমােনিয়ামের কথা বলেছিলমতিয়ুর রহমান অনেকক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুধু হারমােনিয়াম ? ঘুংঘুর কিনে দেই ? বাইজি হয়ে যা তারপর তােকে পাড়াতে রেখে আসি গান করবি, নাচ করবিদুই হাতে টাকা কামাবি। 

রেকর্ড শুনে শুনে শেখা একটা গান শিবু স্যার প্রায় জোর করেই তাকে দিয়ে স্কুলের রজতজয়ন্তীতে গাইয়েছিলেননজরুলের গানওগাে মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মমসেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রীতিনি অনুষ্ঠান শেষে তাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, নাম কী মা তােমার ? আনিকা ভয়ে ভয়ে নিজের নাম বললশিক্ষামন্ত্রী বললেন, তােমার গান শুনতে শুনতে হঠাৎ চোখে পানি এসে গেলআমরা রাজনীতি করা ঘাঘু লােকআমাদের চোখে পানি আনা কঠিন ব্যাপারখুবই তৃপ্তি পেয়েছি গাে মা। 

আরাে অনেক বড় বিস্ময় আনিকার জন্য অপেক্ষা করছিলকিছুদিন পর শিল্পকলা একাডেমির ডিজি এক চিঠিতে জানালেন শিশুশিল্পীদের একটা দল তুরস্ক যাবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যােগ দেবার জন্যনজরুলসঙ্গীতের তালিকায় আনিকার নাম আছেসে যেন আগামী শুক্রবার থেকে রিহার্সেলে আসে। 

তুরস্ক যাওয়া তাে অনেক পরের ব্যাপার, ভয়ে এই চিঠির কথা সে তার বাবাকে বলতেই পারে নিস্কুল থেকে অ্যাসিসটেন্ট হেডমিসট্রেস রাবেয়া আপা এসেছিলেনমতিয়ুর রহমান তার কাছ থেকে তুরস্ক বিষয়ক সব কথা শুনে গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার কি মস্তিষ্কবিকৃতি হয়েছে ? আমি আমার মেয়েকে একা একা পাঠাব তুরস্ক

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ

অ্যাসিসটেন্ট হেডমিসট্রেস বললেন, একা তাে যাচ্ছে না, আরাে অনেক ছেলেমেয়ে যাচ্ছে। 

মতিয়ুর রহমান বললেন, আপনাদের মস্তিষ্ক বিকৃতিরােগ হয়েছে বলে তাে আমার হয় নাইআমার মেয়ে কোথাও যাবে নামেয়ের যথেষ্ট সাহস হয়ে গেছেআমাদের কিছু না জানিয়ে স্কুল ফাংশনে গান গায়গােপনে গােপনে আঙ্গুরবালা আমি তার বালাগিরি বের করছি। 

তার ইচ্ছা ছিল মেয়েকে কঠিন শাস্তি দেনমনােয়ারার জন্য পারলেন নাকঠিন গালাগালি দিয়েই তাকে খুশি থাকতে হলােশেষ পর্যায়ে শুধু বললেন  

তােমাকে আর স্কুলে যেতে হবে নাবাসায় থাকবেমাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করবে অতি শিগগিরই তােমার বিবাহের ব্যবস্থা করছিকোনাে বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবার আগেই ঘর থেকে আপদ বিদায় করতে হবেতােমার যা অবস্থাহঠাৎ কোনাে একদিন দেখব পেট বাধিয়ে ঘরে ফিরেছ। 

মতিয়ুর খুব আগ্রহ নিয়ে টিভিতে রান্নার একটা প্রােগ্রাম দেখছেনমুরগি মুসাল্লাম যে এত সহজে রান্না করা যায় তার ধারণায় ছিল নাহাতের কাছে কাগজকলম থাকলে সুবিধা হতােলিখে রাখতে পারতেন। 

আনিকাকে সাজগােজ করে বের হতে দেখে তিনি টিভি থেকে মুখ ফেরালেনবিস্মিত হয়ে মেয়েকে ডাকলেনজ্বর এসেছে বলে যে মেয়ে অফিসে যায় নি, সে এখন যাচ্ছে কোথায় ? মিতুর বদ জামাইটা যে শাড়ি নিয়ে এসেছে, সেই শাড়িটাই সে পরেছেদুয়েদুয়ে চার মিলানাে যাচ্ছেআনিকার গন্তব্য মিতুর শ্বশুরবাড়ি অথচ তিনি কঠিন গলায় বলে দিয়েছিলেনঐ বাড়িতে যদি কেউ যায়, তাহলে তার ঠ্যাং ভেঙে ফেলা হবে। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমে

তুই যাচ্ছিস কোথায় ? কাজে যাচ্ছি। 

কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম জ্বরে কে কে করছিসএখন আবার কাজে যাচ্ছিসকী এমন কাজ যে পটের রাণী সেজে যেতে হয়

আনিকা বলল, পটের রাণী সাজি নি বাবা শুধু নতুন একটা শাড়ি পরেছি। 

তুই কি মিতুর শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিস ? বাড়িতে গেলে আমি কিন্তু তাের ঠ্যাং ভেঙে দেব। 

আনিকা শান্ত গলায় বলল, ঠ্যাং ভাঙাভাঙি তাে অনেক করেছএখন এইসব বাদ দাওটিভি দেখছিলে, টিভি দেখ। 

মতিয়ুর রহমান কঠিন গলায় বললেন, তার মানে ? আনিকা বলল, যা বলেছি তার মানে তােমার না বােঝার কথা নাতুই মিতুর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস কি যাচ্ছিস না সেটা বল

আনিকা বলল, হ্যা যাচ্ছি এখন তুমি কী করবে করােহাতুড়ি নিয়ে আসঠ্যাং ভাঙো। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *