রম্য কথা-পর্ব-(শেষ)-আনিসুল হক

রম্য কথা

কতিপয় হাস্য-কৌতুক 

এত দিন বাবা গাড়ি চালাতেন।

মা পাশে বসতেন। ছেলে বসত পেছনে।

আজ ছেলে বড় হয়েছে। সে নিজেই গাড়ি চালাতে পারে।

লাইসেন্সও পেয়ে গেছে। 

ছেলে গাড়ি চালাবে। মা বললেন, ওগাে, তুমি ওর পাশে বসাে। আমি পেছনে বসি। 

বাবা বললেন, না। আমি পেছনেই বসব। ছেলে বলল, বাবা তুমি কেন পেছনে বসবে? 

কারণ এত দিন আমি যখন গাড়ি চালাতাম, তখন তুমি পেছনে বসে আমার সিট সারাক্ষণ পা দিয়ে ঠেলতে। এবার তােমার পালা। তুমি গাড়ি চালাবে। আর আমি পা দিয়ে পেছন থেকে ঠেলব। 

মাননীয় চালকেরা, চালকের আসনে যখন বসবেন, জানবেন, পেছনের যাত্রীরা সিটে ঠেলা দেবেই। 

ডাক্তার বললেন, আপনার দুটো রােগ হয়েছে । খারাপটা আগে শুনবেন, নাকি ভাললাটা? 

খারাপটাই শুনি। আপনার এইডস হয়েছে। আর ভালােটা? আপনার আলঝেইমার হয়েছে। আপনি সবকিছু দ্রুত ভুলে যাবেন। রােগী হেসে বলল, ভাগ্যিস আমার এইডসের মতাে ভয়াবহ কিছু হয়নি! 

আমাদের দেশের মানুষের আলঝেইমার-জাতীয় সমস্যা আছে। তারা অতীত ভুলে যায়। বর্তমানটা মনে রাখে। 

অতএব সাধু সাবধান! 

একজন কাউবয় একটা পানশালায় ঢুকেছে। সে এই এলাকায় নতুন। নতুনদের খানিকটা অপদস্থ করাটা ওই এলাকার মানুষদের স্বভাব। 

কাউবয় বেরিয়ে দেখল, তার ঘােড়াটা নাই। 

সে ফিরে এসে ছাদের দিকে বন্দুক বাগিয়ে গুলি করে বলল, আমি এখন আরেকটা ড্রিঙ্কস নেব । সেটা খেয়ে বের হয়ে যদি দেখি আমার ঘােড়া যথাস্থানে বাধা নাই, আমি তা-ই করব, ডালাসে আমি যা করেছিলাম। 

রম্য কথা-পর্ব-(১৩)

কাউবয় আরেক গেলাস পানীয় নিয়ে শেষ করে বেরিয়ে দেখল, ঘােড়াটা যথাস্থানে বাঁধা । 

কাউবয় হাসল, একেই বলে শক্তের ভক্ত, নরমের যম । তখন একজন জিজ্ঞেস করল, ডালাসে আপনি কী করেছিলেন? বেরিয়ে দেখি ঘােড়া নাই, হেঁটে বাড়ি গিয়েছিলাম ।

সুন্দর কৌতুক । পুরােনােও। বাঙালিরা এটা জানে। ছােটবেলায় আমি সার্কাসের জোকারদের এই কৌতুক বলতে শুনেছি। বলছে, এই হাতি সর, সর, নাইলে কাইলকা যা করছিলাম, আজকাও কিন্তু তা-ই করুম। হুঁশিয়ার। 

হাতি সরে না। মাহুত বলে, কাইলকা কী করছিলা? নিজেই সইরা গেছিলাম।বাংলাদেশে এলে এই কাউবয়কে হেঁটেই বাড়ি যেতে হবে । এক মহিলা আরেক মহিলার সঙ্গে গল্প করছে। 

জানেন, আমার কুকুরটা খুব স্মার্ট ।

সে রােজ সকালে বেল বাজলেই দৌড়ে দরজায় যায় আর সকালের খবরের কাগজটা এনে আমাকে দিয়ে যায়। 

জানি, দ্বিতীয় মহিলা বলল। কী করে? 

আমার কুকুর রােজ জানালা দিয়ে আপনার কুকুরের কাণ্ড দেখে। সেই আমাকে বলেছে। 

স্মার্টনেসের প্রতিযােগিতায় এক মহিলা আরেক মহিলাকে হারাতে পারবে কি না আমরা জানি না। 

এক ভদ্রলােক তােতাপাখি কিনে এনে তাকে কথা বলা শেখাচ্ছেন। যত ভালাে ভালাে বুলিই শেখানাে হােক না কেন, তােতাপাখিটা বলে, ছেড়ে দে শালা, ছেড়ে দে শালা। 

রম্য কথা-পর্ব-(১৩)

ভদ্রলােক বললেন, আরেকবার যদি তুমি এই কথা বলাে, তােমাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখব। 

তােতাপাখি তবু বলে, ছেড়ে দে শালা।। 

লােকটা রেগে গিয়ে তাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখল। মিনিট পাঁচেক পর তােতাপাখিটাকে ফ্রিজ থেকে বের করে আনা হলে পাখিটা বলল, আমি আর তােমাকে গালি দেব না। মুক্তিও চাইব না। বলাে তাে, মুরগিগুলাে তােমাকে কী বলেছিল! 

কী ভাই বুঝলেন তাে? যদি না বােঝেন, তাহলে বিভিন্ন দেশের পুলিশের হরিণ খোজার কৌতুকটা আরেকবার মনে করেন। 

এইবার শেষ করে দেব। ওয়াশিংটন ডিসিতে একজন যাজক গেছেন ক্ষৌরকারের কাছে। চুল কাটাতে । চুল কাটানাের পরে যাজক নাপিতকে দাম দিতে চাইলেন । নাপিত বলল, তার কাছ থেকে সে টাকা নেবে না। ধর্মের প্রতি ভক্তি থেকে সে এই কাজটা বিনি পয়সায় করে দিচ্ছে। যাজক ফিরে গিয়ে কয়েকটা ধর্মীয় পুস্তক পাঠিয়ে দিলেন উপহারস্বরূপ। 

এরপর ওই দোকানে এলেন একজন শিক্ষক। তাকে বিনা পয়সায় চুল কেটে দিয়ে নাপিত বলল, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকে সে এই কাজটা বিনা পয়সায় করেছে। শিক্ষক ফিরে গিয়ে তাকে অনেকগুলাে উস্কৃষ্ট বই পাঠিয়ে দিলেন। 

এরপর এলেন একজন সিনেটর। তাকেও নাপিত চুল কেটে দিয়ে বলল, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই কাজের বিনিময়ে কোনাে পয়সা নিতে চায় না। 

রম্য কথা-পর্ব-(১৩)

সিনেটর ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন। 

এরপর তার দোকানের সামনে সিনেটরদের লাইন পড়ে গেল। শুল্কমুক্ত গাড়ি দেওয়া হলেও সিনেটররা একই কাজ করতেন। 

সব সমস্যারই কিন্তু সমাধান আছে, যদি তােমার হাতে অস্ত্র থাকে। এক খ্রিষ্টান মহিলা চান, তার মৃত স্বামীকে কবরে নামানাে হােক নীল পােশাক পরিয়ে। কবরে নামানাের আগে দেখা গেল, মৃতের পরনে খয়েরি পােশাক। মহিলা আপত্তি জানালেন। সমাধিক্ষেত্রের কর্মীরা বলল, এখন আর সময় নাই। এইভাবেই চলুক। মহিলা তাতেও আপিত্ত জানালে ৫ মিনিটে সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হলাে। 

কী করে? 

কর্মীরা বলল, পােশাক বদল করতে সময় লাগত। মাথাটা বদল করতে সময় লাগেনি। কারণ হাতে তরবারি ছিল। 

আনিসুল হক: কবি, সাংবাদিক ও লেখক। 

৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ 

টুয়েন্টি-টুয়েন্টি 

বিশ্ব এখন ব্যস্ত টুয়েন্টি-টুয়েন্টি নিয়ে। কয়েকটা খেলা দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ টুয়েন্টি-টুয়েন্টি, সেটাও যদি পানসে মনে হয়, তবে টুয়েলভ টুয়েলভই মনে হচ্ছে ভালাে। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০ ওভারে ১২০ পেরিয়েছে, তবু সেই খেলা দেখে মনে হচ্ছে, এ কী দেখছি। পেটায় না কেন? দুদিনেই অভ্যাস এ রকম খারাপ হয়ে গেছে। খালি মনে হচ্ছে, পেটাও পেটাও।

চার আর ছক্কা হলেই চলবে চিয়ার লিডারদের নাচ, উদ্দাম, উচ্চকিত, উচ্চনাদ বাদ্যের তালে তালে । সময় বেশি নাই, মাত্র ২০ ওভার খেলতে হবে, এর মধ্যেই শ্রীলঙ্কার মতাে করে ফেলা চাই ২৬০। যে যুগের যে ভাও। এখন সবকিছুই ইনস্ট্যান্ট । অত সময় আছে নাকি যে রয়ে সয়ে সময় নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভােগ করব। সবকিছু তৈরি থাকবে, চাওয়ার আগেই পেয়ে যাব, থালা-বাসনের কারবার নাই, সরাসরি মুখে, চিবানাের কষ্টটা তবু করতেই হয় এখনাে, ভবিষ্যতে আশা করি, তাও করতে হবে না । 

রম্য কথা-পর্ব-(১৩)

পৃথিবীর সবকিছু চলছে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ফরমুলা অনুসারে। এখন সম্পর্ক টুয়েন্টি-টুয়েন্টি, দেখা হবে, কথা হবে, ভাব আর স্বার্থে বিনিময় হবে, তারপর যে যার পথে চলে যাবে, কা তব কান্তা, পৃথিবীতে কে কাহার। এখন বন্ধুত্ব হবে টুয়েন্টি টুয়েন্টি, কাল তােমাকে আমার দরকার ছিল, তাই ব্যাটে বলে বেশ জমেছিল, আজ আর দরকার নাই তােমাকে, হে বন্ধু, বিদায়। যাব বলে থেমে থাকতে নেই।

প্রেমও হবে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি, ফাস্টফুডের মত, ইনস্ট্যান্ট কফির মতাে, তারপর ৪০ ওভার পর্যন্ত যদি টেকা গেল তাে গেল, না গেলে চার ঘণ্টার আগেই…আজ দুজনার দুটি পথ ওগাে দুটি দিকে গেছে বেঁকে । পালে হাওয়া লাগিবে, পােস্টমাস্টারদের মতাে হৃদয়ে দার্শনিক তত্ত্বও উদিত হওয়ার কারণ নাই, কেহই বর্ষাবিস্ফারিত নদীর দিকে তাকাইয়া বলিবে না, পৃথিবীতে কে কাহার । কারণ সে আগে থেকেই জানে, পৃথিবীতে। এই রূপ কত বিরহ-মিলন আছে। প্রেম একবার নয়, বারবার আসবে।

রম্য কথা-পর্ব-(১৩)

দাম্পত্যও এ রকম টুয়েন্টি-টুয়েন্টি হয়ে যাবে । তােমার পথে তুমি চলবে আমার পথে আমি। মধ্যখানে কিছুদিনের জন্যে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে যদি দেখা হয়েই যায়, দুই কাপ চা দুজনে পাশাপাশি বসে খেতেও পারি। তারপর ট্রেন এসে গেলে তােমার ব্যাকপ্যাক তােমার পিঠে, আমার ঝােলা ব্যাগ আমার কাঁধে। গতস্য শােচনা নাস্তি। সম্মুখে শান্তি পারাবার।। 

লেখাপড়া টুয়েন্টি-টুয়েন্টি হয়ে গেছে অনেক আগেই, অন্তত এই বাংলাদেশে। সারি সারি কোচিং সেন্টার। উত্তর লিখে দিচ্ছে শিক্ষকেরা, ছাত্ররা মুখস্থ করছে, উগরে দিচ্ছে। মূল টেক্সট কেউ পড়ছে না, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি স্কুলের বাচ্চাদের সামনে চিন্নাচ্ছেন, তােমরা শুধু অঙ্ক কোরাে না, গণিত শেখাে, প্রশ্নের আগে গণিত বইয়ের প্রতিটা অধ্যায়ে কতগুলাে বর্ণনা থাকে, জিনিসটা কী বুঝিয়ে বলা হয়, সেসব পড়াে, পড়ে বােঝাে। কে শুনবে কার কথা। গণিতের নামে অঙ্ক। আর আছে এমসিকিউ, টিক দিয়েই পার হয়ে যাওয়া চলে পরীক্ষা নামের বৈতরণী ।। 

রাজনীতিও হবে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি । এমনকি সংস্কারও। সবকিছু আসবে প্যাকেজে। প্যাকেজিংটা খুব দরকারি। মােড়কটা হতে হবে আকর্ষণীয়। ফয়েল পেপার, ভালাে ছাপা। 

বিচারও তা-ই হবে। র্যাব বানানাে হবে। যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করবে । ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার । স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। এই প্রক্রিয়ায় ইন্দিরা গান্ধী নকশাল দমন করেছিলেন। আমরাও পারব। পারতেই হবে। 

রম্য কথা-পর্ব-(১৩)

সবকিছু হবে সীমিত ওভারের। আমাদের সাহিত্য এখন সীমিত ওভারের, বড় বড় উপন্যাস এখন আর কেউ পড়বে না, লিখবে না, উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত-সরল সংস্করণ বেরােবে, দরকার পড়লে ধ্রুপদী উপন্যাসের কমিক গিলব আমরা। আমাদের নাটক এখন সীমিত ওভারের। এক নাটকে ১০ দিন শুটিং করার সময় নাই, কদরও নাই । মনে পড়ে, সাইদুল আনাম টুটুল নাল গ্রিন-এর শুটিং করতে দুই দফায় শুধু রংপুরেই ছিলেন ১০ দিন, এর বাইরে ঢাকাতেও শুটিং হয়েছিল। এখন এক দিনে দেড় পর্ব নামাতে হবে। দেশে চলছে দৈনিক সাবান (ডেইলি সােপ)। পাণ্ডুলিপিও নাকি লিখতে হয় না। সেটে যে কয়জন শিল্পী উপস্থিত আছেন, তাদেরকে দিয়েই পরিচালক উপস্থিত মতাে কাহিনী বানিয়ে নেন, পাত্র-পাত্রীরা সংলাপ বলতে থাকেন ইচ্ছামতাে।

আমাদের সাংবাদিকতাও এখন টুয়েন্টি-টুয়েন্টি । আমরা কোনাে কিছুর গভীরে যাব না। আমরা টেলিভিশনে বসব লাইভ টক শাে নিয়ে, দর্শক প্রশ্ন করবে, আমরা সব প্রশ্নের উত্তর জানি, ইনস্ট্যান্ট দিয়ে দেব। আমাদেরও গভীরে যেতে হবে না, একটা বিষয় নিয়ে মাসের পর মাস ধরে কেচো খোঁড়ার সময় নাই । কোনাে কিছু নিয়ে পাঁচ দিনের টেস্ট খেলব না। সময় নাই। সময় নাই। চাতক পাতক দল, চল চল চলহে। 

আমরা তারকাও বানাব টুয়েন্টি-টুয়েন্টি পদ্ধতিতে। একটা জীবন সাধনা করে নিজেকে পুড়িয়ে পৃথিবীর সবকিছু ত্যাগ করে শুধুই একটা বিষয়ে সিদ্ধি অর্জন! অত সময় কই। বানাও ইনস্ট্যান্ট ফর্মুলা । ছেড়ে দাও বাজারে কিছু তারকা। নে তােরা এখন করে খা। ফরিদা পারভীন দুঃখ পাচ্ছেন, সারা জীবন গান গেয়ে কীই বা পেলাম, গান না গাইতেই গাড়ি, লক্ষ লক্ষ টাকা…। যার দুঃখ তার কাছে থাকুক। আমরা এগিয়ে যাব টুয়েন্টি-টুয়েন্টি নিয়ে। উচ্চাঙ্গ সংগীত যারা গাইবেন, তাঁদের মনে এই দৃঢ়তা নিশ্চয়ই থাকবে যে ব্যান্ড তারকার মতাে জলুস তারা পাবেন না। 

খাও দাও ফুর্তি করাে । দুনিয়া দুই দিনের। যতক্ষণ ক্রিজে আছ, বীরের মতাে থাকো । যদি পেটাতে না পারাে, সরে দাঁড়াও। বীরভােগ্যা এই পৃথিবী। সেই দর্শনই 

যেন দেখতে পাই টুয়েন্টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে। 

কাজেই টুয়েন্টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ উড়ে এলেও যে জুড়েই বসবে, কোনাে সন্দেহ নাই। 

১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭

 

Read more

অনীশ-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *