রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-১৬)

ইচ্ছা করলেও উপায় নেইএত দূর থেকে সব কথা কি আর শােনা যায় ? আর শােনা গেলেও যে কথা বলছে তার মুখতাে দেখা যাচ্ছে নাযে কথা বলছে তার মুখ না দেখলে মনে হয় কথাটা বুঝি পুরােপুরি শােনা হল নাকিছু বােধহয় বাদ রয়ে গেল। 

রূপার পালঙ্কবৃদ্ধা বললেন, সরুফা মেয়েটারে কেমন দেখলি

মােবারক বলল, দেখলাম আর কোথায় ? ওতাে দরজার আড়ালে আড়ালে থাকেও হচ্ছে আড়াল-কন্যাহা হা হা। 

তুই এমন কথায় কথায় হাসতেছস ক্যান? তাের হইছেটা কী

মােবারক বলল, অনেকদিন পর তােমাকে দেখে মন ভাল হয়ে গেছেআমার অবস্থা হয়েছে তােমার শাশুড়ির মতকারণ ছাড়াইহিহিহাহা হােহাে। 

বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে মােবারকের বা হাত ধরলেনশক্ত করে ধরলেনশাস্তি দেবার আগে দুষ্ট ছেলেকে মা যেভাবে খপ করে ধরেন সেই ভঙ্গিতে ধরাছেলে হাজার চেষ্টা করেও ছুটে যেতে পারবে না। 

মােবারক শােনসরুফারে তুই বিবাহ কর। সরুফা খুবই দুঃখী মেয়ে আর তুইও খুব দুঃখী দুঃখে দুঃখে সুখআমার কোনাে কথাইতাে তুই রাখস 

এইটা রাখ মেয়েটা কত সুন্দর এইটা ভাল কইরা দেখছস ? 

সুন্দর তুমি কীভাবে দেখলে ? হাত বুলিয়ে। আমার হাত মাইনষের চউখের চেয়ে ভালচউখ আন্ধাইরে দেখতে পারে 

আমার হাত পারে। খালি রঙ টা বুঝে নাফর্সা না শ্যামলা টের পায় । 

প্র্যাকটিস করেল এইটাও হয়ত পারবে। প্র্যাকটিসে সব হয়। তুই আসল কথা ঘুরাইতেছস। মেয়েটারে বিবাহ করবি

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মােবারক তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধা গলা নামিয়ে বললেন, তাের নয়া শালটা। আমারে যেমনে প্যাচাইয়া ধইরা আছে— সরুফা সারাজীবন তােরে ঠিক এইরকম প্যাচাইয়া ধইরা রাখব। মেয়েটারে আমি কথা দিছি তাের সাথে বিবাহ দিব। 

কথাও দিয়ে ফেলছ ? 

হ কথা দিছি। কোনাে শান্তি তুই আমারে দেস নাই। মরণের আগে এই শান্তিটা দে। 

মােবারক উদাস গলায় বলল, আচ্ছা যাও কবুল। মেয়েটা নিতান্তই শিশু, যাই হােক তােমার কথা রক্ষাআমার দুই বন্ধু সঙ্গে থাকলে আজই যন্ত্রণা শেষ করে ফেলতাম। 

খবর দিয়া তারারে আন। 

মােবারক বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কথাতাে দিলাম আর কী ? মরদকা বাত, হাতীক দত। এখন হাতটা ছাড়, বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে 

আসি। 

সিগারেট আমার সামনেই খা। আমি তাে আর চউক্ষে দেখি না। কী খাস 

না খাস দেখব না। অসুবিধা কী? 

অসুবিধা আছে। 

মােবারক উঠানে এসে সিগারেট ধরাল। পরিষ্কার ঝক ঝক করছে উঠানএককোণায় আবার কয়েকটা গাদা ফুলের গাছ। হলুদ ফুলে গাছ ভর্তি হয়ে। আছে। নিশ্চয়ই সরুফা মেয়েটার কাণ্ড। ফুলের প্রতি মেয়েটার টান আছে। এটা ভাল। FRUITS AND FLOWERS এর মালিকের স্ত্রী যদি ফুল ভাল না। বাসে তাহলে হবে কীভাবে? তবে মেয়েটা বড়ই লাজুকলজ্জা দূর করতে। হবে। আড়াল কন্যা হলে চলবে না। আর বাচ্চা মেয়ে মাথায় ঘােমটা কেন ? ঘােমটা ফেলে বউ-মানুষরা। 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

সরুফা চায়ের কাপ নিয়ে আসছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে আসছে যেন একটা স্প্রিং দেয়া কাঠের মুর্তী। স্প্রিং এ চাবি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে— যন্ত্রের মত মূর্তি এগুচ্ছে। চাবি শেষ হবে মূর্তি থেমে যাবে। 

চা হাতে দিয়েই সরুফা চলে যেতে ধরেছিল— মােবারক বলল, খুকি 

দাড়াও। চা কেমন হয়েছে খেয়ে দেখি। পুরস্কার, তিরস্কার না মারস্কার। 

সরুফা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ নিজের পায়ের দিকে। মনে হচ্ছে সে অল্প অল্প কাঁপছে। মােবারকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে না-কি? আশ্চর্য তাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না, এই মেয়েটা ভয় পাবে কেন। 

মােবারক বলল, চা ভাল হয়েছে। খুবই ভাল। পুরস্কার টাইপ ভাল। 

মেয়েটা এই কথায় খুশি হয়েছে কিনা বােঝা যাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে বলে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। দু’একটা কথা মেয়েটার সঙ্গে বলতে ইচ্ছা করছেমজাদার কথা। মজাদার কথা সে ভালই জানে, তবে মেয়েরা কোন কথায় মজা পায় তা জানে না। বিল্লি মে কাট দিয়া’ গল্পটা কি করবে ? মজাদার গল্প হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার কথা। না-কি কোনাে ধাধা জিজ্ঞেস করবে।

ছােট মেয়েরা ধাধা পছন্দ করে। একে বলে শিল্পক ভাঙানি। শিলুক ভাঙানির ক্ষমতা থেকে বুদ্ধির আঁচও পাওয়া যায়। মােবারক কঠিন কোনাে ধাধা মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। ব্যাপারগুলি এ রকম যখন যেটা মনে পড়ার দরকার সেটা মনে পড়ে না। যখন প্রয়ােজন নেই তখন মনে পড়ে। 

সরুফা চলে যেতে ধরতেই মােবারক বলল, আচ্ছা দেখি তােমার বুদ্ধি কেমন। একটা শিল্পক দেই ভাঙ্গাও দেখি বল কোন ফুল মানুষ সব সময় নাকের কাছে রাখে কিন্তু কোনাে গন্ধ পায় না। চিন্তা ভাবনা করে বল। ফুলটা ছােট। নানান রঙের হয়কোনােটা শাদা, কোনােটা হলুদ, কোনােটা লাল। নাকের কাছে রাখলেও কোনাে গন্ধ নাই। 

সরুফা বিড়বিড় করে বলল, বলতে পারতেছি না। 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মেয়েটার মুখ কেমন হয়ে গেছে। উত্তর না দিতে পারার কষ্টে সে যেন মরে যাচ্ছে। 

মােবারকের মায়া লাগছে। শিল্পকটা কঠিন হয়ে গেছে। এমন কঠিন শিলুক মেয়েটার পারার কথা না। 

মােবারক বলল, এই ফুলটি হল নাক ফুল। তােমার নাকেওতাে এখন একটা আছে। বল এই ফুলের গন্ধ আছে ? 

জ্বি না। আচ্ছা এইটা বলদেখি 

ঘর আছে দরজা নাই। মানুষ আছে কথা নাই। 

সরুফা বলল, কর । 

হয়েছে। তােমারতাে ভাল বুদ্ধি । এখন যাও আরেক কাপ চা বানিয়ে আন। চিনি বেশি করে দেবে। আমি চিনি বেশি খাই। রান্না বান্নার জন্যে ব্যস্ত হয়াে না। আমার কাছে খাওয়া দাওয়াটা কোনাে বড় ব্যাপার না। খুব যদি ক্ষিধা লাগে তাহলে নিজের একটা পা ছিড়ে খেয়ে ফেলব। 

সরুফা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। 

মােবারক বলল, মাকড়সা কী করে জান ? মাকড়সার যখন খুব ক্ষিধে লাগে তখন সে নিজের পা ছিড়ে খেয়ে ফেলেতাতে কোনাে অসুবিধা হয় । টিকটিকির খসে পড়া লেজ যেমন গজায়, মাকড়সারও তেমন পা গজায়। 

এইসব কী কন ? সত্যি কথা বলছি। সবই বিজ্ঞানের কথা। আমার বিশ্বাস হইতেছে না। 

বিশ্বাস না হবারই কথা। চোখের সামনে কত মাকড়সা ঘুরঘুর করেকিন্তু আমরা কি জানি এরা ক্ষিধার সময় নিজের পা ছিড়ে খায়এই জাতীয় 

আরাে অদ্ভুত অনেক কথা আছেতােমাকে ধীরে স্ত্রীরে বলব ।সরুফা দাড়িয়ে আছে, যাচ্ছে নাবেচারীর বােধহয় এ রকম গল্প আরাে শুনতে ইচ্ছা করছেমােবারক দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক জানেদড়ি কেটে জোড়া দিয়ে দেয়াফুটপাতে দন্তরােগ-যম মাজন বিক্রি করে এক লােক নানান রকম ম্যাজিক দেখায়। তার মধ্যে সবচে’ বিস্ময়কর ম্যাজিকটা হল দড়ি কেটে জোড়া দেয়া। মােবারক এই ম্যাজিক দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে ম্যাজিসিয়ানকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ম্যাজিকের কৌশল শিখে নিয়েছিল

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

ম্যাজিকটা ভাল হলেও কৌশলটা খুবই সহজ। মুল দড়ি কাটা হয় না। দুই ইঞ্চি লম্বা ছােট্ট একটা দড়ির টুকরা কাটা হয়। সেই টুকরাটা লুকানাে থাকে হাতের তালুতে। দড়ির ম্যাজিকটা সরুফাকে দেখানাে যেতে পারেগ্রামেমেয়ে ভাল জিনিসতাে কিছুই দেখে না। খুশি হবেমেয়েটাকে সঙ্গে করে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারলে হত। বরফ টরফ দেখে খুশি হত। অন্যের খুশি দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে ।

মােবারক দড়ির খুঁজে দাদিজানের ঘরে ঢুকল। যে-কোনাে জিনিস দাদিজানের খাটে থাকবেই। তাঁর রেলিং দেয়া খাট ভর্তি নানা ধরনের, নানান সাইজের টিন, বাক্স, পেটরা। কোনােটায় চিড়া, কোনােটায় মুড়ি। কোনােটায় আমসত্বএই মহিলার সব কিছু হাতের কাছে থাকা চাই। 

দাদিজান তােমার কাছে দড়ি আছে । চিকন দড়ি ? 

আছেকী করবি? কাজ আছে— দড়ি দাওতাে। 

তুই ব’ আমার কাছে। তাের শইল্যের গন্ধ বিক্ষরণ হইছিলাম। অখন গন্ধ পাইতেছি। 

গন্ধটা কেমন ? ভাল গন্ধ। তুই থাকবি কয় দিন ? কয়দিন মানে ? দুপুরে ভাত খেয়েই রওনা। কস কী তুই ? 

(চলবে)

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-১৫)

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *