রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৬)

টাকা কই পেয়েছিস? জহির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইলমােবারক আবার বলল, টাকা কোথায় পেয়েছিস ? জহির কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে আরেকটা সিগারেট ধরাল। 

রূপার পালঙ্ককেউ কোনাে কথা বলতে না চাইলে সেই কথা শােনার জন্যে চাপাচাপি করা ঠিক না। মােবারক চুপ করে গেল। বলার হলে সে নিজেই বলবে। পেটে জিনিস পড়লেই হড়বড় করে কথা বের হবে। জিনিস পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটাই হল কথা।

বজলুর এখনাে দেখা নাইবজলু থাকে তার ছােট বােনের সঙ্গে ঝিকাতলায়। ঠিকানা আছে। কিন্তু বজলুর কঠিন নিষেধ যেন তার খোঁজে কখনাে যাওয়া না হয়নিষেধ হােক যাই হােক একবার যাওয়া দরকার। মানুষটার অসুখ বিসুখও তাে হতে পারে। বন্ধু যদি বন্ধুর খোজ না করে কে করবে? পাড়ার লােকে করবে? 

তাের তাে দেখি শরীর একেবারে গেছে। 

গেলে কী আর করা? শরীর দিয়ে কী হয়? এত বড় যে গামা পালােয়ান শরীর দিয়ে সে করলটা কী ? 

তাের জিহ্বা কালাে হয়ে গেছে। তাের মধ্যে একটা সাপ সাপ ভাব চলে এসেছে। 

জহির হঠাৎ বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দোস্ত মনটা খারাপ, খুবই খারাপ। 

কী জন্যে মন খারাপ বলে ফেল। শুনলে তােরও মন খারাপ হবেতাহলে বাদ দে। 

জহির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, ছােটখালা এক হাজার টাকা দিয়েছিল। তার কাছে তাে ছিল না। ধারধাের করে এনে দিয়েছে। চা খাওয়ার নাম করে ঐ টাকা নিয়ে ফুটে গেছি।। 

জিনিসপত্র ঐ টাকায় কিনেছিস?  ‘। দোস্ত খুবই খারাপ লাগছে। একবার ভাবলাম লাফ দিয়ে কোনাে ট্রাকের নিচে পড়ে যাই। 

পড়লি না কেন?

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

 ট্রাকের সামনে ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই নাছাদে উঠে ঝাপ দিয়ে নিচে পড়তে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। সাহস নাইরে দোস্ত, সাহস নাই । এই দুনিয়ায় আসল জিনিসের নাম সাহস। যার সাহস আছে তার সবই আছে। যার সাহস নাই তার কিছুই নাই। 

ক্যাশ বক্স ফেলে কুদ্স উঠে এসে মােবারকের পাশে বসল। গলা নামিয়ে বলল, গায়ের শাল কি বিক্রি হবে। 

মােবারক উদাস গলায় বলল, দামে পুষলে বিক্রি। কুদুস শাল পরীক্ষা করতে করতে বলল, সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যবহারী জিনিস। 

তিনশ টাকা। যদি পুষায় জিনিস রেখে যাও, কাল দাম নিবা।। 

পুষাল না। না পুষালে নাই। আমারটা আমি বললাম। তিনশভাল বলেছ। এখন ফুটে যাও। 

কুদুস যেভাবে এসেছিল সেইভাবে চলে গেল। হাসিমুখে বসল ক্যাশবাক্সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা বড়ই আনন্দময়। 

তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে। 

সােহরাওয়ার্দি উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়ির একটু পেছনে ঝাকড়া বাদাম গাছের নিচটাই তাদের জায়গা। একদিকে শিশু পার্ক, একদিকে পুলিশ ফাঁড়ি, বাকি দুদিকে ঘন ঘাছপালা বাগানের এই অংশটা ঠিক বাগান বলে মনে হয় 

মনে হয় জংলা জায়গা। ছাতিম গাছটাকেও জংলা গাছের মতই লাগে। গাছটা নিচু, দাঁড়ালে ছাদের মত ছড়ানাে ডালে মাথা লেগে যাবেকিন্তু বসতে কোনাে অসুবিধা নেইগাছটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মাথার উপর প্রকাণ্ড ছাতা ধরে আছে এমন মনে হয়। শুধু মনে হওয়া-হওয়ি না। গাছটা আসলেই ছাতার কাজ করে । একবার তারা গাছের নিচে বসে আছে— নামলাে ঝুম বৃষ্টিএকটা ফোটা পানি তাদের গায়ে পড়ল না । 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

মােবারকদের পছন্দের জায়গার আরাে কিছু বিশেষত্ব আছে। প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে সন্ধ্যার পর থেকে নানান ধরনের লােকজন এবং মেয়ে মানুষ ঘােরাফেরা করে কিন্তু এই দিকে কেউ আসে না। জায়গাটা ভাল না; গরম— এমন কথা প্রচলিত আছে। মাস দু’এক আগে আঠারাে উনিশ বছরের একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছেতারও আগে বর্ষার সময় মাথা নেই একটা পুরুষের শরীর পাওয়া গেছেশরীরটা বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করে এই ছাতিম গাছের নিচেই ফেলে রাখা হয়েছিল। 

মৃতদেহ পচে গলে বিকট গন্ধ ছড়ানাে শুরু করার পর পুলিশ এসে বস্তা নিয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। 

মুণ্ডহীন লাশ শিরােনামে কয়েকটা প্রতিবেদন ছাপা হবার পর পাঠক এবং পত্রিকা দুইই ক্লান্ত হবার কারণে ব্যাপারটা থেমে যায়। তবে সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে চা এবং চায়ের সঙ্গে অন্যসব বস্তু যারা বিক্রি শুরু করে তারা জমাটি এক ভূতের গল্প চালু করে দেয়। নিশুতি রাতে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ নাকি মাথা নেই একটা মানুষ দেখা যায়। মানুষটা বাগানের লােকদের কাছে তার মাথাটা কোথায় তা জানতে চায়।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। প্রেমিকা বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে, প্রেমিক দিচ্ছে না। অন্ধকারে প্রেমিকাকে যতক্ষণ পাশে রাখা যায়। দুজনেরই ঝিম ঝিম অবস্থা। তখন মাথা নেই লাশ গাছের আড়াল থেকে শরীরটা বের করে বলবে, এক্সকিউজ মি আপা। আমার মাথাটা কোথায় বলতে পারেন? 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

এই ধরনের গল্প কেউ বিশ্বাস করে না, তবে পুরােপুরি অবিশ্বাসও করে। । মানুষের মনের একটা অংশ উদ্ভট এবং বিচিত্র গল্প বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। 

রাত দশটা। মােবারক, জহির এবং বজলু তিনজনই আছে। বজলু যথারীতি গম্ভীর হয়ে আছে, কথা বলছে না। ছাতিম গাছের নিচে বসার সময় একবার শুধু বলেছে, আমার কাজ আছে। আমি দশ পনেরাে মিনিট থাকব। 

জহির বলেছে, থাকিস না। তােকে কি আমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি । যার যার শিকল তার তার হাতে। তুই তাের শিকল বাজাতে বাজাতে চলে যা। 

বজলু বলেছে, আজ কিছু খাবও না। তােরা খাওয়ার জন্যে পাছরা পাছরি করিস না । 

জহির বিরক্ত হয়ে বলেছে, তুই কি কচি খােকা যে ফিডিং বােতলে করে তােকে মদ খাওয়াতে হবে। না খেলে না খাবি। চলে যেতে চাইলে চলে যাএখনি চলে যা। 

বজলু বলেছে, চলে যাব। জহির বলেছে, অবশ্যই চলে যাবি। তাের মত বন্ধু আমি ‘…‘ দিয়েও পুছি । 

বজলু সঙ্গে সঙ্গে উঠে হাঁটা দিয়েছে। জহির বা মােবারক এটা নিয়ে মােটেও ব্যস্ত হয়নি। কারণ দুজনই জানে বজলু ফিরে আসবে। কতক্ষণে 

ফিরবে এটা বলা যাচ্ছে না। পাঁচ মিনিটেও ফিরতে পারে আবার ঘণ্টা দুই পরেও ফিরতে পারে। তবে কিছুদিন হল বজলু বদলাচ্ছে। অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাকে কয়েকদিন না-কি ছােট রফিকের সঙ্গে দেখা গেছেতার বন্ধুরা বজলুকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে আজ হয়ত মােবারক জিজ্ঞেস করবে। রাগ করে বজলুর চলে যাওয়া বা ফিরে আসা কোনাে ঘটনা 

তবে এ রকম ঘটনা ঘটলে খুবই রাগ লাগে। নেশার জন্যে রাগটা খারাপ। যে রেগে থাকে তাকে কোনাে কিছুতেই ধরে না। নেশার খরচ জলে যায়। 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

জহির কাঁধের ব্যাগ থেকে বােতল বের করল । জমাটি নেশা করার কিছু নিয়ম কানুন আছে। নেশার সব কিছু চোখের সামনে রাখতে হয়ভাগ্য ভাল থাকলে সুন্দর করে সাজানাে বােতল দেখলেই নেশা হয়ে যায়। নেশা তাে আর কিছু নামনের একটা বিশেষ ভাব। সেই বিশেষ ভাবে হুট করে ঠা যায়। 

একতলা থেকে দোতলায় উঠতে হলে যেমন অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে হয়এক ভাব থেকে আরেক ভাবে যেতেও সিড়ি টপকাতে হয়। কেউ দুটা তিনটা সিঁড়ি এক সঙ্গে টপকায়। কেউ সিঁড়ি টপকানাের সময় পা পিছলে পড়ে যায়, উপরের তলায় উঠতেই পারে না। আসল ভাবের জায়গায় যারা উঠবে তারা প্রতিটি সিঁড়ি আস্তে আস্তে পার হবে। কারণ প্রতিটি সিঁড়ির কিছু আলাদা মজা আছে। আলাদা ভাব আছে। 

জহির বলল, পুড়িয়াও আছে। দিব ? মােবারক বলল, এখন না। | আয় ডাইল দিয়ে শুরু করি। বজলু ফিরে আসুক তখন পুড়িয়া ডাইরেক্ট একশন। 

মােবারক জবাব দিল না। তার মানে ডাইল দিয়ে শুরুর ব্যাপারে তার আপত্তি নেইডাইল হল ফেন্সিডিলইদানীং চালু হয়েছে ফেন্সিডিলের বােতলে একটা দশ মিলিগ্রাম ইউনিকট্রিন ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়াট্যাবলেটটা পুরােপুরি গুলে না। আধাগলা হয়ে তলায় পড়ে থাকে। সেই পড়ে থাকা অংশটা খাওয়ার নিয়ম নেই। 

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ

ভাবে বসার প্রথম পনেরাে মিনিট বেশ জটিল। একেক জন একেক মুড়ে থাকে। কেউ কোনাে কারণ ছাড়াই হঠাৎ বিরক্ত হয়ে যায়। কেউ রাগ করে। কেউ ধুম করে বলে বসে, না আজ শরীর ভাল না । আজ কিছু খাব না। তখন একজনকে থাকতে হয় যে সবাইকে সামলে সুমলে রাখে। সে হল সামালদার। তাকে মেজাজ খারাপ করলে চলবে না। ভাবের আসর নষ্ট হয়ে 

যাবে। প্রথম দশ পনেরাে মিনিট কষ্ট করে পার করে দিলে বাকি সময়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। প্রথম পনেরাে মিনিটের ধাক্কাটা সব সময় সামলায় জহিরকোনাে বিষয়ে তার ধৈর্য নেই কিন্তু ভাবের আসরে তার ধৈর্য অসীম। 

জহির ফেন্সিডিলের একটা বােতলের মুখ খুলে মােবারকের দিকে এগিয়ে দিল মােবারক হাত বাড়াল না। বরং ছাতিম গাছে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে 

গেল জহির চিন্তিত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না

মােবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। 

ঘটনা খারাপ। শুরুতেই কেউ বেঁকে বসলে সমস্যা। জহির শান্ত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা না করলে খাস না। রােজই এই বিষ খাওয়া লাগবে তার কোনাে কথা নেইইচ্ছা না হলে খাবি না। 

জহির নিজেই বােতলে চুমুক দিল । গলা করুণ করে বলল, অনেক কষ্টের টাকায় এই বিষ কিনেছি। একজন রাগ করে চলে যাবেএকজন খাবে না। ভাল কথা। আমি খাব। আমার হল কষ্টের টাকা। আমি ছাগল কোরবানি দিয়েছি। আমি না খেলে হবে ? 

( চলবে )

রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৫)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *