শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

‘কিসের গল্প, ভূতের? নিনু বলল, ‘না, আমি ভয় পাচ্ছি, হাসির গল্প বলেন। বাবা বললেন, ‘রাবেয়া, তুই একটা হাসির গল্প বল। শঙ্খনীল কারাগার

রাবেয়ার হাসির গল্পটা তেমন জমল না। বাবা অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। 

রুনু বলল, ‘মনে পড়ে আপা, মা এক দিন এক কানা সাহেবের গল্প বলেছিল? সেদিনও এমন ঝড়-বৃষ্টি। 

‘কোন গল্পটার কথা বলছিস? 

ঐ যে, সাহেব বাজারে গেছে গুড় কিনতে। ‘মনে নেই তাে গল্পটা, বল তাে! 

রুনু চোখ বড়াে বড়াে করে গল্প বলে চলল। রুনুটা অবিকল মায়ের চেহারা পেয়েছে। এই বয়সে হয়তাে মা দেখতে এমনিই ছিলেন। কেমন অবাক লাগে–একদিন মা যে-গল্প করে গেছেন, সেই গল্পই তাঁর এক মেয়ে করছে। 

পরিবেশ বদল হয় নি একটুও, সেদিন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল, আজও হচ্ছে। 

গল্প শেষ হতেই বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। টানা গলায় বললেন, ‘শুয়ে পড় সবাই। 

 শুয়ে শুয়ে আমার কেবলই মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল, বেশ কিছুদিন আগেও এক দিন এরকম মনে পড়েছিল। সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ দেখি বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। দেখামাত্র ধক কর উঠল বুকের ভেতর। অবিকল মায়ের মতাে চেহারা। তেমনি দাঁড়াবার ভঙ্গি, বিরক্তিতে কুঁচকে নিচের ঠোট কামড়ে ধরা। আমি এত বেশি বিচলিত হলাম যে, ক্লাসে কী বলছি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ক্লাস শেষ হলেই মেয়েটি সঙ্গে আলাপ করব, এই ভেবে প্রাণপণে ক্লাসে মন দিতে চেষ্টা করলাম। ক্লাস একসময় শেষ হল, মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম না। সেদিনও সমস্তক্ষণ মায়ের কথা ভেবেছিলাম। সে-রাতে অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখলাম মাকে। মা ছােট্ট খুকি হয়ে গেছেন। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘরময়। আমি বলছি, মা আপনি এত হৈচৈ করবেন না, আমি ঘুমুচ্ছি।’ 

মা বললেন, ‘বারে, আমি বুঝি এক্কা-দোক্কাও খেলব না? | খেলুন, তবে শব্দ করে নয়।’ 

‘তুই খেলবি আমার সঙ্গে খােকা? ‘না, আমি কত বড়াে হয়েছি দেখছেন না? আমার বুঝি এসব খেলতে আছে? 

খুব অবাক হয়েছিলাম স্বপ্নটা দেখে। এমন অবাস্তব স্বপ্নও দেখে মানুষ! 

মায়ের চারদিকের রহস্যের মতাে স্বপ্নটাও ছিল রহস্যময়। চারদিকে রহস্যের আবরণ তুলে তিনি আ৩াবন আমাদের চেয়ে আলাদা হয়ে ছিলেন। শুধু কি তিনিই ?  

তাঁর পরিবারের অন্য মানুষগুলিও ছিল ভিন্ন জগতের মানুষ, অন্তত আমাদের মাঝে-মাঝে বড় মামা আসতেন বাসায়। বাবা তটস্থ হয়ে থাকতেন। সারাক্ষণ। দৌড়ে মিষ্টি আনতে যেতেন। রাবেয়া গলদঘর্ম হয়ে চা করত, নিমকি ভাজত। বড় মামা সিকি কাপ চা আর আধখানা নিমকি খেতেন। যতক্ষণ থাকতেন, অনবরত পা নাচাতেন আর সিগারেট ফুকতেন। আমাদের দিকে কখনাে মুখ তুলে। তাকিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। বাবা অবশ্যি এক এক করে আমাদের নিয়ে যেতেন। তাঁর সামনে। আমরা নিজেদের নাম বলে জড়ােসড়াে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মামা ভীষণ অবাক হয়ে বলতেন, ‘এরা সবাই শিরিনের ছেলেমেয়ে? কী আশ্চর্য!’ আশ্চর্যটা যে কী কারণে, তা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম। মামা রুমাল দিয়ে ঠোট মুছতে মুছতে বলতেন, ‘বুঝলেন আজহার সাহেব, শিরিন ছােটবেলায় মােটেই ছেলেমেয়ে দেখতে পারত না। আর তারই কিনা এতগুলি ছেলেমেয়ে! 

‘এই যে, এইটিই কি বড়াে ছেলে? মামা আঙুল ধরে রাখতেন আমার দিকে। আমি ঘাড় নাড়তাম। মামা বলতেন, কী পড়া হয়? ‘নাইনে পড়ি।। 

বাবা অতিরিক্ত রকমের খুশি হয়ে বলতেন, ‘খােকা এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। স্কুল থেকে একটা মেডেল দিয়েছে। গােল্ড মেডেল। রাবেয়া, যাও তাে মা, মেডেলটা তােমার মামাকে দেখাও। ছােট ট্রাঙ্কে আছে।’ 

ব্লেডের মতাে পাতলা মেডেলটা মামা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতেন। আবেগশূন্য গলায় বলতেন, শিরিনের মতাে মেধাবী হয়েছে ছেলে। শিরিন মেট্রিকুলেশনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল।’ 

বলতে বলতে মামা গম্ভীর হয়ে যান। অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলেন, ‘আমাদের পরিবারটাই ছিল অন্য ধরনের। হাসিখুশি পরিবার। বাড়ির নাম ছিল ‘কারা কানন। দেয়ালের আড়ালে ফুলের বাগান। শিরিন নিজেই দিয়েছিল নাম।’ 

মা আসতেন আরাে কিছু পরে। খুব কম সময় থাকতেন। আমরা বেরিয়ে আসতাম সবাই। একসময় দেখতাম মুখ কালাে করে মামা উঠে যেতেন। মা শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন সারা দুপুর। আমরা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুই ভালাে। লাগত না। সেই অল্পবয়সেই মাকে কি গভীর ভালােই না বেসেছিলাম! অথচ তিনি ছিলেন খুবই নিরাসক্ত ধরনের। কথাবার্তা বলতেন কম। নিঃশব্দে হাঁটতেন। নিচু গলায় কথা বলতেন। মাঝে মাঝে মনে হত, বড় রকমের হতাশায় ডুবে গেছেন। তখন সময় কাটাতেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। প্রয়ােজনের কথাটিও বলতেন না। ঘরের কাজ রাবেয়া আর একটা ঠিকে ঝি মিলে করত। বিষন্নতায় ডুবে যেত সারা বাড়ি। 

বাবা অফিস থেকে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন বারান্দায়। রাবেয়া চা এনে দিত। বাবা ফিসফিস করে বলতেন, ‘তাের মাকে দিয়েছিস? 

‘না, মা খাবে না। ‘আহা, দিয়েই দেখ না।’ ‘ভাতই খায় নি দুপুরে। 

রুনু-ঝুনু সকাল সকাল বই নিয়ে বসত। গলার সমস্ত জোর দিয়ে পড়ত দু’ জনে। বাবা কিছুক্ষণ বসতেন তাদের কাছে, আবার যেতেন রান্নাঘরে রাবেয়ার কাছে। কিছুক্ষণ পরই আবার উঠে আসতেন আমার কাছে। ইতস্তত করে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার উথাপন করতেন, ‘খােকা, তােদর কলেজে মেয়ে-প্রফেসর আছে? 

‘আছে।’ ‘বিয়ে হয়েছে নাকি? 

হয়েছে কারাে কারাে।’ ‘সবগুলির নিশ্চয়ই হয় নি। কলেজের মেয়ে-প্রফেসরদের বিয়ে হয় না। 

কিংবা হয়তাে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোের কোনাে দিন রাতের বেলা পানির পিপাসা পায়? 

পায় মাঝে মাঝে। “কী করিস তখন?”. ‘পানি খাই। আর কী করব? 

খালি পেটে পানি খেতে নেই, এর পর থেকে বিস্কুট এনে রাখবি। আধখান খেয়ে এক ঢােক পানি খাবি, বুঝলি তাে? 

‘বুঝেছি।’ 

কথা বলার জন্যেই কথা বলা। মাঝে মাঝে মার উপর বিরক্ত লাগত। কেন, আমরা কী দোষ করেছি? এমন করবেন কেন আমাদের সাথে? 

অবশ্যি বিপরীত ব্যাপারও হয়! অদ্ভুত প্রসন্নতায় মা ভরে ওঠেন। বেছে বেছে। শাড়ি পরেন। লম্বা বেণী করে চুল বাঁধেন। মন্টু অবাক হয়ে বলে, ‘মা, তােমাকে অন্য বাড়ির মেয়ের মতাে লাগছে।’ 

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বললি মন্টু?’ 

বললাম, তােমাকে অন্যরকম লাগছে। তুমি যেন বেড়াতে এসেছ আমাদের বাড়ি।’ 

রুনু বলে ওঠে, ‘মন্টুটা বড়াে বােকা, তাই না মা?’ 

মা হেসে হেসে রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করেন, ও রাবেয়া, তাের গান ভালাে লাগে? ‘হ্যাঁ মা, খুউব।” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *