শাস্তি-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শাস্তি-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। এমন নয় যে, ফাঁকা মাঠের মধ্যে বাড়ি। এখন কোথাও আর ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকে না। চতুর্দিকে আগাছার মতন বাড়ি গজিয়ে উঠছে। তবে, এ-বাড়িটার সামনে একটা বেশ বড়, ছড়ানো তিনতলা বাড়ি। তাই ছোট দোতলা বাড়িটা আড়াল পড়ে গেছে, বড় রাস্তা থেকে দেখা যায় না। ডানপাশে কীসের যেন একটা কারখানা।

শিশির একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে ভালো করে দেখল। মফস্বলের একটা অতি সাধারণ বাড়ি। দেওয়ালের রং চটা। সামনে বাগান-টাগান কিছু নেই। ওপর থেকে অনেকগুলো বাচ্চার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, মনে হয় যেন একটা ইস্কুল। এ পাড়ার লোকজন বোধহয় সেরকমই কিছু ভাবে।

বিলু নামের লোকটি চঞ্চল হয়ে বলল, স্যার, এবার আমি যাই। আমাকে দেখলে ওরা মারার চেষ্টা করবে।

শিশির গম্ভীরভাবে বলল, না, তুমি জিপে গিয়ে বসো। তুমি এখন যাবে না।

বিলু তবু বলল, ওরা আমায় চিনে ফেলবে। পরে আমাকে…

শিশির ধমক দিল, চুপ করে বসে থাকো!

জিপ গাড়ি থেকে নেমে এল পাঁচজন কনস্টেবল আর এস আই মহীতোষ। এখনও ভালো করে ভোর হয়নি, সবেমাত্র আকাশের অন্ধকার ভাঙছে। ডাকাডাকি শুরু করেছে কিছু পাখি। অধিকাংশ মানুষই এইসময় ঘুমোয়। দোতলায় কয়েকটা বাচ্চা কাঁদছে, কয়েকটা এমনিই চ্যাঁচাচ্ছে।

বেল্টের খাপ থেকে রিভলভারটা খুলে হাতলের দিকটা দিয়ে সদর দরজায় খুব জোরে ঠকঠক করল শিশির। মহীতোষ কনস্টেবলদের বাড়িটা ঘিরে রাখতে নির্দেশ দিচ্ছে। বেশ কয়েকবার ঠকঠক করলেও দরজা খুলল না। শিশির তখন চেঁচিয়ে ডাকল, ইসমাইল! ইসমাইল!

এবার একজন দরজা খুলল। ঘুম-ঘুম চোখ। শিশিরকে ভালো করে না দেখেই বিরক্তভাবে বলল, ইসমাইলকে কী দরকার? সে এখন উঠবে না।

শিশির খপ করে লোকটির চুল মুঠোয় ধরে জিগ্যেস করল, তুই কে?

লোকটি এবার স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার ঘুমের মধ্যে কোনও বিপদের স্বপ্ন ছিল না। সাধারণ মানুষের মতন সে জেগে উঠেছিল।

রিভলভারের নলটা তার গালে চেপে ধরে শিশির আবার বলল, বল, তুই কে? লোকটি এবার কাঁপতে কাঁপতে বলল, স্যার, আমার নাম লালু। আমি কিছু জানি না। আমি এ বাড়ির চাকর।

একটা চেক লুঙ্গি পরা, খালি গা, রোগা চেহারা, মাথায় খোঁচা-খোঁচা চুল। মুদিখানার কর্মচারী হলেই যেন তাকে মানায়।

মাথার চুল ছেড়ে দিয়ে শিশির অকারণেই ঠাস করে তাকে বেশ জোরে একটা চড় কষাল। তারপর বলল, লালু, মানে লালমনি দাস। তুই আগে ছিলি পকেটমার, এখন ভালো কাজ পেয়েছিস, তাই না?

মহীতোষ তার কোমর চাপড়ে দেখল, কোনও অস্ত্র লুকোনো আছে কি না। কিছু নেই।

শিশিরি বলল, এবার দেখিয়ে দে, ইসমাইল কোথায়।

একতলার একটা ঘরেই পাওয়া গেল আর দুজনকে। ইসমাইল আর জিয়াউদ্দিন। ওদের অবস্থা দেখেই বোঝা গেল, কেন চ্যাঁচামেচি শুনেও ওরা জাগেনি। ঘরের মধ্যে গড়াচ্ছে তিনটে বাংলা। মদের বোতল। ছড়িয়ে আছে প্রচুর শালপাতা, তাতে মাংসের ঝোল, শুকনো ভাত আর মাংসের চিবুনো হাড়। অনেক রাত পর্যন্ত খানাপিনা হয়েছে। পিঠে বুকে অনেকগুলো লাথি খেয়েও ইসমাইল আর জিয়াউদ্দিন লাল-লাল চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ওদের এখনও এমন নেশা যে, ঠিক কী যে ঘটছে তা বোধগম্য হচ্ছে না।

ইনফরমার বিলু ঠিক খবরই দিয়েছিল। এ সময় তিনজনের বেশি পুরুষ মানুষ থাকবে না। এরা বন্দুক-পিস্তলের কারবার করে না। কোনও প্রতিরোধের চেষ্টাও করল না।

ইসমাইলের নাকে আর একটা লাথি কষিয়ে শিশির বলল, ওঠ, হারামজাদা, পাসপোর্ট দেখা।

এবার ইসমাইল উঠে বসল, আলনার ওপর রাখা একটা স্যুটকেস খুলে পাসপোর্ট বার করে যন্ত্রচালিতের মতন এগিয়ে দিলো শিশিরের দিকে।

শিশির বলল, হু, ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট। সবসময় সঙ্গে রাখিস দেখছি।

ইসমাইল জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, কেয়া হুয়া? তুম লোগ কৌন?

শিশির বলল, আমি তোদের যম!

বুঝতে না পেরে হেসে উঠতেই একটা থাপ্পড় খেল জিয়াউদ্দিন।

লালমনিকেও সে-ঘরে রেখে, বাইরে থেকে হুড়কো দিয়ে দিল মহীতোষ। জানলা দিয়ে পালাতে পারবে না। এদের ব্যবস্থা পরে হবে।

দোতলাতে দুখানা ঘর। একটি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মাঝবয়েসি স্ত্রীলোক। বেশ আঁটসাঁট চেহারা, গোলাপি রঙের ছাপা শাড়ি পরা। চুল খোলা, চুলের বেশ গোছগাছ। এই স্ত্রীলোকটি আগেই জেগে উঠেছে। নীচের তলায় কী ঘটে গেছে এর মধ্যে, তা জানে। মুখে আশঙ্কার ছায়া।

শিশির এই স্ত্রীলোকটির দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। কোনও কথা বলল না। যে ঘরটি থেকে বাচ্চাদের চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, সেই ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলল শিশির। ঘরটাকে দেখলে মনে হয়, ঠিক যেন পাখির খাঁচা। লম্বাটে ঘর, তাতে শুধু শতরঞ্চি পাতা। চাদর, বালিশকিছু নেই। সেখানে শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো বাচ্চা ছেলে। শিশির গুনে দেখল, তেইশটি। তিন-চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বয়েস। শুধুইজের পরে, খালি গা। ঘরটার সব জানলা বন্ধ। শুধু ওপরে একটা স্কাইলাইট দিয়ে যেটুকু আলো ও হাওয়া আসে। মহীতোষের মতো একজন পোড় খাওয়া পুলিশও কাতরভাবে বলে উঠল, ইস! চোখে দেখা যায় না।

শিশির পাথরের মতন স্থির।

ওদের দেখে সাত আটটা বাচ্চা একসঙ্গে কেঁদে উঠল।

জঙ্গলে ছুটবার মতন বাচ্চাগুলোর মধ্য দিয়ে কোনওক্রমে পা ফেলে-ফেলে দৌড়ে গিয়ে মহীতোষ দুটো জানলা খুলে দিল।

একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘোর ভাঙল শিশিরের। তারপর বলল, তুমি এক কাজ করো। নীচের তিনটে হারামজাদাকে বেঁধে থানায় নিয়ে যাও। দুজন কনস্টেবল এখানে থাক। তুমি একটা বড় ভ্যান। জোগাড় করে আনো। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যেতে হবে তো। আমি এখানে থাকছি।

মহীতোষ বলল, আমাদের ভ্যানটা তো খারাপ। লালবাজারে ফোন করব?

শিশির বলল, যা হোক একটা কিছু করো। লালবাজার ধরতে না পারলে একটা ভ্যান ভাড়া করে। আনো।

মহীতোষ নেমে যেতেই শিশির সিঁড়ির কাছে সরে এসে স্ত্রীলোকটিকে জিগ্যেস করল, তুমিই তো মক্ষীরাণী! তোমার নাম কী?

স্ত্রীলোকটির তেজ আছে। ভয়ের ভাব না দেখিয়ে বলল, আমার নাম দিয়ে কী হবে? আমি মাইনে করা লোক। বাচ্চাগুলোর দেখাশুনো করার জন্য আমাকে এনেছে। সাতদিনের কড়ারে। আমি আর কিছু জানি না।

তুমি আর কিছু জানোনা?

না।

আর কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েছ? রেকর্ড আছে?

না, পুলিশ আমায় ধরবে কেন! আমি কোনও দোষ করেছি নাকি? এরা মাইনে দেবে, আমি কাজ করছি।

সাতদিনের জন্য কত মাইনে দেবে?

সাতশো টাকা।

হুঁ। সাতদিন পরে তুমি আবার কী কাজ করবে?

বাড়ি ফিরে যাব।

তোমার বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে সে কথা জেনে তো আপনার কোনও কাজ নেই বাবু। আমি আর কিছু জানি না।

হুঁ, ঠিক আছে। এই বাচ্চাগুলোকে খাবার দাও কখন?

এখনই দিতে পারি।

নিয়ে এসো।

স্ত্রীলোকটি নিজের ঘরে ঢুকে একটা ঝুড়ি নিয়ে এল। তাতে অনেকগুলো কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটি। আগের দিনের, শুকনো।

জন্তুজানোয়াদের খাবার দেওয়ার মতনই বাচ্চাগুলোর মাঝখানে ঝুড়িটা সে বসিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অনেকগুলো বাচ্চা।

স্ত্রীলোকটি দরজাটা টেনে দিল বাইরে থেকে। শিশির এর মধ্যে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। সে জিগ্যেস করল, শুধু পাউরুটি? আর কিছু নয়?

বেলা হলে দুধ গুলে দিই। দুপুরে ভাত খায়।

তেইশটা বাচ্চাই এসেছিল, না দু-একটা মরেছে এর মধ্যে?

না-না, মরবে কেন?

হুঁ, ওদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। প্রত্যেকটার দাম আছে তো? তোমার নিজের ছেলেপুলে আছে?

সেসব জেনে আপনার কী দরকার বাবু?

হ্যাঁ, আছে।

কটা?

তিনজন।

কত বয়েস?

তিন, সাত আর দশ।

তুমি যখন থাকো না, তখন তাদের কে দেখাশুনো করে?

আছে, লোক আছে।

নিজের ছেলেমেয়েদের রেখে তুমি বাইরে কাজ করতে আস…

কী করব বাবু পেট চালাতে হবে তো। আমার কত্তার রোজগার নেই…

ঠিক আছে। তোমার ঘরে চলো।

ঘরে যাবে কেন? যা বলবার এখানেই বলুন না। হঠাৎ অসম্ভব হিংস্র মুখ করে শিশির বলল, হারামজাদী, তোকে এক্ষুনি আমি গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে পারি। রিপোর্ট দেব যে, তুই দা দিয়ে আমাকে মারতে এসেছিলি। তুই একটা ডাইনি, রাক্ষুসী। সব্বাই বিশ্বাস করবে।

সেই দাপটের চোটে একবার কেঁপে উঠল স্ত্রীলোকটি। তবু শান্ত গলায় বলল, আপনি পুলিশ, হাতে অস্তর আছে, মারতে যদি চান তাহলে আমি মেয়ে মানুষ হয়ে আর কী করব! মারতে হয় মারুন!

একবার সে অন্য ঘরটিতে ঢুকে গেল। সে ঘরে কোনও চেয়ার-টেবিল নেই। শুধু একটা খাট। একটা দেওয়াল আলমারি। এক কোণে তিনটে স্যুটকেস। শিশির দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল ঘরটায়। সবকিছুই সিজ করতে হবে। খাটের একটা পায়ার কাছে একটা দলা পাকানো লুঙ্গি। এ ঘরে পুরুষরা আসে। নিজে খাটে বসে শিশির রিভলভারটা দিয়ে স্ত্রীলোকটিকে ইঙ্গিত করল মেঝেতে বসতে। অ্যাশট্রে নেই, শিশির ছাই ঝাড়ল মাটিতে, তাতে কিছু যায় আসে না, এ বাড়ি এখন বন্ধ থাকবে অনেকদিন। বাড়ির মালিককেও চালান করতে হবে।

শিশির বলল, তুমি মাইনে নিয়ে কাজ করো বললে। এই বাচ্চাগুলোকে কোথা থেকে আনা হয়েছে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা তুমি জানো না?

না, জানি না।

জানতে ইচ্ছে করে না? এতগুলো বাচ্চাকে কেন একসঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে, তাও জানতে ইচ্ছে করে না?

আমাকে টাকা দিয়ে বলেছে, বাচ্চাগুলোকে খাওয়াবে, ঘুম পাড়াবে। অন্য কথায় আমার কী কাজ?

তোমাকে কেউ টাকা দিয়ে যদি বলে, একটা বাচ্চার গলা টিপে মারো, তুমি তাই করবে?

ওমা, সে কী কথা! অমন কাজ মানুষে করে?

মোট চব্বিশটা বাচ্চা ছিল। গুনে দেখলাম তেইশটা। একটা এখানেই মরেছে। সে তো খুন করারই সমান।

আমি বাপু সে কথা জানি না।

তুমি জানো না? এই বাচ্চাগুলো সবকটাকে যে মরতে পাঠানো হচ্ছে, তা তুমি জানো না?

সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না। আমি তো তেইশটাই দেখেছি। মা কালীর দিব্যি।

তুমি মা কালীর পুজো দাও?

দিই তো। আমাদের বাড়ির কাছেই লরোড কেলাইবের আমলের কালীমন্দির আছে।

কার আমলের?

লরোড কেলাইব।

লর্ড ক্লাইভ! পুজোদাও, আর মায়ের দিব্যি করে মিথ্যে কথাও বলো!

আমি মিথ্যে বলিনি তো!

বাচ্চাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে আনা হয়েছে এখানে। তোমাদের হেফাজতে কয়েকদিন রেখে তারপর পাঠানো হবে বোম্বাই। সেখান থেকে পাচার হবে আরব দেশে। আবুধাবি। সেখানকার শেখরা উটের দৌড় দেখতে খুব ভালোবাসে। উটের দৌড়। অনেক টাকার খেলা। এক-একটা বাচ্চাকে বেঁধে দেওয়া হবে উটের পিঠে। বাচ্চাগুলো ভয়ে কাঁদবে আর চ্যাঁচাবে। সেই চ্যাঁচানি

শুনে উটগুলোও তড়বড়-তড়বড় করে ছুটবে। সেখানে প্রচণ্ড গরম। প্রায় সবকটা বাচ্চাই দৌড়ের শেষে মারা যায়। এসব তুমি জানো না?

আজ্ঞে না। কিছু জানি না।

হুঁ। তাহলে আমি কী-কী জানি শোনো। তোমার নাম শেফালি। শেফালি মণ্ডল। এই ব্যবসায় তোমার বখরা আছে। আগের বছরও তোমরা অনেকগুলো বাচ্চাকে চালান করেছ। সেবার একটুর জন্যে তোমাকে ধরা যায়নি। এবার তোমায় জেলের ভাত খেতেই হবে।

শেফালি এবারও বিশেষ ভয়ের চিহ্ন দেখাল না।

শিশির বুঝতে পারল, শেফালির জোর কোথায়। ঝানু মেয়ে। ও জানে, বড়জোর জেল খাটতে হবে দু-তিন বছর। তাও কোনও পুঁদে উকিল লাগালে আরও শাস্তি কমে যেতে পারে, এমনকী খালাসও হয়ে যেতে পারে। বাচ্চা ছেলে মারার ব্যাবসা যারা করে, তাদের জন্যেও উকিল পাওয়া যায়। বিচারকও সূক্ষ্ম আইনের মারপ্যাঁচে এদের ফাঁসি দিতে পারে না। মাত্র কয়েক বছর কারাদণ্ড। কিছুই না। বেরিয়ে এসে আবার এইরকম কিছু ব্যাবসা ফাঁদবে।

তাও শেফালি কিংবা ইসমাইলরা চুনোপুঁটি। আসল লোকরা বসে আছে বোম্বেতে। তারাই টাকা ইনভেস্ট করে, বেশি লাভ করে তারাই। এক-একটা বাচ্চার দাম পঁচিশ হাজার টাকা, শেফালিরা তার থেকে পায় যৎসামান্য, এই বাচ্চাদের মা-বাবারা পায় আরও কম।

সবই টাকার জন্য। উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় টাকা। বম্বের ব্যবসায়ীরা ছেলে চালান দেয় টাকার জন্যে।

বাংলাদেশ আর কলকাতার কিছুনীচু ধরনের মানুষ সেইসব ছেলের জোগান দেয় টাকার জন্যে। অতিদরিদ্ররা ছেলে বিক্রি করে দেয় কয়েকটা টাকার জন্যে। আরব শেখদের বাচ্চাই চাই। শিশুদের আর্ত কান্না না শুনলে তাদের খেলা জমে না। খুব গরিব দেশ ছাড়া এরকম বাচ্চাই বা পাওয়া যাবে কোথায়? এসব দেশের সরকারও গরিবদের শিশু নিয়ে মাথা ঘামায় না।

শিশিরের প্রবল ইচ্ছে থাকলেও তো শেফালি ইসমাইলদের গুলি করে মেরে ফেলতে পারবে না। সে ক্ষমতা তার নেই। এখানে তবু এদের দু-তিন বছর জেল খাটানো যেতে পারে। বম্বেতে তাও যাবে না। বম্বের আসল চাঁইরা ধরে পড়ে না।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে শিশির জিগ্যেস করল, আমায় কত দিবি?

শেফালি চোখ গোল-গোল করে তাকাল।

শিশির আবার বলল, আমাকে কত দিবি বল। ছেড়ে দেব তোকে।

শেফালি এবার উঠে দাঁড়াল। এখন সমানে-সমানে কথা হবে। শেফালি বলল, পাঁচ।

উঁহু, অত কমে হবে না।

তাহলে সাত হাজার। তার বেশি দিতে পারব না।

আমার পনেরো চাই। অত দেব কোথা থেকে? আমাদের অত বেশি হয় না।

তাহলে জেলে যা।

ইসমাইলদেরও ছাড়বে?

না, ওরা কেউ ছাড়া পাবে না। ওই তিনজন তো গেছেই। তুই একা ছাড়া পেতে পারিস। এখান থেকেই সোজা বাড়ি চলে যাবি। কিন্তু আমায় পনেরো দিতে হবে।

আচ্ছা, বারো দেব। এবারের মতন এই নাও।

ঠিক আছে। বারোই পাক্কা।

কিন্তু সব টাকা তো এক্ষুনি দিতে পারব না। এখানে নেই।

এখন আমি টাকা ছোঁবোই না। তুই পালিয়েছিস শুনলে যদি আমায় সার্চ করে? আমার পকেটে টাকা রাখব না। টাকা নেব তোর বাড়ি থেকে। রাত্তিরবেলা। তখন আমার ডিউটি থাকবে না। কিন্তু সাবধান, যদি বেইমানি করিস…

ও কথা বোলোনা। আমাদের কথার দাম আছে। বারো দেব বলে যখন স্বীকার পেয়েছি, তখন ঠিক বারোই দেব। গুনে নিও।

আর কেউ যেন সেখানে না থাকে। তোর দলের লোকজনদেরও দেখতে চাই না।

না গো, কেউ থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি।

ঠিক আছে। আজ রাত্তিরে। তোর বাড়ির ঠিকানা দে।

শেফালির বাড়ি মধ্যমগ্রামে। কলোনির মধ্যে। একতলা বাড়ি, সঙ্গে অনেকটা জমি আছে। সামনে একটা দর্জির দোকান। সেটার মালিক শেফালি। লোকে ভাবে ওই দর্জির দোকান থেকেই অনেক উপার্জন।

শেফালির স্বামী নেই। এক দেওর আছে। সেই দেওরের সঙ্গে তার সম্বন্ধটা খুব পরিষ্কার নয়।

তিনটি ছেলেমেয়ে, আর এক বুড়ি পিসিমা আছে, সে-ই সংসারের সব কাজকর্ম করে। শেফালির তৃতীয় বাচ্চাটির বয়েস সাড়ে তিন বছর, তার স্বামী মারা গেছে পাঁচ বছর আগে।

লালমনি দাস থাকে এই কলোনিতেই। ওই লালমনিই শেফালিকে চোরাচালানের কারবারে ভিড়িয়েছে। কখনও বাংলাদেশ থেকে আসে মানুষের বাচ্চা, কখনও এদিক থেকে যায় বুড়ো গরু।

রান্নাঘরের সামনের বারান্দায় খেতে বসেছে বাচ্চারা, এইসময় সেখানে এসে উপস্থিত হল শিশির। পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরা, কোমরের বেল্টে রিভলভার। ডিউটির পরেও সে ইউনিফর্ম পরে এখানে এসেছে, তার সাহস কম নয়।

শেফালি একটা মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, এসো গো, বোসো। চা খাবে?

শিশির বসল না। সে চা-ও খাবে না। তার সর্বাঙ্গে অস্থিরতা। যেন তার সময় নেই। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে।

শেফালি বেশ অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল, চা খাবে না। তবে কি মাল খাবে? ভালো মাল আছে। এস্কচ।

নাঃ! বলেই শেফালির ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে রইল শিশির। তারপর হঠাৎই সবচেয়ে ছোট ছেলেটাকে কোল তুলে নিল। বাচ্চাটার খাওয়া শেষ হয়নি, দুধ-ভাতের সঙ্গে সন্দেশ মেখে দেওয়া হয়েছে তাকে, সে হাত চাটছিল। এমন সময় এই উপদ্রবে সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। পুলিশ দেখে ভয়ও পেয়েছে।

স্নেহশীল পিতার মতন শিশির তাকে নাচাতে-নাচাতে বলতে লাগল, না, না, কাঁদে না, কাঁদে না, ভয় নেই, পুলিশ দেখে ভয় পেতে নেই, পুলিশকে কেউ মানে না।

বাচ্চাটার নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছে, শিশিরের কোনও ঘেন্না নেই, সে নিজের রুমাল দিয়ে মুছে দিল। অনেকরকম সুর-করা কথায় ভোলাতে লাগল বাচ্চাটাকে। একসময় তাকে ভুলিয়েও। ফেলল। লজেন্স দিল তাকে। তারপর শেফালির দিকে ফিরে বলল, ভারী সুন্দর বাচ্চাটা। এই দ্যাখো, আমাকে পছন্দ হয়েছে। কী রে, খেলবি আমার সঙ্গে?

শেফালি বলল, এবার ওকে নামিয়ে দাও। টাকাটা আমি গুনে পুঁটলি বেঁধে রেখেছি। বেশ বড় পুঁটুলি হয়েছে, কীসে নেবে?

শিশির বলল, থাক, টাকাটা আর লাগবে না। আমি তোমার এই ছেলেটাকে নিয়ে যাচ্ছি। কী রে, ঘোড়ায় চড়বি? আমি নিয়ে গেলে ঘোড়ায় চড়তে পারবি।

শেফালি বলল, এ আবার কী অলুক্ষুণে কথা!

শিশির বলল, ধরে নাও, এর দাম বারো হাজার। ওখানে সবসুদ্ধ চব্বিশটা বাচ্চার থাকার কথা। ছিল তেইশ জন। গুনতিতে মেলাতে হবে তো!

শেফালি তীব্র কণ্ঠে বলল, আমার ছেলেকে এক্ষুনি নামিয়ে দাও। ওসব ঠাট্টা শুনতে আমার ভালো লাগে না।

শিশির ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, তোর সঙ্গে কি আমার ঠাট্টার সম্পর্ক? পুলিশের কাজ করলে হাসি-ঠাট্টার সময়ই পাওয়া যায় না।

শেফালি বলল, আমার ছেলেকে অন্য কারুর কোলে নেওয়া আমি পছন্দ করি না। ওকে দাও, নইলে ভালো হবে না বলছি!

শিশির বলল খারাপ আর কী হবে? অ্যাঁ?

শেফালি হাত বাড়াতেই শিশির তাকে জোরে ঠেলে দিল।

শেফালির দেওর আর পিসিমা এসব শুনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। তাদের দিকে তাকাল শিশির। তারপর রিভলভারটা খুলে ধমক দিয়ে বলল, তোমাদের এখানে কী চাই যাও, কাজে যাও…

দেওরটা মাস্তানের মতন ভঙ্গি করে বলল, ও মোশাই, এসব কী হচ্ছে? পুলিশ বলে কি মাথা কিনেছেন নাকি? আমাদেরও বড় পুলিশের সঙ্গে চেনা আছে।

শিশির বলল, আমি ছোট পুলিশ। একটা কথা শুনে রাখ। বদমেজাজি বলে আমার বদনাম আছে। যখন তখন গুলি চালাই। একটাও টিপ ফস্কায় না। তুই আর-একটা কথা বললে তোর খোপরি। উড়িয়ে দেব। বড় পুলিশের কাছে যাওয়ার আগেই তুই খতম হবি!

শেফালি হাতজোড় করে বলল, দয়া করে আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। তোমার পায়ে পড়ি…

শিশির দরজার দিকে এগিয়ে বলল, পায়ে পড়ার কী আছে। কাল অনাথ আশ্রমে গিয়ে দেখিস আর তেইশটা বাচ্চার মধ্যে নিজেরটা চিনতে পারিস কি না। তারপর যদি প্রমাণ দিতে পারিস…

তবু শেফালি ঝাঁপিয়ে পড়ল শিশিরের পায়ে। পাগলের মতন কাঁদতে কাঁদতে কী বলতে লাগল

বোঝাই গেল না।

এক ঝটকায় নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে শিশির বলল, খবরদার, আমাকে ছুঁবি না…

বাচ্চাটা কিন্তু এখন আর কাঁদছে না। কী সরল, নিষ্পাপ মুখ। এই বয়েসের সব শিশুরই মুখ যেন একইরকম। শিশির আর একবার দেখল মাটিতে পড়ে থাকা শেফালিকে। জেল খাটতে হলেও শেফালি বোধহয় কাঁদত না। আর তেইশটা বাচ্চার মা যদি কাঁদতে পারে, শেফালিই বা একটু কাঁদবে না কেন? কাঁদুক!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *