শুভ্র গেছে বনে পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

শুভ্র গেছে বনে পর্ব – ৪

আজহার বললেন, তুমি ষাড়ের গোবর ছাড়া কিছু না। প্লেইন এন্ড সিম্পল cowdung. তিনবার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে এখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও। ঢাকা শহরে তুমি ঠেলাগাড়ি চালিয়ে জীবন কাটাবে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এখন আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও। স্টুপিড কোথাকার! টুনু মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল। আজহার খাম খোলার প্রস্তুতি নিলেন। তবে এবার ভুল করলেন না, সাবান দিয়ে বেশ কয়েকবার হাত ধুয়ে নিলেন; যেন চিঠিতে বিড়ির গন্ধ লেগে না থাকে।করিম আংকেল যুথীর চাকরি পাওয়া সেলিব্রেট করার জন্যে শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে খুলতে বললেন, বিশেষ কোনো ঘটনা সেলিব্ৰেট করার জন্য আছড়ে নারিকেল ভাঙার প্রথা ছিল। পশ্চিমা দেশে নারিকেলের পরিবর্তে শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়।

যুথী, তুমি যদি গ্লাসে একটা চুমুক না দাও। তাহলে সেলিব্রেশন সম্পন্ন হবে না।শ্যাস্পেনের গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালা হয়েছে। চারজন মানুষ চারটা গ্লাস। নীপা, যুথী, করিম, আংকেল এবং যমুনা।নীপ বলল, যুথী যখন খেতে চাচ্ছে না। ওকে জোর করার কিছু নেই, ও খালি গ্লাসেই চুমুক দিক।করিম আংকেল বললেন, তা তো হবে না।নীপা বলল, আমি নারিকেল আনার ব্যবস্থা করছি। নারিকেল ভাঙা হোক।যুথী কিছু না বলে একটা শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল।করিম আংকল বললেন, খেতে কেমন লাগছে বলো?

যুথী বলল, তেঁতুলের পানির মতো লাগছে।করিম অ্যাংকেল প্লাস উঁচু করে বললেন, যুথীর চাকরি পাওয়া উপলক্ষে উল্লাস অর্থাৎ Cheers. যুথী ছাড়া সবাই বলল, চিয়ার্স! যুথী গ্লাসে দ্বিতীয় চুমুক দিল।নীপা বলল, যুথীকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে হুট করে চাকরি কেন দিল। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। করিম আংকেল, আপনার কী ধারণা? করিম আংকেল বললেন, যে চাকরি দিয়েছে সে যে-কোনো কারণেই যুথীর প্রতি প্রবল শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করেছে। বডি কেমিষ্ট্র কাজ করেছে। আর কিছু না।নীপা বলল, ভদ্র কথা বলুন করিম আংকেল।

এরচেয়ে ভদ্রভাবে বিষয়টা বলা অসম্ভব। যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যে চাকরি হয়েছে তিনিও এরচেয়ে ভদ্রভাবে বলতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো পারতেন। তিনি বলতেন, যুথীকে দেখিয়া উনার শরীর জাগিয়া উঠিল। বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।যমুনা বলল, শ্যাম্পেন খেতে ভালো লাগছে না। আমি হুইঙ্কি খাব।করিম আংকেল বললেন, হুইস্কির বোতল যথাসময়ে খোলা হবে। তার আগে আমি যে বিশেষ কথাটি বলতে চাচ্ছি তা বলে ফেলি। আমি একটা ছবি বানাব। ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম। ছবির নাম প্তহামানব! পাইপের ভেতর বাস করে এমন কিছু নরনারীর দিবারাত্রির কাব্য। সবাই বলো, উল্লাস।

সবাই উল্লাস বলল।আজহার দরজা বন্ধ করে যুথীর ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। প্রথম পাতায় তারিখ দিয়ে লেখা– করিম আংকেল আজ আমাকে মদ খাওয়ানোর জন্যে অনেক ঝুলাঝুলি করলেন। যে এই জিনিস খায় না তাকে এত পীড়াপীড়ি কেন! আমাকে বললেন, যুথী, এসো আমরা কারণ ছাড়া কারণ পান করি।আমি বললাম, কারণ জিনিসটা কী? করিম আংকেল বললেন, কারণ হলো কারণবারি। তান্ত্রিক সন্নাসীরা মদ বলে না। বলে কারণবারি। এতে মদের দোষ কেটে যায়।আজহার ডায়েরি বন্ধ করে ঘামতে থাকলেন। এইসব কী? তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তাঁর মনে হলো এক্ষুনি তিনি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে যাবেন।

আজ জুলাই মাসের এক তারিখ, সোমবার।যুথীর অফিসে জয়েন করার তারিখ। সে হাতে ষোলদিন সময় পেয়েছিল। এই ষোলদিনে সে অনেকগুলি কাজ করেছে। New Age computer নামের এক প্রতিষ্ঠানে এক হাজার টাকা দিয়ে নাম লিখিয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ক্লাস। তারা ছয় মাসে নাকি কম্পিউটারে ওস্তাদ বানিয়ে দেবে। নিউ এজ কম্পিউটারের মালিক আব্দুস সোবাহান কোরানে হাফেজ। তিনি বললেন, মা শুনেন কম্পিউটার হলো মানব সন্তানের মতো। তার যত্ন করবেন। তাকে আদর করবেন। সে আদরের কাঙাল। শিশুদের যেমন পোষ মানাতে হয়, তাকেও পোষ মানাতে হবে। তারপর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ আদায় করতে হবে।

হাফেজ সাহেবের কথাবার্তা যুথীর পছন্দ হলো। সে একদিন ক্লাশ করেছে। তার কাছে মনে হয়েছে, হাফেজ সাহেব শিক্ষক হিসেবে ভালো।সে একজন গানের টিচারের সাথেও কথা বলেছে। তার নাম অশোক মিত্ৰ। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখান। তবলা সঙ্গে নিয়ে যান বলে ছাত্রের বড়িতে তবলা না থাকলেও সমস্যা নাই। অশোক বাবু মাসে এক হাজার টাকা নেবেন এবং সপ্তাহে একদিন শুক্রবার গান শেখাবেন এমন কথা হয়েছে। যুথীর গান শেখা এখনো শুরু হয় নি।যুথী চারটা ছেলেমেয়েকে পড়াত। এদের প্রত্যেককে এক প্যাকেট চকলেট দিয়ে বিদায় নিল। চাকরির প্রথম বেতনের টাকা পেয়ে সে তাদের সবাইকে নিয়ে পিৎজাহাটে খাবে, এই কথা বলে এল।

চাকরিতে জয়েন করতে যাবার আগে বাবা-মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। আজহার বললেন, সোনার হরিণ সহজে ধরা যায় না। তোর ওপর ময়মুরুব্বির দোয়া আছে বলে ধরে ফেলেছিস। চেষ্টা করবি যেন হরিণ ছুটে না যায়।যুথীর মা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন। আজহার বললেন, শুভযাত্রার সময় চোখের পানি ফেলছ। মূর্খামীর সীমা থাকা দরকার। কাঁদতে হয় বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ভেউ ভেউ করে।টুনু ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে এনেছে। প্রথমদিন ভাড়া ট্যাক্সিতে করে যুথী যাচ্ছে। আজ অফিস শেষে অফিসের গাড়ি বাসা চিনে যাবে, তখন অফিসের গাড়িতেই আসা-যাওয়া হবে! টুনু বলল, আমি তোর সঙ্গে যাই। অফিসটা দেখে আসি।

যুথী বলল, ভাইয়া আজ না। আরেক দিন। আজ আমার খুব লজ্জা লাগছে।অফিসে পা দেওয়া মাত্র বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন; আজ তাঁর সামনে কোনো গল্পের বই নেই। চোখে চশমা। ওইদিন চোখে চশমা ছিল না। হালকা সবুজ রঙের শার্টে তাকে আগের দিনের চেয়েও সুন্দর লাগছে।

যুথী আপনার নাম?

জি।

ভালো আছেন?

জি স্যার ভালো আছি।

জয়েন করতে এসেছেন?

জি।

আমাদের কিছু সমস্যা হয়েছে। আপনাকে নিতে পারছি না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে উল্লেখ করা আছে, কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া আমরা অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার বাতিল করতে পারি। আপনার বায়োডটা আলাদা রেখে দিতে বলেছি। কোনো স্কোপ হলে আপনাকে খবর দেব। বুঝতে পারছি আপনাকে অসুবিধায় ফেলেছি। সরি ফর দ্যাট।বড় সাহেব ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র বের করে পড়তে শুরু করলেন। হঠাৎ তাকে অনেক ব্যস্ত মনে হলো।

যুথী বড় সাহেবের ঘর থেকে বের হলো। তার উচিত মাথা নিচু করে কেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া। কেন জানি এই কাজটা সে করতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে। সারা দিন অফিসে বসে থাকতে। অফিস ক্যানটিনে চা খেতে। জহির সাহেবকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে।জহিরকে দেখা গেল। সে চট করে চোখ সরিয়ে নিয়ে করিডরের দিকে চলে যাচ্ছিল।যুথী গলা উঁচিয়ে ডাকল, জহির সাহেব!জহির দাঁড়াল। যুথী তার কাছে এগিয়ে গেল। সহজ গলায় বলল, কেমন আছেন?

জহির বলল, জ্বি ভালো।মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। আমার নাম যুথী।আমি আপনাকে চিনেছি।আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই শুনেছেন? জি আমি জানি।আমার পোষ্টে কি কাউকে নেওয়া হয়েছে?আগে যিনি ছিলেন তিনি জয়েন করেছেন।যুথী বলল, প্রচণ্ড রাগ লাগছে। কী করা যায় বলুন তো? বড় সাহেবের অফিসঘরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া তো সম্ভব না।আমার রুমে কিছুক্ষণ বসবেন? আপনার কি ধারণা আপনার ঘরে কিছুক্ষণ বসলে আমার রাগ কমবে? এক কাপ চা খান!থ্যাংক য়্যু। আরেকদিন এসে চা খেয়ে যাব।আপনাকে এক মাসের বেতন দেওয়ার কথা। এই বিষয়ে কি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন?

না! চলুন আপনার ঘরে বসি, এক কাপ চা খাই। গফুর ভালো চা বানায়। ওকে বলুন আমাকে এক কাপ চা দিতে।চা খেতে খেতে যুথী বলল, এই মুহুর্তে অপমানটা আমার গায়ে লাগছে না। কিন্তু বাসায় যখন ফিরব, সবাই জানবে, তখন অপমানটা গায়ে লাগবে। অভাবী সংসার তো। কুড়ি হাজার টাকা বেতনের চাকরি অনেক বড় ব্যাপার। সোনার হরিণের চেয়েও বেশি। প্লাটিনাম হরিণ।জহির বলল, মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন? ঠিকানা দেব?

যুথী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না। আমি আরেক কাপ চা খাব।দুকাপ চা পুরোপুরি শেষ করে যুথী উঠল। সে ঠিক করল আজ সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরবে না। সারাদিন পথে পথে ঘুরবে। পার্কে বসে বাদাম খাবে। হাফ প্লেট চটপটি খাবে।গফুরকে দশ টাকা বখশিশ দিয়ে যুথী বের হলো। গফুর অত্যন্ত বিরক্ত হলো। এত কম বখশিশ মনে হয় তাকে এর আগে কেউ দেয় নি।নিউ এজ কম্পিউটারে একবার যেতে হবে। টাকাটা ফেরত পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টা। মনে হয় না ফেরত পাওয়া যাবে; গানের টিচার বাতিল করতে হবে। পুরনো টিউশনি ফেরত পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টাও করতে হবে। আজ একদিনে তার অনেক কাজ।

অনেকক্ষণ ধরে কে যেন বেল টিপছে। বাসায় সালমা ছাড়া কেউ নেই। ঠিকা কাজের মেয়ে কাজ শেষ করে চলে গেছে। সম্ভবত টুনু এসেছে। সালমা দরজা খুললেন। অপরিচিত একটা মেয়ে। ষোল-সতেরোর বেশি বয়স হবে না। চামড়ার একটা সুটকেস আর কাধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা সুন্দর। যে-কোনো কারণেই হোক ভয়ে তার চোখমুখ শুকিয়ে আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ কেঁদেছে। চোখ ফোলা এবং লাল। মেয়েটা শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি খানিকটা এলোমেলো। মনে হয় শাড়ি পরায় সে অভ্যস্থ না।

সালমা বললেন, কী চাও?

মেয়েটা বলল, ও নাই?

সালমা বললেন, ওটা কে?

টুনু ভাই।

টুনু ভাইয়ের সঙ্গে তোমার কী?

দরকার আছে।মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠল। সালমা বললেন, আমি টুনুর মা। টুনুর সঙ্গে তোমার কী দরকার? আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। আমার কোথাও যাবার জায়গা নাই।সালমা বললেন, টুনু তোমাকে জায়গা দিবে কী জন্যে? টুলুর সঙ্গে তোমার কী? ওর সঙ্গে আমার কোর্টে বিয়ে হয়েছে। আগস্ট মাসের সাত তারিখ।কী বলছ পাগলের মতো! নাম কী তোমার? লাইলি। আমি কি আপনাকে কদমবুসি করব? আসো ভিতরে। টুনু আসুক। তখন ফয়সালা হবে।সালমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এইসব তিনি কী শুনছেন? বাসা থেকে তোমাকে কে বের করে দিয়েছে? তোমার বাবা-মা?

না, আমার মামা। আমার বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন। আমি মামার সঙ্গে থাকি। আমি এক গ্লাস পানি খাব।সালমা পানি এনে দিলেন। এবং মোবাইল টেলিফোনে আজহারকে ঘটনা জানালেন।আজহার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মেয়ের পাছায় কষে একটা লাথি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দাও। টুনু হারামজাদা বাসায় ফিরুক, আমি তাকে লাথি দিয়ে বের করব। লাইলি-মজনু খেলা আমার বাড়ির বাইরে হবে। আমি এক্ষুনি রওনা হচ্ছি। বাসায় এসে যেন মেয়েকে না দেখি। যদি দেখি তাহলে তোমাকে বের করে দেব।সালমা বসার ঘরে ঢুকলেন। বেতের চেয়ারে মেয়েটা বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি মোটেই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। লাইলি বলল, আমি আরেক গ্লাস পানি খাব।

সালমা বললেন, যত ইচ্ছা পানি খাও, তারপর বাসা থেকে চলে যাও। টুনুর বাবা আসছেন। উনি ভয়ঙ্কর রাগী মানুষ। কী করে বসেন তার নাই ঠিক।লাইলি বলল, আমি কোথায় যাব? সেটা তো আমি জানি না। বিয়ে করার সময় তো আমাকে জিজ্ঞেস করে বিয়ে করোনি।ও না আসা পর্যন্ত আমি যাব না। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।টুনুর বাবা এলে কী হবে তুমি কল্পনাও করতে পারছি না।আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে টুনু ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করি? যা ইচ্ছা করো। শুধু ঘরে থাকবে না।সুটকেস এবং ব্যাগটা এখানে থাকুক? কোনো কিছুই থাকবে না।

ঘণ্টাখানিকের মধ্যে আজহার উপস্থিত হলেন। রাগে তাঁর মুখ গনগন করছে। বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। টুনুর গলা টিপে ধরতে পারলে শান্তি পেতেন। টুনুর খোঁজ নেই।আজহার বললেন, ঘরের স্টিলের ডান্ডাওয়ালা একটা ছাতা আছে না? ছাতা বের করে রাখে। ঐ ডান্ডা আজ তোমার ছেলের পিঠে ভাঙব। তারপর কানে ধরে বহিষ্কার। আমার ঘাড়ে চেপে বসে থাকার দিন তার শেষ। এখন সে চরে খাবে।সালমা বললেন, একগ্লাস লেবুর শরবত করে দেব? খুব ঘামছ।দাও লেবুর শরবত। শরীরে বল করি। মেয়েটাকে দেখলাম। ইঁদুরের মতো মুখ।

সালমা বললেন, ইঁদুরের মতো মুখ তো না। সুন্দর চেহারা।তাহলে কি দেবীর মতো মুখ? তুমিও কি তোমার ছেলের মতো দেবীদর্শন করে ফেললে? ঘরে বসে থেকে কী করবে! যাও দেবীর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করো।তুমি কি খেয়ে এসেছ? না।আবার অফিসে যাবে? বাসায় যে অবস্থা, অফিসে কী যাব! গোসল করে আসো। ভাত খাও। শুয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও।আর রেস্ট! আমার জীবন থেকে রেস্ট উঠে গেছে।সালমা বললেন, যুথীকে কি খবরটা জানাব? আজহার বললেন, না। প্রথম চাকরিতে জয়েন করেছে। এখন তাকে ডিসটার্ব করা যাবে না।আজহার সদর দরজার দিকে এগুলেন। সালমা বললেন, কোথায় যাও?

আজহার বললেন, আরেকবার দেবীদর্শন করে আসি।সালমা ক্ষীণ গলায় বললেন, মেয়েটাকে বাসায় নিয়ে আসো। সারা দিন নিশ্চয়ই না খেয়ে আছে।আজহার বললেন, আরেকবার এই ধরনের কথা বললে তোমাকেও ছাতাপিটা করব। মাতাপুত্র একসঙ্গে ছাতার নিচে।লাইলি আগের জায়গাতেই আছে। আগে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন স্যুটকেসের ওপর বসে আছে। শাড়ির আঁচলে তার মুখ ঢাকা। মাঝে মাঝে শরীর কেঁপে উঠছে। বলে বোঝা যাচ্ছে সে কাঁদছে। তাকে ঘিরে আছে চার-পাঁচজন কৌতূহলী মানুষ। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে দৃশ্যটা দেখে তারা আনন্দ পাচ্ছে।

আজহার ফিরে এসে গোসল করলেন। ভাত খেলেন। বিছানায় শুয়ে পর পর দুটা বিড়ি টেনে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। তাঁর ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলায়। টুনু তখনো ফেরে নি। তিনি মেয়েটির খোঁজ নিতে গেলেন। মেয়েটি নেই।রেহানা শুভ্ৰকে নিয়ে বারান্দায় বসেছেন। ছেলের সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করবেন। বুঝতে পারছেন না। কখনো তার এরকম হয় না। শুভ্ৰ যে এরকম একটা কাণ্ড করতে পারে তা তার মাথাতেই কখনো আসে নি। শুভ্রর বাবার সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। তিনি জাপানে। চার দিন পর ফিরবেন।রেহানা বললেন, শুভ্ৰ, তুমি অচেনা অজানা একটা মেয়ে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হয়েছ?

শুভ্র বলল, মেয়েটার যে অবস্থা মা, যে-কেউ তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেত। পুরো ঘটনোটা বলি, আগে শোনো। বলব? রেহানা হ্যাঁ না কিছু বললেন না। শুভ্ৰ নিজে থেকেই শুরু করল। যুথী আজ সন্ধ্যায় তাদের বাসায় আমাকে চা খেতে বলেছে। টেলিফোনে বলে নি, চিরকুট পাঠিয়েছে। আমি তার বাসার কাছে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে সুটকেসের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। প্রায় অচেতন অবস্থা। তাকে ঘিরে নানান ধরনের মানুষের জটিল।রেহানা বললেন, ভিড় ঠেলে তুমি ভেতরে ঢুকলে এবং মহান ত্ৰাণকৰ্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে। মেয়েটাকে পাজাকোলা করে গাড়িতে তুলে বাসায় নিয়ে এলে?

শুভ্র বলল, পাজাকোলা করে আনতে হয় নি মা। আমি যখন বললাম, আপনি কি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবেন? সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। চারপাশের লোকগুলি এমন অদ্ভুত, ওরা হাততালি দেওয়া শুরু করল।রেহানা বললেন, ওরা হয়তো ভেবেছে বাংলা ছবির কোনো দৃশ্যের শুটিং হচ্ছে। সেরকম ভাবাই স্বাভাবিক। দর্শকদের মধ্যে আমি থাকলে আমিও হাততালি দিতাম। যাই হোক, আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেছি। মেয়েটিকে যেখান থেকে আনা হয়েছে ড্রাইভার তাকে সেখানে রেখে আসবে।শুভ্ৰ বলল, মা, মেয়েটি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে। বিপদ কেটে গেলে সে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।রেহানা বললেন, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদে আছে। তাদের সবাইকে তুমি এখানে নিয়ে আসবে?

শুভ্ৰ বলল, বাংলাদেশের সব বিপদগ্ৰস্ত মেয়েকে আমি চিনি না মা। একে চিনি।একেও তুমি চেনো না। হঠাৎ দেখেছ, তুলে নিয়ে এসেছ।শুভ্ৰ বলল, আমি তাকে নিয়ে এসেছি, এখন আমি তাকে বলব চলে যেতে? রেহানা বললেন, তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। যা বলার আমি বলব। তুমি তোমার ঘরে চলে যাও। গান শোনো কিংবা টিভি দেখো। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর নতুন কপি আজ দুপুরেই এসেছে। সেটাও পড়তে পার।শুভ্র বলল, মা শোনো। তুমি যদি সত্যি সত্যি মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দাও, আমিও কিন্তু বের হয়ে যাব।বের হয়ে যাবে? হ্যাঁ।কোথায় যাবে?

তা জানি না, কিন্তু বের হয়ে যাব।রেহানা বারান্দা থেকে উঠে নিজের ঘরে ঢুকলেন। টেলিফোনে সব ঘটনা শুভ্রর বাবকে জানালেন।মেরাজউদ্দিন বললেন, মেয়েটাকে এই মুহূর্তে বের করে দাও। তোমার ছেলে যদি বের হয়ে যায় তাহলে যাবে। ঢাকা শহর হলো ভয়াবহ অরণ্য। অরণ্যে বাস করার যোগ্যতা তার নেই। সে ফিরে আসবে। শিক্ষাসফর শেষ করে ফিরবে। এটাই লাভ। কোনো টাকা পয়সা সে যেন সঙ্গে না নেয় এটা খেয়াল রাখবে।

রাত আটটায় রেহানা শুভ্রকে এবং মেয়েটাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছেন।শুভ্র বলল, মা আমি যাচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার ওপর রাগ করে থেক না। রাগ করার মতো কিছু করি নি। মেয়েটাকে দেখে খুবই কষ্ট লেগেছিল। আমরা তো বিচ্ছিন্ন কেউ না। সবাই সবার সঙ্গে যুক্ত। আমরা বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর অংশ। একই Species, হোমোসেপিয়ানস।রেহানা বললেন, বক্তৃতা দিয়ে না। তোমার বক্তৃতা শোনার মতো মনের অবস্থা আমার না। ড্রাইভারকে বলো কোথায় তোমাদের নামিয়ে দিতে হবে, সে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে।ড্রাইভার লাগবে না মা, যাই। তোমাকে বিরাট একটা সমস্যায় ফেলেছি, সরি।রেহানা বললেন, তোমার সঙ্গে কি মানিব্যাগ আছে?

শুভ্ৰ বলল, আছে! রেহানা কঠিন গলায় বললেন, মানিব্যাগ রেখে যাও।রাস্তায় নেমেই লাইলি বলল, এতক্ষণ খুব ভয় লাগছিল। এখন কোনো ভয় লাগছে। বরং মজা লাগছে।শুভ্র বলল, মজা লাগছে? হুঁ। খুব ক্ষিধে লেগেছে। সকালে দুটা রুটি আর আলুভাজি খেয়েছি। সারা দিন কিছু খাই নি। ঐ দোকানে গরম গরম সিঙ্গারা ভাজছে! আসুন সিঙ্গারা খাই।শুভ্র বলল, তোমার কাছে কি টাকা আছে? আমার কাছে কোনো টাকা নেই।আমার কাছে সাতশ পঁচিশ টাকা আছে; পাশের বিরিয়ানি হাউসে যাবেন? বিরিয়ানি খাবেন? তোমার খেতে ইচ্ছা করলে চলে যাই। তবে আমি কিছু খাব না।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *