শ্রাবণমেঘের দিন পর্ব – ১৩ হুমায়ূন আহমেদ

শ্রাবণমেঘের দিন পর্ব – ১৩

আড়াল থেকে কুসুম মানুষটার খাওয়া দেখছে। ভিতরবাড়িতে সে সামনে যায় কিন্তু বাংলাঘরে পুরুষের সামনে যাওয়া যায় না। সুম মনে মনে হাসছে। খালা এই মানুষটাকে যত বড় ঘরের মনে করছেন সে তত বড় ঘরের না। এই তো বিরাট বিরাট নলা করে মুখে দিচ্ছে। খিদে মনে হয় খুব লেগেছে। খাওয়া দিতে অনেক দেরি হল।এক সময় কুসুম বলল, আফনের পেট ভরছে?

লোকটা ধড়মড় করে উঠল। কুসুম যে এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়েছিল সে বুঝতে পারেনি।অযত্ন হইলে ক্ষমা দিবেন। মার শইলডা ভালা না।অযত্ন হয় নাই।পুষ্প, যা পান বানাইয়া আন।পুষ্প পান আনতে গেল। কুসুম ঘরে ঢুকল।গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে বাড়ি, তার উপর বলতে গেলে নিশুতি রাত। সে কি করছে না করছে দেখার কেউ নেই। কুসুমকে ঢুকতে দেখে সুরুজ আরও হকচকিয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল। কুসুম বলল, বসেন বসেন। সুযোগ বুইজ্জ্যা দুইটা কথা বলতে আসছি।সুরুজ বলল, কি কথা?

কুসুম সঙ্গে সঙ্গে বলল, ব্যাঙের মাখা।সুরুজ অকিয়ে আছে অবাক হয়ে। কুসুম বলল, আমার কথায় অবাক হইয়েন। আমি জ্বীনে ধরা মেয়ে। আমার কথাবার্তা কাজকর্মের ঠিকঠিকানা নাই।সুরুজ বিস্মিত হয়ে বলল, জ্বীনে ধরা? হুঁ। অনেক তাবিজাবিজ দিছে। তাবিজে কাজ হয় না। আফনে চিন্তা কইবেন, বিয়ার পরে জ্বীন থাকে না।কুসুম চৌকির উপর বসল। সহজ ভঙ্গিতেই বসল।

যেন অনেক দিনের চেনা মানুষের সঙ্গেই গল্প করতে বসেছে। পুষ্প পান নিয়ে এসে কুসুমের চোখের দিকে তাকাল। কুসুম বলল, থালাবাটি লইয়া ভিতরে যা পুষ্প, আমি আসতাছি।পুষ্প থালাবাটি নিয়ে চলে গেল। কুসুম সুরুজের দিকে পানদান এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আফনেরে সবের খুব পছন্দ হইছে। আমারও হইছে।সুরুজ খুক খুক করে কাল।কুসুম বলল, জ্বীনের কথা শুইন্যা ভয় পাইয়েন না। পুরুষ মানুষের ভয় ভাল জিনিশ না। আর জ্বীন তো আমারে রোজদিন ধরে না, মাঝে মইধ্যে ধরে।সুরুজ ক্ষীণ স্বরে বলল, তখন কি হয়?

এইসব আফনের শুইন্যা লাভ নাই। আমার যে বিয়া হয় না, এই কারণেই হয় না। কত সম্বন্ধ আইল, কত সম্বন্ধ ভাঙল। নেন, পান খান।কুসুম নিজেই পান এগিয়ে দিল। সুরুজ পান নিল ভয়ে ভয়ে। কুসুম বলল, এক রাইতে কি হইছে শুনেন–জ্বীনের আছর হইছে–নিশুঁত রাইত, আমি দরজা খুইল্যা বাইর হইছি। উপস্থিত হইছি মতি ভাইয়ের বাড়িতে। ছিঃ ছিঃ, কি কেলেঙ্কারি! মতি ভাই থাকে একলা। জোয়ান পুরুষ, সে দরজা খুইল্যা আমারে দেইখ্যা অবাক। আমার কথা শুইন্যা মনে কিছু নিয়েন না। আফনেরে আপন ভাইব্যা বলতেছি।

সুরুজ আবার কাশল। তার মুখ ভর্তি পান। কিন্তু সে পান চিবুতে পারছে না। কুসুম ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আফনে ঘুমান। রাইত মেলা হইছে।কুসুম ঘর থেকে বের হয়ে দেখল, অন্ধকারে দরজার ওপাশে পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে। সে থালাবাটি নিয়ে চলে যায়নি, নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল। পুষ্প নরম গলায় বলল, বুবু, তুমি নিজেই বিয়া ভাইঙ্গা দিলা! কুসুম বলল,। কাউরে কিছু বলিস না পুষ্প। আমি কাউরে কিছু বলব না, কিন্তুক সুরুজ ভাই বলব। বাপজানরে বলব।

না, সেও কিছু বলব না। কাউরে কিছু না বইলা পালাইয়া যাইব।উহুঁ।কুসুম তীক্ষ্ণ গলায় বলল, উহুঁ বলছস ক্যান? সুরুজ ভাই পালাইব না। তোমারে তার খুব মনে ধরছে। জ্বীন-ভূতের কথা বইল্যা তারে খেদাইতে পারবা না।ব্যথায় মনোয়ারা সারারাত কষ্ট পেলেন। মোবারক ফিরলেন মাঝরাতে—খালি হাতে। রাজবাড়ির মেয়ের লেখা ওষুধ নিন্দালিশ বাজারের ফার্মেসিতে পায় গেল না।

ভোরবেলা ব্যথা কমে গেল। মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলেন–কুসুমের বিয়ে হচ্ছে। চারদিকে বাদ্যবাজনা বাজছে। রাজবাড়ির মেয়েটা এসে কুসুমকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সে কালো একটা বাক্সভর্তি গয়না নিয়ে এসেছে। বাক্স থেকে গয়না নিয়ে একের পর এক পরিয়ে দিচ্ছে। পাথর বসানো কি সুন্দর ঝলমলে গয়না! নীতু বলল, সুখানপুকুর নামের মানে কি আপা?

শাহানা বলল, যে পুকুর শুকিয়ে গেছে সেই পুকুরই সুখানপুকুর।তাহলে তো বানান হওয়া উচিত তালিব্য শ দিয়ে… শাহানা বিরক্ত গলায় বলল, তোকে নিয়ে বের হবার প্রধান সমস্যা হল–তুই খুব তুচ্ছ জিনিশ নিয়ে জটিল তর্কে যেতে চাস।নীতু বলল, তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হবার প্রধান সমস্যা কি তুমি জান? না।প্রধান সমস্যা হল–সব সময় তোমার মুডের উপর লক্ষ্য রাখতে হয়। তোমার দিকে লক্ষ্য রেখে কথা বলতে হয়। মোহসিন ভাই তোমাকে বিয়ে করে কি ভয়ংকর বিপদে যে পড়বে তা সে জানে না।

জানিয়ে দিস।আসলেই জানানো উচিত। উনি এলেই প্রথম এই কথা বলব।শাহানা বিস্মিত হয়ে বলল, উনি এলেই মানে? সে আসছে না-কি? হুঁ।হুঁ মানে কি? পরিষ্কার করে বল।উনি আসছেন, মিতু আপা আসছে।কেন? দাদাজান তাদের আনার জন্যে নে কখন আসবে? আজ ভোরবেলা এসে পৌঁছানোর কথা। এই জন্যেই আমি তোমার সঙ্গে বের হতে চাইনি। তুমি জোর করে নিয়ে এলে।দাদাজান হঠাৎ ওদের নিয়ে আসছেন কি জন্যে?

সেটা দাদাজানই জানেন। সম্ভবত তোমাকে অবাক করে দিতে চান।আমাকে অবাক করবার তার দরকারটা কি? তোমাকে উনি খুবই পছন্দ করেন। আমরা যাদের পছন্দ করি তাদের অবাক করে দিতে আমাদের ভাল লাগে।শাহানা বিরক্ত বোধ করছে। মিতু আসছে আসুক। মিতুর সঙ্গে মোহসিন আসছে কেন? বিয়ের আগের সময়টা সে নিজের মত করে থাকতে চায়? নীতু বলল, তুমি মুখটা এমন কাল করে ফেললে কেন?

মোহসিন ভাই আসছে এতে তো তোমার আনন্দিত হবার কথা। এখন আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে তোমাকে ঘুরতে হবে না। তুমি। সঙ্গী পেয়ে গেলে।এত কথা বলিস না তো নীতু, মাথা ধরে যাচ্ছে।আচ্ছা আর কথা বলব না। এখন থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সাইন ল্যাংগুয়েজে জবাব দেব। আপা, তুমি কি সাইন ল্যাংগুয়েজ জান? আমি তোমাকে ভালবাসি এটা সাইন ল্যাংগুয়েজে কি ভাবে বলা হয়?

তুই চলে যা নীতু। আমি একা একা ঘুরব।চলে যাব? হ্যাঁ চলে যা। ওরা আসবে, ওদের জন্যে অপেক্ষা কর।তুমি বাড়ি ফিরবে কখন? দুপুরের আগেই ফিরব।ওরা যদি চলে আসে তোমাকে খবর পাঠাব? না।নীতু খুশি মনে চলে যাচ্ছে। শাহানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা খুব সুন্দর। ছোট্ট সুন্দর একটা দীঘি। গ্রামের দীঘির চারদিকে সাধারণত নারকেল গাছ কিংবা তালগাছ থাকে। এই দীঘিটার চারদিকে কদমগাছ। কদমফুল ফুটে আলো হয়ে আছে।

অপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু করা যায় না। খুব রুচিবান কোন মানুষ ভেবেচিন্তে গাছগুলি লাগিয়েছেন। কে সেই রুচিবান মানুষ? শাহানা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে কদমগাছ দেখছে। এই মুহূর্তে কেউ যদি তাকে বলে? পৃথিবীর সবচে সুন্দর ফুলের নাম কি? সে অবশ্যই বলবে–কদম।আম্মাজি! শাহানা চমকে তাকাল। বৃদ্ধ একজন মানুষ কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিনয়ে প্রায় নুয়ে পড়েছে। মুখে আনন্দের হাসি।কি দেখেন আম্মাজি?

কদমগাছ দেখি। দীঘির চারদিকে এমন সুন্দর করে কে কদমগাছ লাগিয়েছে বলতে পারেন? কেউ লাগায় নাই আম্মজি, আপনাআপনি হইছে? সত্যি? জ্বি।এই গ্রামে কি আরো দীঘি আছে? জি-না। একটাই দীঘি? দীঘিটার নাম কি? কোন নাম নাই আজি–আফনে একটা নাম দেন, আমরা হেই নামে ডাকব।আমি একটা নাম দিলেই সবাই এই নামে ডাকবে?

অবশ্যই ডাকব। এই গেরামের মানুষ যে আফনেরে কত ভাল পায় এইটা আফনে জানেন না।শাহানা লজ্জিত গলায় বলল, আমি তো আপনাদের জন্য তেমন কিছু করিনি। দশ বার জন রোগি দেখেছি। সেটা তো আমি দেখবই। আমি তো আপনাদের গ্রামেরই মেয়ে। ডাক্তার হয়েছি। রোগি দেখা তো আমার পেশা।আফনের রোগ দেখা আর অন্যের রোগি দেখার মইধ্যে আসমান-জমিন ফারাক আছে।

শাহানা হাসছে। সে এখনো তাকিয়ে আছে কদমগাছগুলির দিকে–ইস, কি সুন্দর ফুল! আম্মাজি, ফুল পাইরা দিব? না। গাছের ফুল গাছেই থাক। আচ্ছা ঠিক আছে, দিন তো কয়েকটা ফুল। আপনি তো গাছে উঠতে পারবেন না–ফুল পাড়বেন কি ভাবে? আম্মাজি, আমি পাইরা পাঠাইয়া দিমু। আচ্ছা?

শাহানা হাঁটছে। গ্রামের বৌ-ঝিদের কৌতূহলী দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছেন কিন্তু কেউ তাকে বিরক্ত করছে না। হাঁটতে হাঁটতে শাহানার মনে হল—এই গ্রামের মানুষগুলি এত হত দরিদ্র কেন? ঘরবাড়ির কি অবস্থা! আহা রে, একুটু কিছু যদি এই মানুষগুলির জন্যে করা যেত! একটা বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। ব্যাকুল হয়ে ফুঁখিয়ে ফুঁপিয়ে কে কাঁদছে। শাহানা থমকে দাঁড়াল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির ভেতর থেকে ঘোমটা দেয়া একজন বৃদ্ধ মহিলা বের হয়ে এলেন।

বৃদ্ধ গাঢ় আন্তরিকতার স্বরে বললেন, আমার বাড়ির সামনে আইস্যা দাঁড়াইছেন কি যে খুশি হইছি আম্মা।শাহানা বলল, কাঁদছে কে? আমার ছেলের বৌ কানতাছে আম্মা।কেন? আপনেরে দেইখ্যা কানতাছে।আমাকে দেখে কাঁদছে কেন? বউটার বড় ছেলেটা গত মাসে চাইর দিনের জ্বরে মারা গেছে। আম্মা, আপনেরে দেইখ্যা এই জন্যে কানতাছে। যদি এক মাস আগে আইতেন, ছেলেটা বাঁচত।

শাহানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বউটার হাহাকার সহ্য করা যায় না। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বিনিয়ে বিনিয়ে বলছে–আল্লাহ, রাজবাড়ির কন্যারে তুমি আইজ কেন পাঠাইলা? তুমি কেন এক মাস আগে পাঠাইলা না!… শাহানার চোখে পানি এসে গেল। আর জন্যে সে লজ্জিতও হল না। শাড়ির আঁচিলে চোখ মুছে বলল, আপনি আপনার বৌমাকে বুঝিয়ে বলবেন–জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহ ঠিক করে রাখেন। মানুঝের কিছুই করণীয় নেই।

শাহানা জানে সে ভুল কখা বলেছে। মানুষের অনেক কিছুই করণীয় আছে–মানুষের আছে রোগব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তিশালী সব হারিয়ার। মৃত্যুর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে মানুষ আজ উঁচু গলায় বলতে পারে–বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।বৃদ্ধা তুললে, মা, আপনি একটু ঘরে পা দিবেন না?

জ্বি-না। আপনার বউমার কান্না শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। দেখছেন না আমার নিজের চোখে পানি এসে গেছে।আম্মাগো, বড় খুশি হইছি, আপনি যে আমার বাড়ির সামনে দাঁড়াইছে–বড় খুশি হইছি। এখন কই যাইবেন আম্মা?কোথাও যাব না, পথে পথে হাঁটব।শাহানা কিছুক্ষণ পথে পথে হাঁটল–তারপর উপস্থিত হল মতির বাড়িতে।

মতির আবার জ্বর এসেছে। সে কুণ্ডলি পাকিয়ে নোংরা বিছানায় শুয়ে আছে। শাহানাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল।শাহানা বলল, আজ আমার মনটা খুব খারাপ। আপনি আমাকে একটা আনন্দের গান গেয়ে আমার মন ভাল করে দিল। আমি আমার গান শুনতে এসেছি।মতি লাল, আনন্দের গান শুইনা মনের দুঃখ দূর হয় না। মনের দূর করতে দুঃখের গান লাগে।

বে, একটা দুঃখের গান গান।

মতি সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল–

কে পরাইল আমার চউক্ষে কলংক কাজল?

কুসুম সকালে এসে মতির জ্বর দেখে গিয়েছিল।

সে এক বাটি সাগু নিয়ে ঘরে ঢুকে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখল–রাজবাড়ির মেয়ে চৌকিতে পা তুলে ধ্যানী মুর্তির মত বসে আছে। মতি মিয়া চোখ বন্ধ করে গলা ছেড়ে গাইছে–কে পরাইল আমার চউক্ষে কলংক কাজল।কুসুম কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।মোহসিন একাই এসেছে। তার চোখে সানগ্লাস, গায়ে হালকা নীল রঙের টি শার্ট।

পরনের প্যান্টের রঙ ধবধবে শাদা, পায়ের জুতা জোড়াও শাদা চামড়ার। সে বজরার ছাদে পাতা চেয়ারে বসে আছে।নীতু দেখতে পেয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নামছে। ঘাটের মাথায় ইরতাজুদ্দিন দাঁড়িয়ে। তিনি কৌতূহলী চোখে ছেলেটিকে দেখছেন। মানুষের সবচে বড় পরিচয় তার চোখে। ছেলেটি তার চোখ কালো চশমায় ঢেকে রেখেছে, তারপরেও ইরতাজুদ্দিন বললেন, বেশ ছেলে তো! নীতু লাফিয়ে বজরায় উঠে চেঁচিয়ে বলল, মিতু আপা কোথায়?

মোহসিন বলল, তোমার মিতু আপা আসেনি। আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাদের নিয়ে যাবার জন্যে।আপনি কেমন আছেন মোহসিন ভাই? ভাল আছি। তুমি কেমন আছ? আমি ভাল।তোমার আপা, সে কেমন আছে? খুব ভাল আছে। সমানে ডাক্তারি করে বেড়াচ্ছে।ঘাটে যে বুড়ো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই কি তোমার দাদা।হুঁ। দারুণ রাগী। নেমেই আপনি কিন্তু পা ছুঁয়ে উনাকে সালাম করবেন।আর কি করতে হবে?

সানগ্লাস খুলে ফেলুন। দাদাজন খুব প্রাচীন ধরনের মানুষ। সানগ্লাসকে তারা অভদ্রতা মনে করেন।ইরতাজুদ্দিন ছেলেটির ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। সে তার কাছে এসেই চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলেছে–নিচু হয়ে কদমবুসি করেছে। ইরতাজুদ্দিন স্পষ্ট গলায় বললেন, কেমন আছ মোহসিন? ভাল। খুব ভাল।রাস্তায় অসুবিধা হয়নি তো?

জ্বি-না। শুধু নৌকা যখন হাওড়ে পড়েছে তখন ভয় পেয়েছি। একেবারে সমুদ্রের মত ঢেউ।তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। বৃদ্ধ মানুষের নিমন্ত্রণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মিতু এল না কেন? ওর কি জানি একটা পরীক্ষা। ও ফ্রেঞ্চ শিখছে–তারই ডিপ্লোমা পরীক্ষা।বাঙালী মেয়ের ফ্রেঞ্চ শেখার দরকার কি? এখন ফ্রেঞ্চ শেখাটাই ফ্যাশন না-কি?

মোহসিন হাসল। বুড়ো ভদ্রলোককে যতটা প্রাচীনপন্থি বলে নীতু ভয় দেখিয়েছে ততটা বোধ হয় না।ইরতাজুদ্দিন বললেন, শহরে থেকে অভ্যাস, গ্রামের বাড়িঘর তোমার পছন্দ হবে কিনা কে জানে। এসো মোহসিন, এসো।বাড়ি দেখে মোহসিন হকচকিয়ে গেল। এ তো ছোটখাট প্যালেস। কাঠের এত বড় দোতলা বাড়ি বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি আছে কি-না তার সন্দেহ হল। নীতু তাকে। বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে–

এটা হচ্ছে নামাজঘর। ঐ যে ছোট্ট পাটিটা দেখছেন ঐ টা হাতীর দাঁতের পাটি। ঐ যে ব্ল্যাক দেখছেন–র্যাক ভর্তি কোরান শরীফ। এর মধ্যে একটা কোরান শরীফ আছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিজের হাতের লেখা।সত্যি? অবশ্যই সত্যি। আসুন আপনাকে লাইব্রেরি ঘর দেখাই। লইব্রেরি ঘরজেখলে আপনার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, এত বড় লাইব্রেরি কিন্তু বাচ্চাদের কোন বই নেই।

তোমার জন্যে তো দুঃখেরই। প্রতিদিন তিনটা করে বই নাপেড়লে তো তোমার ঘুম হয় না। ভাল কথা, শাহানা কোথায়? কে জানে কোথায়। ঘুরছে মনে হয়। কোথায় ঘুরছে? গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপার সুতিহঠন রোগ হয়েছে। সকালে নাশতা খেয়ে হাঁটতে বের হয়–দুপুরে আর্জে)প্রথম দিকে দাদাজান একা বেরুতে নিষেধ করেছিলেন। এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যার করে নেয়া হয়েছে।আসুন, লাইব্রেরিটা দেখবেন না?

খানিকক্ষণ পরে দেখলে কেমন হয় নীতু? খুব ক্লান্ত লাগছে–সাবান মেখে গোসল সেরে চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব। তারপর তুমি যা দেখাবে তাই দেখব। গোসলের জন্য কেউ কি আমাকে একটু গরম পানি করে দিতে পারবে? হ্যাঁ পারবে।আমি কোন ঘরে থাকব একটু দেখিয়ে দাও।আপনি থাকবেন দোতলায়। আসুন ঘর দেখিয়ে দেই।মিতু তোমার জন্যে গল্পের বই দিয়ে দিয়েছে, চকলেট দিয়ে দিয়েছে। গরমে চকলেট গলে গেছে বলে আমার ধারণা। চিঠি দেয়নি?

হ্যাঁ, চিঠিও দিয়েছে। এসো তোমাকে সব দিয়ে দিচ্ছি।আপনি কি গোসলের আগে চা খাবেন।শাহানার ক্ষত সেকেন্ডে সেকেন্ডে চা খাওয়ার অভ্যাস আম্মার নেই। আমি গোসল করেই শুয়ে পর। আঁটি বাঙালীর মত সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুব।সে কি। দুপুঝে খাবেন না।উহুঁ, ঠিক একনার সময় আম্মি সঙ্গে করে আনা স্যান্ডউইচ খেয়েছি, পনীর খেয়েছি, আপেল খেয়েছি। কাজেই আামার দুপুরের মিল অফ।

শুনালে দাদাজানোর খুব মন খারাপ হবে। আপনার কথা ভেবেই দাদাজান রাক্ষস সাইজের এক কাতালা মাছ এনেছেন।কোন উপায় নেই নীতু। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি কঠিন নিম্ম মেনে চলি। আমার উপর দায়িত্ব হল আমার দাদাজানকে এটা বুঝিয়ে বলা। কলতে পারবে না?

হুঁ পারব।তুমি খুব চমৎকার একটা মেয়ে নীতু। খ্যাংক য়্যু ফর অল দ্যা হেল্প।শাহানা বাড়িতে ফিরল দুপুর পার করে। তার জন্যে না খেয়ে ইরতাজুদ্দিন সাহেব এবং নীতু দুজনই অপেক্ষা করছিল। শাহানা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি কিছু খাব না দাদাজান। আপনারা খেয়ে নিন।ইরতাজুদ্দিন বললেন, খাবি না কেন?

ইচ্ছা করছে না।শরীর খারাপ করেনি তো? না, শরীর ভাল আছে।মুখ এত শুকনা লাগছে কেন? রোদে রোদে ঘুঝেছি এই জন্যেই মুশুকনা লাগছে।কিছুই খাবি না? না। তবে আপনার বিখ্যাত পেঁপে একটু খেতে পারি।নীতু বলল, তোমার জন্যে সুসংবাদ আছে আপা। মোহসিন ভাই এসেছেন। গোসল করে তাঁর ঘরে ঘুমুচ্ছেন। সন্ধ্যার আগে তাঁকে ডাকা যাবে না।মিতু আসেনি?

না, চিঠি পাঠিয়েছে। তোমার টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি।শাহানা তার নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। ইরতাজুদ্দিন লক্ষ্য করলেন, মোহসিন এসেছে এই সংবাদে তার নাতনীর চেহারায় কোন পরিবর্তন হয়নি। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ শুধু পড়েছে। বিরক্ত হলেই মানুষের কপালের চামড়া এভাবে কুঁচকে যায়। মেয়েটার কি কোন সমস্যা হয়েছে?

বাটি ভর্তি পেঁপে দিয়ে গেছে। পেঁপের সঙ্গে এক গ্লাস দুধ, এক গ্লাস পানি। শাহানা তার কোন কিছুই স্পর্শ করল না। সে মিতুর চিঠি পড়ছে। যে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সে পাঠ্যবই পড়ে ঠিক একই মনোযোগের সঙ্গে সে মিতু চিঠি পড়ছে। মিতুর হাতের লেখা কাঁচা। প্রচুর বানান ভুল–কিন্তু চিঠিটা খুব গোছানো—

আপা,

তোমার চিঠি সব মিলিয়ে দশবার পড়লাম। আর কয়েকবার পড়লে মুখস্থ হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। কাজেই ঠিক করেছি আর পড়ব না। তোমার চিঠির জবাব পরে দিচ্ছি, আগে জরুরী খবরগুলি দিয়ে নেই।জরুরী খবর নাম্বার ওয়ান–জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্টস এডভাইজার তোমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন।

তুমি ডরমিটরিতে থাকতে চাও না। নিজে বাসা ভাড়া করে থাকতে চাও তা তোমাকে অতি দ্রুত জানাতে বলেছেন।জরুরী খবর নাম্বার টু–তোমার অতি শখের তিনটি ক্যাকটাসই মারা গেছে। আমি তাদের বাঁচিয়ে রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। বলধা গার্ডেনের একজন এক্সপার্ট পর্যন্ত খবর দিয়ে এনেছি, লাভ হয়নি।জরুরী খবর নাম্বার থ্রি–আমাদের বাড়িতে দুতের উপদ্রপ হচ্ছে। আমার বাথরুমটার কল আপনাআপনি খুলে যায়। ছরছর করে পানি পড়ে।

মাঝে মাঝে মনে হয় পানি দিয়ে কে যেন হাত-মুখ ধুচ্ছে। তুমি তোমার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয়ই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে–আমি পারছি না। আমি ভয় পেয়ে বাড়ি ছেড়ে বর্তমানে ছোট মামার বাড়িতে আছি। ছোট মামীর কথাবলা রোগ আরে বেড়েছে। তিনি ক্রমাগত আমার কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে যাচ্ছেন। এখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভূতের বাড়িতে থাকাই ভাল ছিল। ভূতটা আর যাই করুক ক্রমাগত কথা বলে না। কল খুলে মাঝে মাঝে শুধু হাত-মুখ ধোয়।

যাই হোক আপা, এখন তোমার চিঠির জবাব দিচ্ছি। যদিও আমার জবাবের জন্য তুমি অপেক্ষা করছ বলে আমার মনে হয় না। তার প্রয়োজনও নেই। তোমার সমস্যা তুমি সবচে আগে টের পাবে এবং তোমার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সমস্যার সমাধান করবে এটা আমি জানি। তোমার সমস্যা তুমি আমাকে স্পষ্ট করে বলোনি।অনুমান করছি, তুমি জনৈক গ্রাম্য গায়কের প্রতি তীব্র দুর্বলতা পোষণ করছ।

দুর্বলতা গানের জন্য হলে সমস্যার কোন কারণ নেই–দুর্বলতা মানুষটির জন্যে হলে অবশ্যই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।আমার ধারণা গ্রামের পরিবেশ, প্রকাণ্ড হাওড়, শ্রাবণ মাসের আকাশের মেঘ এবং ঝর ঝর বৃষ্টি, দাদাজানের রূপকথার রাজা-বাদশার মত কাঠের বাড়ি–সব তোমার উপর একটা প্রভাব ফেলেছে। মনে উদ্ভট সব খেয়াল জাগছে। এসব খেয়ালকে প্রশ্রয় দেবার প্রশ্নই উঠে না। গ্রামের গায়ক গ্রামেই থাকুক–গান গাইতে থাকুক। তুমি চলে যাও তোমার নিজের জায়গায়।

মনের দেয়াল ভেঙে বৈপ্লবিক কিছু করে ফেলার চিন্তা মেয়েরা ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সে করে। ঐ বয়স তুমি পার হয়ে এসেছ।ঐ গায়কের গান শুনতে চাও খুব ভাল কথা, ক্যাস্টে ভর্তি করে গান নিয়ে এসো। যখন শুনতে ইচ্ছা করবে, শুনবে। তার জন্যে গায়ককে নিয়ে আসতে হবে কেন?আপা, আশা করি, আমার এই ধরনের রূঢ় কথা তোমাকে আহত করবে না। কথাগুলি রূঢ় হলেও সত্যি। সত্যকে গ্রহণ করার সাহস তোমার আছে।

মোহসিন ভাইকে বলতে গেলে আমি জোর করে পাঠিয়েছি। বেচারার এখানে অনেক কাজ ছিল। কাকতালীয়ভাবে উনি যেদিন সুখানপুকুর পৌঁছবেন সেদিন পূর্ণিমা। যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা খুব সুন্দর হবার কথা! তুমি অবশ্যই পূর্ণিমার রাতে মোহসিন ভাইকে নিয়ে ছাদে বসবে। অনেক রাত পর্যন্ত দুজন গল্প করবে।

চিঠি প্রায় শেষ। এখন শুধু জরুরী খবর নাম্বার ফোরটা বলি–তোমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে ২৭শে শ্রাবণ। কাজেই চলে এসো।

ইতি

মিতু

মোহসিন সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠল। নীতুই ঘুম থেকে তুলল–আর কত ঘুমুবেন? উঠুন, আপা আপনার সঙ্গে চা খাবে বলে চা না খেয়ে বসে আছে।ম্যারাথন ঘুম দিয়ে দিয়েছি, তাই না নীতু?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *