সম্রাট পর্ব – ৬ হুমায়ূন আহমেদ

সম্রাট পর্ব – ৬

পঞ্চাশ জনকে রিক্রুট করার দায়িত্ব পড়েছে বেন ওয়াটসনের ওপর। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল—পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে এবং বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভেতর হতে হবে। কিন্তু উৎসাহীদের বয়সের সীমা দেখা গেল সতের থেকে ষাটের মধ্যে এবং অনেকেরই কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। মাত্র একুশ দিনে এদের তৈরি করাও প্রায় অসম্ভব। জগতের অসম্ভব কাজগুলির প্রতি বেন ওয়াটসনের একটা ঝোঁক আছে।

রিক্রুটমেন্ট শুরু হল সকাল থেকে। একেক জন এসে ঢেকে আর বেন তার দিকে প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন কিছুই নয়। শুধু তাকিয়ে থাকা। যাদের পছন্দ হয়, তাদেরকে নিয়ে যায় মাঠে। সেখানে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয় এবং ড্রিল হয়। দ্বিতীয় বাছাইপর্বটি হয় সেখানে। সেটিই চূড়ান্ত বাছাই। নমুনা দেয়া যাক।

কী নাম? রিক ব্রেগার।বয়স? তেত্রিশ।মিশনে কেন যেতে চাও? টাকার জন্যে।শুধুই টাকার জন্যে? হ্যাঁ।অ্যাটেনশন। লেফট রাইট, লেফট। লেফট রাইট, লেফট। কুইক মার্চ। লেফট, লেফট। লেফট, লেফট। হল্ট। অ্যাবাউট টার্ন। স্ট্যান্ড এট ইজ। শুধুই টাকার জন্যে যেতে চাও? হ্যাঁ।টাকার এত প্রয়োজন কেন? ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, স্ত্রী আছে। পছন্দমতো কাজকর্ম পাচ্ছি না। নগদ কিছু টাকা। হলে ভালো হবে। গুড।

কোন সেকশন? আর্টিলারি। সিলেক্টেড। রাত আটটার মধ্যে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিপোর্ট করবে।ঠিক আছে, স্যার।যাবার আগে কন্ট্রাক্ট ফর্ম সই করবে। মারা গেলে টাকা কে পাবে, সে-দলিল দরকার।ঠিক আছে স্যার।ওকে, ক্লিয়ার আউট। নেক্সট।কি জন্যে যেতে চাও? অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে।শুধুই অ্যাডভেঞ্চার? হ্যাঁ।বয়স কত? একুশ।

হবে না, তুমি যেতে পার। এটা শিশুদের কোনো ব্যাপার নয়।আমাকে শিশু বলবেন না।বেন ওয়াটসন প্ৰচণ্ড একটি চড় কমিয়ে দিল। ছেলেটি প্রায় চার ফুট দূরে উল্টে পড়ল। বেন গম্ভীর গলায় বলল, বিদায় হও, কুইক।

তুমি কি আমেরিকান? না, আমি আমেরিকান নই।কেন যেতে চাও? (উত্তর নেই) কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে? নেই।আমরা তো বলে দিয়েছি পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে, এমন সব প্রাণীদেরই আমরা চাই।আমি দ্রুত শিখতে পারি।কী করবে টাকা দিয়ে? ব্যবসা করব।তুমি যেতে পার। তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি সংসারী মানুষ। সংসারী মানুষ। সাহসী হয় না।আমি সাহসী।

তা ঠিক। তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি সাহসী। কিন্তু বিপদের সময়। তোমার সাহস থাকবে না। ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়বে। তুমি যেতে পার। নেক্সট।লেফট রাইট। লেফট রাইট। কুইক মার্চ। ঐ বার্চ গাছ ছুঁয়ে আবার ফিরে এস। কুইক মার্চ। ডাবল। ডাবল। ভেরি গুড। হল্ট। মার্চ এগেইন লং স্টেপ। লং স্টেপ। হল্ট। বয়স কত?

চল্লিশ।মিশনে যেতে চাও কেন? টাকার জন্যে।কী করবে টাকা দিয়ে? জানি না স্যার। এখনো ভাবি নি।ঘরে কে আছে? স্ত্ৰী আছে।মিশনে তুমি মারা যেতে পার। জান তো? জানি।তোমার স্ত্রী তোমাকে ছাড়তে রাজি হবে? তার সঙ্গে আমার বনিবনা নেই।অ্যাটেনশন। লেফট রাইট, লেফট রাইট। অ্যাবাউট টার্ন। কুইক মার্চ। ঐ বার্চ গাছ। ছুঁয়ে আবার এস। আমি তোমার দম দেখতে চাই। ওকে, হল্ট। দম ভালোই আছে। আগে – কোথায় ছিলে?

ইউএস ম্যারিন।তোমার দেশের নাম কি? মালদ্বীপ।নাম শুনি নি।আপনি না শুনলে কিছু যায়-আসে না।কুইক মার্চ। হল্ট। লেফট রাইট লেফট। লেফট লেফট লেফট। হল্ট। ডবল মার্চ। লেফট লেফট, লেফট। হল্ট।তোমার কি নাম? আবদুল জলিল।মিঃ জলিল, তোমার একেবারেই দম নেই।আমাকে একটা সুযোগ দিন।কেন, সুযোগ দেব কেন? টাকার দরকার? হ্যাঁ।

নিজের জন্যে? না, নিজের জন্যে নয়।অ্যাটেনশন। লেফট রাইট লেফট। লেফট রাইট লেফট। হল্ট। তুমি কি সাহসী? হ্যাঁ।কী করে বুঝলে? (নিচুপ)।কখনো মানুষ খুন করেছ? না।খুন করতে পারবে? (নিচুপ) টাকাটা দিয়ে কী করবে, বলতে চাও না? না।

ঠিক আছে, তোমাকে রিক্রুট করা হল। সন্ধে আটটার ভেতর রিপোর্ট করবে। যাও।পঞ্চাশ জনকে নেবার কথা, বাছাই করা হল সত্তর জনকে। বেন ওয়াটসনের ধারণা ট্রেনিংপর্বে কিছু বাদ পড়বে। আঘাতজনিত কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে অনেককে বাদ দিতে হবে। কয়েকটি মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয়।রাত আটটা। সত্তর জন সদস্যের চুক্তিপত্রে সই করা হয়ে গেছে।

এরা বসে আছে মস্ত একটি হলঘরে। সমস্ত দিনের ধকলে সবাই কিছুটা ক্লান্ত এবং উত্তেজিত। অনিশ্চয়তার একটি ব্যাপার আছে। অনিশ্চয়তা মানুষকে দুর্বল করে দেয়।হাতি ফকনার ঘরে ঢুকল নটা পনেরয়। এর চেহারায় এমন কিছু আছে, যা দেখলে ভরসা পাওয়া যায়।হ্যালো, আমি ফকনার, তোমাদের মধ্যে কেউ-কেউ হয়তো আমাকে চেন।

কি, চেন না? কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এক জন রিক্রুট শুধু দাঁত বের করে হাসল। সম্ভবত সে চেনে।আমি ছোট্ট একটা বক্তৃতা দেব। কারণ, বক্তৃতার ব্যাপারটি আমার পছন্দ নয়। তোমাদেরও সম্ভবত নয়। এটা অলস মানুষদের একটা শখের ব্যাপার।মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল। নড়েচড়ে বসল অনেকেই।আগামীকাল সকাল দশটায় আমরা চলে যাব ট্রেনিং-গ্রাউন্ডে।

সেই ট্রেনিংগ্রাউন্ডটি কোথায় তা জানার দরকার নেই। যেটা জানা দরকার সেটা হচ্ছে, ট্রেনিং দেবে কে? যিনি ট্রেনিং দেবেন তাঁর নাম এন্ড্রু জনাথন। কমান্ডো ট্রেনিং-এ তাঁর মতো যোগ্য ব্যক্তি দ্বিতীয় কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। তোমরা নিজেরাও তা বুঝতে পারবে। ট্রেনিংয়ের দ্বিতীয় পর্যায় পরিচালনা করবেন রবিনসন। তাঁর ট্রেনিং এড়ু জনাথনের ট্রেনিংয়ের মতো ভয়াবহ হবার কথা নয়।

সবাই নড়েচড়ে বসল।আমার এরচে বেশি কিছু বলার নেই। তোমাদের কারো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? এক জন উঠে দাঁড়াল।বল, কি জানতে চাও।মিশনটি সম্পর্কে জানতে চাই।সে-সম্পর্কে যথাসময়ে জানা যাবে। জানার সময় এখনো হয় নি। আর কিছু?পারিশ্রমিকের অর্ধেক শুরুতেই দেবার কথা বলা হয়েছিল।শুরুতেই দেওয়া হবে। যারা ট্রেনিং শেষ করতে পারবে, তাদেরকে পারিশ্রমিকের টাকার অর্ধেক দিয়ে দেওয়া হবে।

এখন নয়। আর কিছু বলার আছে? সবাই চুপ করে রইল।আজ রাতটা তোমরা নিজেদের মতো কাটাতে পার। এ-শহরে বেশ কিছু সুন্দরী মেয়ে আছে। রাত কাটানোর জন্যে এদের সঙ্গিনী হিসেবে পাবার চেষ্টা করতে পার। কিছুভালোনাইট ক্লাবও আছে। অনেক রকম আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা আছে সেখানে। শুধু একটা জিনিস মনে রাখবে—এখানে রিপোর্ট করতে হবে আগামীকাল সকাল আটটায়।

এক জন উঠে দাঁড়াল। বেশ উঁচু স্বরে বলল, যাদের আমোদ-প্রমোদে যাবার মতো টাকা নেই, তারা কী করবে? বেন ওয়াটসন শান্ত স্বরে বলল, সবার জন্যে আজ একটি বিশেষ অ্যালাউন্স-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ রাতের জন্যে সবাইকে নগদ দু শ ডলার করে দেওয়া হবে।প্রচন্ড তালি পড়ল। কয়েক জন একসঙ্গে শিস দিতে শুরু করল।

যে-অস্থিরতা ও উত্তেজনা এতক্ষণ চাপা ছিল তা কেটে যেতে শুরু করেছে। ফকনার মৃদু হাসল। কজন এদের ভেতর থেকে ফিরে আসবে? মনে করা যাক, সব ঘড়ির কাঁটার মতো হবে। ফোর্টনক থেকে বের করে আনা হবে নিশোকে। যথাসময়ে ওদের নেবার জন্যে আসবে ট্রান্সপোর্ট প্লেন।

তবুও ক জন ফিরবে? আজ রাতটি কি অনেকের জন্যেই শেষ স্বাধীন রাত নয়? এটা হয়তো তারও শেষ রাত। ফকনার উঠে গিয়ে টেলিফোনের ডায়ার ঘোরাল।হ্যালো। লিজা ব্রাউন? কে? চিনতে পারছ না? লিজা ইতস্তত করে বলল, ফকনার? হ্যাঁ, ফকনার। লিজা, পার্লারে কতক্ষণ থাকবে? রাত এগারটায় বন্ধ হবে।তুমি কি ডিনার খেয়ে নিয়েছ? না, কিছুক্ষণের মধ্যেই খাব।একটা কাজ করলে কেমন হয় লিজা।

কোনট-একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যদি আমরা ডিনার খাই, তাহলে কেমন হয়? লিজা কিছু বলল না। ফকনার বলল, আজ আমার জন্মদিন।তাই নাকি? হ্যাঁ।লিজা হেসে ফেলল।হাসছ কেন? প্রথম যেদিন তুমি আমাকে বাইরে খেতে বললে, সেদিনও বলেছিলে—আজ আমার জন্মদিন।তাই বুঝি? হ্যাঁ। অবশ্যি আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, এটা মিথ্যা কথা।বুঝতে পেরেছিলে? হ্যাঁ।

মেয়েরা অনেক জিনিস বুঝতে পারে।আর কী বুঝতে পেরেছিলে? বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমাকে বাইরে খাওয়াতে চাচ্ছ ঠিকই, কিন্তু তোমার হাতে বেশি পয়সা নেই। কাজেই তুমি আমাকে নিয়ে যাবে খুব সস্তা ধরনের কোনো জায়গায়, এবং মেনু দেখে খুব সস্তা কোনো খাবারের অর্ডার দেবে।

তাই দিয়েছিলাম, না? হা। আজও কি সেরকম হবে? ফকনার হেসে ফেলল, তোমার বুঝি খুব ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে ইচ্ছা করে? হ্যাঁ। আমার ইচ্ছা করে ফারপোতে ডিনার খেতে। সেখানে ডিনারের মাঝখানে অর্কেস্ট্রা বাজারে আমার প্রিয় গান-ব্লু দানিয়ুব।আর কি? এই, আর কিছু না।তুমি তৈরি থাক, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।ফকনার ফারপোতে দুটি সিট রিজার্ভ করল।

অর্কেস্ট্রাকে বলল, র দানিয়ুব-এই গানটি বাজাতে হবে। ফ্লাওয়ার শপে টেলিফোন করে বলল, আগামী এক মাস প্রতি দিন দুটি করে লাল গোলাপ লিজা ব্রাউনের নামে পাঠাতে হবে। কে পাঠাচ্ছে, সেসব কিছুই বলা যাবে না। ঠিকানা হচ্ছে ফার্গো পিজা পার্লার নর্থ অ্যাভি। লিজার বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলে ভালো হত। ফকনারের ঠিকানা জানা নেই।

ট্রেনিং ক্যাম্প।লরেনকো মারকুইস।মোজাম্বিক, আফ্রিকা।১৫ই ডিসেম্বর। মঙ্গলবার।ভোর ৫-৩০।

বাহাত্তর জন সদস্য খোলা মাঠে অপেক্ষা করছে। সূর্য ওঠার অপেক্ষা। হার্ডি ফকনার তাদের প্রথম কিছু বলবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনজাতীয় কিছু হয়তো। দলের সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, তারা নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথাবার্তা বলছে। এদের দাঁড় করানো হয়েছে পাঁচটি ভাগে।

বার জনের একটি রিজার্ভ দলও আছে।তারা দাঁড়িয়ে আছে প্ৰকাণ্ড একটি ভোলা মাঠের মাঝামাঝি জায়গায়। মাঠটির চারপাশে ঘনবন।পূর্বদিক থেকে হাড়-কাঁপানো শীতল হাওয়া বইছে। সূর্য উঠে গেছে। বনের আড়ালে থাকায় তার আলো এসে এখনো পৌঁছচ্ছে না।দলের সবাই নড়েচড়ে উঠল। তাঁবুর ভেতর থেকে হাতি ফকনার বের হয়ে।

আসছে। তার মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাদা টুপি। রঙিন একটি হাওয়াই শার্ট। গলায় লাল রঙের স্কার্ফজাতীয় কিছু।কি, কেমন আছ তোমরা? কেউ কোনো জবাব দিল না।শীতের প্রকোপটা মনে হয় একটু বেশি। আফ্রিকা একটি অদ্ভুত জায়গা। দিনের বেলা প্রচন্ড গরম, রাতে শীত, তাই না? ঠিক বলেছেন স্যার।

আমি সবসময় ঠিকই বলি। এখন কাজের কথায় আসা যাক। তোমাদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে যে-আছে, তার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। তার নাম এড়ু জনাথন। জনাথন, একটু এদিকে এস। তোমার হাসিমুখ ওদের দেখিয়ে দাও।জনাথন এগিয়ে এল। তার মুখ হাসিমুখ নয়।

এই ছোটখাটো মানুষটির নাম এন্ড্রু জনাথন। এর সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। তোমরা নিজেরা আজ দিনের মধ্যেই তার সম্পর্কে জানবে। হা-হা-হা। আমার নিজের ট্রেনিংও এই লোকের কাছে। সে ছিল ইউএস ম্যারিনের RSM. এখানে যারা পুরোনো লোক আছে, তারা তাকে চিনবে। আমরা তাকে ডাকতাম ইয়েললা জাগুয়ার।

দলটির মধ্যে চাপা ধরনের কথাবার্তা বাড়তেই থাকল। ফকনার সেদিকে কোন কান না-দিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগল, লাঞ্চের আগ পর্যন্ত হবে ড্ৰিল। লাঞ্চের পর অস্ত্রের ট্রেনিং। ঠিক আছে? এখন বাজছে—পাঁচটা চল্লিশ। এই ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ ভোর পাঁচটা চল্লিশে আমি তোমাদের তুলে দিচ্ছি জনাথনের হাতে। যথাসময়ে আমি আবার নিজের হাতে তোমাদের নেব। গুড লাক।

ফকনার এগিয়ে এসে প্রত্যেকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল, দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্নও করল, যেমনকি, চোখ লাল কেন? রাতে ঘুম ভালো হয় নি? বাহ্, তোমার হাত দেখি মেয়েমানুষদের মতো নরম। এত নরম হাতে কি রাইফেল মানায়? তোমার হাতে থাকা উচিত ফুল। কি, ঠিক বললাম না? ফকনারের সঙ্গে-সঙ্গে বেন ওয়াটসন এবং রবিনসনও মাঠ ছেড়ে গেল।

সূর্য উঠে। এসেছে। এন্ড্রু জনাথন শুধু দাঁড়িয়ে আছে। জনাথনের কোমরে একটি লুগার টুয়েন্টিওয়ান পিস্তল। গায়ে গলাকাটা গেঞ্জি। গলায় ফুটবল রেফারিদের বাঁশি। সে বাঁশিতে তীব্র ফুঁ দিয়ে আচমকা সবাইকে চমকে দিল।অ্যাটেনশন। তোমাদের অনেকেই দেখি দাড়ি-গোঁফ এবং লম্বা-লম্বা চুল। আজ দিনের মধ্যেই এ-সব বাড়তি ঝামেলা থেকে নিজেদের মুক্ত করবে।

তোমাদের কারোকারো মুখে একটু বাঁকা হাসি দেখতে পাচ্ছি। কারণ, তোমরা নিজেদের খুব শক্ত মানুষ ভাবছ এবং চোখের সামনে এক জন ছোটখাটো মানুষকে দেখছ। তবে সুখের কথা, তোমরা অনেকেই আমাকে চেন। আগে পরিচয় হয়েছে। যারা চেন না তাদের বলছি, একজন মানুষকে একটি রাইফেলের চেয়েও বড় হবার কোনো প্রয়োজন নেই।

তোমরা কেউ যদি আমার কথার অবাধ্যতা কর, আমি তৎক্ষণাৎ গুলি করে পথের কুকুরের মতো মারব। আমার কোমরে যে-বস্তুটি দেখছ, তার নাম লুগার টুয়েন্টিওয়ান। মানুষের মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করে না। তোমাদের চেয়েও অনেক অনেক ভালোমানুষকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখেছি। কাজেই আমি যখন বলব, লাফ দাও লাফ দেবে।

তোমার সামনে খাদ আছে কি নেই সে-সব দেখবে না। পরিষ্কার হয়েছে? কেউ কোনো জবাব দিল না।গুলি করে মারার কথাটা আমার মনে হয় অনেকেই বিশ্বাস করছ না। তোমাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, এখানে আইন-আদালত বলে কিছু নেই। আমি এড়ু জনাথন-আমিই আইন। আমার এই ছোট পিস্তলটি হচ্ছে আদালত।সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।কারোর কিছু বলার আছে? কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

এস, এখন আমি দেখব, তোমাদের শারীরিক ফিটনেস কোন পর্যায়ে আছে। আমি বাঁশি বাজাবার সঙ্গে-সঙ্গে দশ কদম হাঁটবে, তারপর পঞ্চাশ কদম দৌড়াবে, তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে। সঙ্গে-সঙ্গে উঠেদাঁড়াবে। দৌড়াবে। আবার শোবে। যতক্ষণ-না আমি থামতে বলব, এটা চলতে থাকবে। শুরু করা যাক।

তীক্ষ্ণ শব্দে হুইসেল বাজল।সাড়ে ছটার মধ্যে সব এলোমেললা হয়ে যেতে শুরু করল। শুয়ে পড়বার পর উঠতে সময় লাগতে লাগল। পঞ্চাশ কদম দৌড়ে যাবার কথা। অনেকেই অল্প কিছুদূর গিয়েই বসে পড়তে শুরু করল। সবাই ঘামছে। চোখের মণি ছোট হয়ে আসছে। ঠোট গেছে শুকিয়ে। জনাথন এগিয়ে গেল। কড়া গলায় বলল, এই যে নীলশার্ট, তুমি শুয়ে আছ কেন? উঠে দাঁড়াও

আমার ওঠার ক্ষমতা নেই স্যার।উঠে দাঁড়াও, নয়তো লাথি বসিয়ে ওঠাব।স্যার, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।দেখা যাক, সম্ভব কি সম্ভব নয়।

জনাথন অতিদ্রুত দুটি গুলি করল। শুয়ে থাকা নীল শার্ট পরা লোকটির মাথায় চুল ঘেষে গেল একটি, অন্যটি তার চেয়ে এক ইঞ্চি উপরে। সে লাফিয়ে উঠল।গুড। দৌড়াও, শুয়ে পড়। আবার উঠে দাঁড়াও হাঁট দশ কদম। দৌড়াও।সকাল আটটার দিকে অনেকেই বমি করতে শুরু করল। দৌড়ানোর ক্ষমতা রইল না অনেকেরই। জনাথন শীতল স্বরে বলল, স্কোয়াড হল্টা নাশতার জন্যে আধ ঘন্টার ব্রেক দেওয়া হল।

আধ ঘন্টা পর শুরু হবে ফুট ড্রিল। ডিসমিস। আধ ঘন্টা পর সবাইকে এখানে চাই।ফুট ড্রিলের ব্যাপারে জনাথনের বরাবরই দুর্বলতা আছে। সে মনে করে, দশ মিনিট ফুট ড্রিল দেখেই বলে দেওয়া যায় কে সত্যিকার সৈনিক, কে নয়। তা ছাড়া ফুট ড্রিল সৈনিকদের হুকুম তামিল করতে শেখায়। এবং একসময় তাদের রক্তে মিশে যায়, যা করতে বলা হবে তা করতে হবে। এর অন্য কোন বিকল্প নেই।

 

Read more

সম্রাট পর্ব – ৭ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *