সাজঘর (পর্ব-২১): হুমায়ূন আহমেদ

রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রিহার্সেল হলফুল রিহার্সেল, প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্যবজলু সাহেব হৃষ্ট চিত্তে বললেন, জিনিস মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে গেছেতােমাদের কী ধারণা

সাজঘরপ্রণব বাবু বললেন, শেষ দৃশ্য আমার কাছে একটু লাউড় মনে হয়েছে‘ 

লাউড তাে বটেইএটার প্রয়ােজন আছেআর কারাে কোনাে কথা আছে? থাকলে বলফ্রি ডিসকাশন হােকআমার মন বলছে, একটা ভালাে জিনিস দাঁড়া 

হয়েছেতবে আমার ধারণা, থার্ড সিন স্লো হয়েছে। 

থার্ভ সিন তাে স্লোই হবে। 

এতটা হবে না। ডেলিভারিতে এতটা সময় খাওয়ার কিছু নেইএক জন স্লো করবে, এক জন করবে ফাস্টদুজনই স্লো করলে হবে নাভেরিয়েশন দরকার। 

আমার মতে বার্ড সিন ঠিকই আছে| অন্য সবারও কি তাই মত? যদি তাই হয়, তাহলে দয়া করে এখনই বলেনআমি কোনাে রকম খুঁত রাখতে চাই না‘ 

মজনু চা নিয়ে এল। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বজলু সাহেব বললেন, জিনিস দাঁড়িয়েছে কেমন, বল তাে মজনু। 

মজনু দাঁত বের করে বলল, ফাটাফাটি জিনিস হইছেসত্যি বলছিস? সত্যি না বললে আমি বাপের ঘরের না‘ 

বজলু সাহেব আরামের একটা নিঃশ্বাস ফেললেনযেন মজনুর কথায় তিনি খুবঔরসা পেলেন। 

আসিফের বাসায় ফিরতে রাত এগারটা বেজে গেলদরজার বেল টিপতেই লীনা এসে দরজা খুলে দিল। 

আসিফ হতভম্ব হয়ে বলল, কী ব্যাপার? লীনা হাসি মুখে বলল, কোনাে ব্যাপার নাযেতে ইচ্ছা করল নাযেতে ইচ্ছা করল না মানে? ওরা চলে গেছেন? ‘ামা, দুলাভাই খুব রাগারাগি করছিলযাও নি কেন? ঘরে আস, তারপর বলি‘ 

আসিফ ঘরে ঢুকলতার বিস্ময় এখনাে পুরােপুরি কাটে নিলীনা বলল, আমাকে দেখে খুশি হয়েছ

তুমি যাও নি কেন সেটা আগে শুনি। 

এয়ারপাের্টে যাবার পর হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেলমনে হল একা একা বাসায় ফিরবেএকা একা শুয়ে থাকবেমনে হতেই চোখে পানি এসে গেলতারপর চলে এলাম। 

এইসব কী পাগলামী লীনাতুমি কি আমাকে দেখে খুশি হও নি

হয়েছিকতটুক খুশি হয়েছ? অনেকখানিতাহলে তুমি এখনাে আমাকে জড়িয়ে ধরছ না কেন

আসিফ গভীর আবেগে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল। 

লীনা গাঢ় স্বরে বলল, আজ সারাদিন আমার কী মনে হচ্ছিল জান? মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে ভালবাস নাতােমার ভালবাসার মধ্যে অনেকখানি অভিনয় আছে। 

এখনাে কি সে রকম মনে হচ্ছে? না। 

সারারাত দুজন জেগে রইলকত অর্থহীন কথা, কত অর্থহীন হাসিবারবার লীনার চোখে পানি আসছে, সেই পানি মুছে সে হাসছে। 

আসিফ বলল, একটা গান কর না লীনালীনা শব্দ করে হাসলহাসতে হাসতে বলল, আমার গান হয় নাকি

এক সময় তাে গুনগুন করতেএখনাে না হয় কর‘ 

মাঝেমাঝে কী মনে হয় জান? কী মনে হয়

মনে হয় অভিনয় না করে গান করলে পারতামগানের দিকে আমার ঝোঁক ছিলতােমার জন্যে অভিনয়ে চলে এলাম। 

তােমার কি মনে হয় ভুল করেছ? লীনা তার জবাব না দিয়ে বলল, সত্যি গান শুনতে চাও, গাইব?গাওমাত্র চার লাইন কিন্তুগান চার লাইনেই ভালাে। 

লীনামৃদুস্বরে গাইলচরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারেচার লাইন পর্যন্ত যেতেই পারল নাকেঁদে কেটে অস্থির হলআসিফ বলল, কাঁদছ কেন

জানি না কেন? আমার প্রায়ই কাঁদতে ইচ্ছে করেতােমার করে না

আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা হঠাৎ করে বলল, আমি না যাওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ তাে?‘ 

একবার তাে বললাম, খুশি হয়েছি‘ 

আরেকবার বলখুশি হয়েছিখুব খুশি হয়েছি। 

না যাবার আরেকটা কারণও আছেএটা তােমাকে বলি নি, কারণ তােমার মনটা খারাপ হবে। 

মন খারাপ হবে নাতুমি বল। 

মাসের সতের তারিখে আমাদের বড় মেয়ের মৃত্যুদিনএই দিনে আমরা দুজন দুজায়গায় থাকব, তা কী করে হয়

না, তা হয় না‘ 

দিন আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে সারাক্ষণ পাশাপাশি বসে থাকব। 

লীনা চোখের পানি মুছে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার মাঝেমাঝে কী মনে হয় জান? আমরা যদি আমাদের জীবনের সবচে প্রিয় জিনিস ছেড়ে দিই, তাহলে হয়ত আমাদের এবারের বাচ্চাটা বেঁচে যাবেএক ধরনের সেক্রিফাইসআমার এই কথায় তুমি কি কিছু মনে করলে

দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে আসিফ বলল, না, কিছু মনে করি নিএটা একটা কথার কথা। 

কথার কথা কেন হবে? তােমার মনের মধ্যে এটা আছেআছে না?লীনা চুপ 

করে রইল। 

আসিফ বলল, বড় তৃষ্ণা পেয়েছেএক গ্লাস পানি খাওয়াবে

লীনা বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বালালআর তখনি ওয়ারড্রোবের মাথায় রাখা ছবির ফ্রেম দুটির দিকে আসিফের চোখ পড়ললােপা এবং পার বাঁধন ছবি। ট্রাঙ্কেতালাবদ্ধ থাকেকখনাে বের করা হয় নাআজ বের করা হয়েছে। 

লীনা ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, সতের তারিখের পর আবার লুকিয়ে ফেলব। 

আসিফ বলল, লুকিয়ে ফেলার দরকার কি, থাকুকতুমি যাও, পানি নিয়ে এস। 

আসিফ তাকিয়ে রইল ছবি দুটির দিকেআহ্, কী সুন্দর দুই মামণিএক জন আবার রাগ করে ঠোট উন্টে আছেঅন্যজন কেমন চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেযেন পৃথিবীর রহসা দেখে তার বিস্ময়ের সীমা নেই। 

আসিফের বুক জ্বালা করতে লাগলছবি দুটির দিকে তাকালেই তার অসহ্য কষ্ট হয়সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ত্রপা, ত্রপা মামণিকেমন আছ গাে

ত্রপা জবাব দিল না, জবাব দিল লীনাসে স্নিগ্ধ গলায় বলল, পানি নাও। 

আসিফ এক চুমুকে পানি শেষ করে সহজ গলায় বলল, আমি আর অভিনয় করব না লীনাতােমাকে কথা দিচ্ছিবাতি নিভিয়ে দাও, চোখে আলাে লাগছে। 

তুমি কি আমার উপর রাগ করলে

না লীনারাগ করি নিআমি একটা কথার কথা বললামবাতি নিভিয়ে দাও লীনাবাতি নিভিয়ে দাওলীনা বাতি নিভিয়ে দিল। 

আসিফদের শাে হল নাশােএর দিন আসিফ এবং লীনা ছাড়া দলের সবাই একত্রিত হলমজল বারান্দায় চায়ের কেতলি বসিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলবজলু সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, কেউ গিয়ে চড় দিয়ে গাধাটাকে থামাও তে, অসহ্য! বলতে বলতে তিনি নিজেও কেঁদে ফেললেনএবং কাঁদলেন শিশুদের মতােশব্দ করেতাঁকে ঘিরে মূর্তির মতাে সবাই বসে রইল

কেউ একটি শব্দও করল নাশুধু পুষ্পকে দেখে মনে হল, যে কোনাে মুহূর্তে এই মেয়েটি ভেঙে পড়বেতবে সে ভেঙে পড়ল না। সাজঘরের এক কোণায় চুপচাপ বসে রইলবজলু সা েযখন বললেন, খামােখা বসে আছে কেন সবাই? যাও, বাসায় চলে যাওতখনি শুধু তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলকেউ এসে সান্ত্বনার হাত তার মাথায় রাখল না। 

কিছুদিন পরই থিয়েটারের এই দলটি নতুন নাটকের মহড়া শুরু করলনাটকের নামহলুদ নদী, সবুজ বনমজনু আবার তার জায়াে সাইজের কেতলিতে চায়ের পানি বসিয়ে দিলজলিল সাহেব জমিয়ে আদিরসের গল্প শুরু করলেন

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *