সাজঘর (পর্ব-৩): হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ বলল, এক কাপ চা খেয়ে নিই বজলু ভাইখুব টায়ার্ড ফিল করছি। 

এক চুমুকে চা শেষ করকুইকসাতদিন পর শশা, অথচ এখনাে একটা দিনফুল রিহার্সেল দিতে পারলাম না‘ 

সাজঘরলীনা ভেবেছিল আসিফ চায়ের পেয়ালা হাতে তার পাশে এসে দাঁড়াবেটুকটাক কিছু কথাবার্তা বলবেতা সে করল নাচায়ের কাপ হাতে প্রণবকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলআসিফ নিজের বাসার বাইরে এলে স্ত্রীর সঙ্গে কেমন যেন আলগা একটা ব্যবহার করেযেন সে লজ্জা পায়। 

পুষ্প বলল, চায়ের কাপ হাতে বারান্দার দিকে যে গেলেন, উনি কি এই নাটকের নায়ক

লীনা হেসে বলল, তার চেহারাটা কি তােমার কাছে নায়কের মতাে মনে হল

না, তা না। 

হ্যা, নায়কনাটকের শুরুটা বলি, তােমার ভালাে লাগবেএকজন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাস থেকে নাটক করাগল্পটা খুব চমৎকারশুনতে চাও

হ্যা চাই। 

এই নাটকের নায়ক হচ্ছেন একজন লেখকনতুন বিয়ে করেছেনস্ত্রীর দিকে 

তার যতটা সময় দেয়া দরকার ততটা দিতে পারছেন নারাত দশটার পর উনি লেখার খাতা নিয়ে বসেনস্ত্রী বেচারী একা একা শুয়ে থাকেমেয়েটির বয়স খুব কম, এই ধর আঠার উনিশতার খুব ইচ্ছে করে স্বামীর সঙ্গে রাত জেগে গল্প করতেস্বামী বেচারা তা বুঝতে পারে নাসে তার উপন্যাস নিয়ে ব্যস্তঘটনাটা শুরু হয়েছে এক রাতেস্বামী লিখছেহঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হলইলেকট্রিসিটি চলে গেললেখকের স্ত্রী একটা জ্বলন্ত মােমবাতি হাতে বসার ঘরে ঢুকল। 

লেখকের নাম কি? | পুরাে নাটকে লেখকের কোনাে নাম নেইতাকে সব সময় লেখক বলা হয়েছে, তবে লেখকের স্ত্রীর নাম হচ্ছে জরী। 

আপনি হচ্ছেন লেখকের স্ত্রী, তাই না? হ্যাকী করে বুঝলে?আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল। 

নাটক শুরু হল। স্টেজের এক প্রান্তে লেখার টেবিল। চেয়ারে পা তুলে আসিফ বসে আছেবজলু সাহেব বললেন, চেয়ারে পা তুলে বসেছ কেন? এটা কী রকম বসা

আসিফ বলল, ঘরােয়া ভাবে বসেছি বজলু ভাইখুব রিলাক্সড হয়ে বসাপা নামিয়ে ঠিকঠাক মতাে বসলে ফর্মাল একটা ভাব চলে আসে। 

দেখতে ভালাে লাগছে নাদেখতে ভালাে লাগার একটা ব্যাপার আছেদর্শক হিসাবে জিনিসটা দেখতে ভালাে লাগতে হবেতােমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি...

বজলু সাহেব কথা শেষ করলেন নাআসিফ বলল, বজলু ভাই আমি চাচ্ছি যেন আমাকে ভালাে না লাগেলেখকের সর্ব কাণ্ডকারখানায় তার স্ত্রী যেমন বিরক্ত আমি চাই দর্শকরাও যেন ঠিক তেমনি ভাবে বিরক্ত হয়‘ 

বুজলু সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি পা নামিয়ে বসআসিফ পা নামালবা হাতে মাথা হেলান দিয়ে লিখতে শুরু কর‘ 

পুষ্প মুগ্ধ হয়ে দেখছেমুগ্ধ হয়ে দেখার মতােই ব্যাপার। একজন লেখক গভীর আগ্রহ নিয়ে লিখছেন এটা এত সুন্দর বােঝা যাচ্ছেমাঝে মাঝে লেখা থেমে যাচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছেলেখক একটা সিগারেট মুখে দিলেনদেশলাই দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে ধরালেন নানতুন কিছু মাথায় এসেছেদেশলাই ফেলে কলম তুলে নিয়ে আবার ঝড়ের বেগে লিখতে শুরু করেছেনএমন সময় বাতি নিভে গেল

লেখক কী প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়েই না তাকাচ্ছেন টেবিল ল্যাম্পটার দিকেলেখকের প্রতি সহানুভূতিতে পুষ্পের চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছেএমন সময় দেখা গেল লেখকের স্ত্রী জরী আসছেতার হাতে মােমবাতিবাতাসের ঝাপ্টা থেকে বাতি আড়াল করে আসছেতার মুখে কেমন যেন দুষ্টু দুষ্টু হাসিপুষ্প দেখছেমুগ্ধ হয়ে দেখছেলেখক কথা বললেনকি চমৎকার ভরাট গলাস্বপ্ন মাখা স্বর। 

লেখক : জরী তুমি এখনাে জেগে আছ

জরী : ঘুমিয়ে পড়েছিলামহঠাৎ শুনি খাটের নিচে খুট খুট শব্দ হচ্ছেকে যেন আণায় খুক খুক করে কাশলপুরুষ মানুষের কাশিভয়ে আমি অস্থিরখাটের নিচে 

কে যেন বসে আছে। 

লেখক : আবার আজেবাজে কথা শুরু করেছ

জরী : মােটই কোনাে আজেবাজে কথা নাআমার মনে হচ্ছে আমাদের খাটের নিচে একটা ভূত থাকেপুরুষ ভূত| ভূতটার গায়ে তামাকের গন্ধ| লেখক; জরী, তুমি দয়া করে মােমবাতিটা এখানে রেখে ঘুমিয়ে পড়প্লিজ, প্লিজএই দেখ হাতজোড় করছি। 

জরী : ঝড় বৃষ্টির রাতে একা একা ঘুমুব? ভূতটা যদি আমাকে কিছু করে ওর মতলবটা আমার কাছে বেশি ভালাে মনে হচ্ছে না। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

লেখক : তােমার সঙ্গে ঘুমুতে পারলে আমি খুবই খুশি হতামকিন্তু তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছ নালেখালেখিটা একটা মুড়ের ব্যাপারমুড সব সময় আসে। 

নী। 

জরী : এখন এসেছে? লেখক : হ্যা এসেছেসারারাত আমি লিখবজরী : আর আমি সারারাত ভূতটার সঙ্গে ঘুমুব

লেখক : আমি একটা ক্লাইমেক্সে এসে থেমে আছিআমার নায়ক অভাবে অনটনে পর্যদস্তবেকার, হাতে একটা পয়সা নেইসকালবেলা খবর পেয়েছে তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছেসে ঠিক করেছে আত্মহত্যা করবে.....। 

জরী : এখনাে করে নি? লেখক : না করে নিতবে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেএখন পথে পথে ঘুরছে। 

জরী : সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছে তাহলে আর দেরি করছ কেন? কোনাে একটা ট্রাকের নিচে ঝাপিয়ে পড়ুকঝামেলা চুকে যাকআমরা আরাম করে ঘুমুতে যাই। 

লেখক : বড় যন্ত্রণা করছ জরী। 

জরী : আমি আর কত যন্ত্রণা করছি? তােমার নায়ক অনেক বেশি যন্ত্রণা করছেস্থির সিদ্ধান্ত নিয়েও পথে পথে ঘুরছেএত ঘােরার দরকার কিরে ব্যাটা? লাফ দিয়ে কোনাে একটা ট্রাকের নিচে পড়ে যা। ঢাকা শহরে কি ট্রাকের অভাব

লেখক; (কড়া স্বরে) জরী। 

জরী : আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছিযদি চাও তাে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারি। 

লেখক : এই মুহূর্তে আমি একটা জিনিস চাই, তা হচ্ছে নীরবে কাজ করার স্বাধীনতা। 

জরী : বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছিস্বাধীনতার সঙ্গে এক কাপ চাও দিয়ে যাচ্ছি। 

পুষ্প দেখল জরী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্বামীর কাছ থেকে চলে আসছেঢুকেছে রান্নাঘরেচা বানাচ্ছেচা বানাতে বানাতে তার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখে আঁচল দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল তারপর চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে ঢুকল। 

বজলু সাহেব চেচিয়ে বললেন, স্টপঅভিনয় থেমে গেলবজলু সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ‘পুরাে ব্যাপারটা স্লো হয়ে যাচ্ছেএমনিতেই নাটক স্লোএরকম একটা 

স্লো নাটকে তার চেয়েও স্লো এ্যাকশান পাবলিক মােটেও একসেপ্ট করবে নাচা বানানাের জন্যে পাশের ঘরে যাওয়া মানেই নাটক স্লো করে দেয়াজরী, তােমাকে লেখকের পাশেই থাকতে হবেঘরেই ফ্লাস্কে চা বানানাে আছেতুমি শুধু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দেবে। 

লীনা বলল, বজলু ভাই একটা সমস্যা আছে তােইমােশান বিল্ড আপ করার জন্যে আমার কিছু সময় দরকারএই সময় তাে আমি পাচ্ছি না‘ 

যা করার এই সময়ের মধ্যেই করতে হবে‘ 

এত অল্প সময়ে চোখে পানি আনতে পারব বলে তাে মনে হচ্ছে নাপারবেঅবশ্যই পারবেনা পারলেও ক্ষতি নেইসাজেসানের উপর দিয়ে কেটে বের হয়ে যাবেনাও শুরু করস্টার্টলেখকের পাশে তুমি দাঁড়িয়ে আছশান্ত ভঙ্গিতে বলছবেশ স্বাধীনতা দিচ্ছিস্বাধীনতার সঙ্গেসঙ্গে এককাপ চা দিয়ে যাচ্ছিওকে স্টার্টজরী, ডেলিভারি এত সফট দিও নাএকটু হার্ড দিও। 

অভিনয় শুরু হললেখক একমনে লিখছেনজরী ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতেঢালতে লেখকের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেতার মন বিষাদে ভারাক্রান্তএক সময় টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলপুষ্প অবাক হয়ে দেখল কত সহজে মেয়েটির চোখে পানি এসে গেছেএটা যেন অভিনয় নয়বাস্তব জীবনস্বামীসঙ্গ কাতর একটি মেয়ের অভিমানের অশ্রুলেখক চোখ তুলে তাকালেন এবং অবাক হয়ে বললেন 

লেখক : কী হয়েছে, চোখে পানি কেন? 

জরী : চোখ মুছতেমুছতে) আমার খুব বাজে একটা চোখের অসুখ হয়েছেরাত হলে চোখ কড় কড় করে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে। 

লেখক : পন্টুকে একবার দেখাও না কেন? এই বলেই লেখক আবার লিখতে শুরু করেছেন। 

জরী চলে আসছেদরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়ালজরী তাকিয়ে আছেলেখকের দিকেলেখক একমনে লিখছেনজরীর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। 

পুষ্প বুঝতেও পারে নি যে তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করেছেমেয়েটির কষ্ট্রে তার বুক ভেঙে যাচ্ছেমনে হচ্ছে সে এক্ষুনি চেচিয়ে লেখককে বলবেপাষণ্ড কোথাকারসে কিছুই বলতে পারল নাদুহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠল। সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকেতার খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু সে চোখের পানি থামাতে পারছে নাআসিফ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-২): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *