সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

এখন আরাম করে ঠাণ্ডা পানি খেতে পারবেনহা হা হাবেনু, ভাবীকে একটা পেপসি দাও‘ 

এখন ধাকনা ভাবি খানখেতে হবেএটা ভাবি আপনি নিজের ফ্রিজ ভাববেনরিকোয়েস্টবেনু শােন, নিচের একটা তাক ভাবির

সাজঘরখবরদার কিছু রাখবে নাযদি দেখি তােমার কিছু আছে তাহলে অসুবিধা আছেজিনিসটা কেমন কিনলাম ভাবি? ভালাে না

খুব ভালােখুব সুন্দরঅনেকগুলাে টাকা চলে গেল, তবু শখের একটা জিনিস, তাই না ভাবি? তা তাে বটেইহাশমত আলির মধ্যেও এক ধরনের সরলতা আছেএটা লীনার ভালাে লাগে। 

এরা সুখেই আছে। নিজেদের নিয়ে আনন্দে আছেপৃথিবী সমাজ উমাজ এইসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেইক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসে এরা গভীর আনন্দ খুঁজে পায়প্রায়ই দেখা যায় অনেক রাতে হাশমত আলি বড়সড় একটা মাছ কিনে এনেছেবেনুসেই মাছ কাটছেহাশমত আলি উবু হয়ে তার সামনে বসে আছেমাছটা কী রকম, সেই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। 

সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

পুকুরের মাছ, কী বল বেনু? রঙটা কেমন কালাে দেখ নাশ্যাওলার নিচে থেকে কালাে হয়ে গেছেনদীর মাছ হলে লাল হততেলটা ঠিক আছে কিনা দেখ তাে‘ 

ঠিকই আছেতেল দিয়ে বড়া বানাতে পারবেমাছের তেলের বড়াতার স্বাদই অন্যরকমদুটো বড় করে পিস কাটভেজে লীনা ভাবিদের দিয়ে এস” 

ওরা বােধ হয় শুয়ে পড়েছেসকালে দেবআরে না এখনই দাওটাটকা জিনিসের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। 

গভীর রাতে প্লেটে ভাজা মাছ নিয়ে হাশমত আলি নিজেই দরজা ধাক্কায়, ভাবি ঘুমিয়ে পড়লেন না কি? ভাবি, ভাবি। 

পরিষ্কার বােঝা যায় এই পরিবারটি লীনাদের বেশ পছন্দ করেকেন করে সেও এক রহস্যএতদিন একসঙ্গে আছে, এর মধ্যে একদিনও নাটক দেখার ব্যাপারে কোনাে আগ্রহ দেখায় নিহাশমত আলি অবশ্যি প্রায়ই বলে, একদিন যাববুঝলেন ভাবি, আপনাদের কাণ্ডকারখানা দেখে আসবমেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিলসারাক্ষণ ভ্যাভ্যা করেবাচ্চা নিয়ে কি যাওয়া যায় ভাবি? বেনুকে একদিন নিয়ে দেখাবগ্রামের মেয়ে, কিছু তাে এই জীবনে দেখে নি। 

সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

সিঁড়ির বাতি বােধ হয় আবার চুরি হয়েছেখুব সাবধানে পা টিপে টিপে উঠতে হচ্ছেএকটা সিড়ি আছে ভাঙাবাড়িওয়ালাকে কতবার বলা হয়েছেএখনাে কিছু করছে না। 

দরজা খুলে দিল বেনুঅবাক হয়ে বলল, এত রাতে একাএকা আসলেন ভাবি!‘ 

না একা নাতােমার ভাই নামিয়ে দিয়ে গেছেভাই আবার গেলেন কই? তার এক ভাগ্নির অপারেশনআল্লা! কী হইছে

কী হয়েছে লীনা নিজেও ভালােমতাে জানে নাজানা উচিত ছিলকথাবার্তা শুনে হাশমত বেরিয়ে এলহাসিমুখে বলল, একটা ভিসিপি ভাড়া করে নিয়ে এসেছি ভাবি। 

তাই নাকি

তিন টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া করলামমনের শখ মিটিয়ে ছবি দেখব। 

ভালােই তাে। 

খাওয়া দাওয়া করে আসেনএক সঙ্গে দেখিএগারটা ছবি এনেছিসব ভালােভালাে ছবিআসিফ ভাই কই

ওর এক ভাগ্নিকে দেখতে গেছেভােরবেলা আসবেআমি ভাবি দুদিনের ছুটি নিয়ে নিয়েছিক্যাজুয়েল লিভদিনরাত ছবি দেখবভালােদেখুনআপনি ভাত খেয়ে আসুনএকা একা ছবি দেখে সুখ নেই ভাবি। 

প্লেটে ভাত নিয়ে লীনা শােবার ঘরে চলে এসেছেলীনার পেছনে পেছনে ঢুকেছে বেনুভাত খাওয়া হলে জোর করে তাকে ছবি দেখাতে নিয়ে যাবে। লীনার চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছেতবু মনে হচ্ছে তাকে ছবি দেখতেই হবে। 

সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

ভাবি?’ 

কী বেনু। 

আপনি এত কাজ সারাদিনে ক্যামনে করেন তাই ভাবিদিনে স্কুলরাতে নাটক, থিয়েটার। 

তুমিও তাে অনেক কাজ করঘরের সব কাজ সামলাও, বাচ্চা দেখবাচ্চা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?” 

জ্বিঅনেক কষ্টে ঘুম পাড়াইছিএরে একটা তাবিজটাবিজ দিতে হইব ভাবিতুমি কোলে নিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে নষ্ট করেছ বেনুতাও ঠিক। 

বেনু তৃপ্তির হাসি হাসলযেন সে মেয়েকে নষ্ট করায় খুব আনন্দিতসব মায়েরা যা পারে না সে পেরেছে। 

ভাবিবল। 

বেনু ইতস্তত করে বলল, একটা শরমের কথা ভাবিখুকির আব্বা কেমুন একটা ছবি আনছেঅসত্য কাণ্ডকারখানাদেখলে শইল ঝিম ঝিম করে‘ 

না দেখলেই হয়আমি খুকির আরে বলছিএই ছবি দেখলে পাপ হইবসে খালি হাসেএইসব ক্যামনে বানায় আফা

জানি না বেনু। 

লীনাকে ছবি দেখার জন্যে বসতে হলদিদার নামের কি একটা পুরনাে সিনেমা হচ্ছেহিন্দী প্রতিটি বাক্য হাশমত আলি অনুবাদ করে দিচ্ছে খুব বিরক্তিকর ব্যাপারপ্রচণ্ড ঘুমে শরীর আচ্ছন্ন হয়ে আসছে| ছবি মাঝপথে রেখে লীনা উঠে এলআর আশ্চর্য, বিছানায় শােয়ামাত্র ঘুম উধাওলীনা অনেকক্ষণ এপাশওপাশ করলমাথায় পানি দিয়ে এল, লাভ হল নাএই রাতটাও সম্ভবত অঘুমে কাটাতে হবেরকম হচ্ছে কেন? তার মনে কি কোনাে গােপন দুঃখ আছে? কোনাে হতাশা আছে? থাকার তাে কথা নয়তাহলে রকম 

হচ্ছে কেন

সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

বাবার অভিশাপ লাগল নাকি

লীনার বাবা ডিস্ট্রিকট জাজ ওয়াদুদুরহমান সত্যিসত্যি মেয়েকে অভিশাপ দিয়েছিলেনজাজ শ্রেণীর মানুষরা কখনাে খুব বেশি রাগতে পারেন নাকিন্তু তিনি রেগে গিয়েছিলেনরাগে অন্ধ হয়ে বলেছিলেন, কী আছে ছেলের? অভিনয় করেঅভিনয়টা আবার কি? অভিনয় হচ্ছে অনুকরণএকটা বানরও অনুকরণ করেতাই বলে একটা বানরকে বিয়ে করা যায়

লীনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এসব তুমি কী বলছ বাবা?” 

ওয়াদুদুর রহমান সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, যা বলেছি ঠিকই বলেছিছেলের আর আছে কী? ঘাড়েগর্দানে এক ছেলেথার্ড ক্লাস পেয়েছে বি. তো ব্যাংকে চাকরি করেচাকরির বেতন কত তুই জানিস? এগার টাকাএগার টাকা দিয়ে নিজে খাবে, না তােকে খাওয়াবে? না কি না খেয়ে থাকবে আর অভিনয় করে দেখাবে যে খুব খাওয়া হল

সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

ছিঃ বাবা, এই ভাবে কথা বল না। 

আমার যা বলার আমি বললামএখন তাের যা ইচ্ছা করবিতাের স্বাধীন ইচ্ছায় আমি বাধা দেব নাতবে এই বাড়িতে বিয়ে হবে নাবিয়ের খরচ আমি দেবসেই টাকা আলাদা করা‘ 

তােমার টাকা আমার লাগবে না বাবা। 

নাটকের লােক বিয়ে করার আগেই নাটকের সংলাপ শুরু করেছিস। জীবননাটক না, এটা হাড়ে হাড়ে টের পাবিজীবন এক সময় অসহ্য বােধ হবে। 

অভিশাপ দিচ্ছ? সত্যি কথা বলছিমাঝেমাঝে সত্যি কথা অভিশাপের মতাে মনে হয়‘ 

লীনার বিয়ে হল বড় খালার বাড়িতেসেই বিয়েতে ওয়াদুর রহমান সাহেব এলেন নাতবে লীনার ধারণা তার বাবার অভিশাপ লাগে নিতারা সুখীপ্রচণ্ড সুখীটাকা পয়সার কষ্ট তাে আছেইএই কষ্ট তেমন কোনাে কষ্ট নয়সহনীয় কষ্টঅসহনীয় কষ্ট হচ্ছে ভালবাসার অভাবের কষ্টসে কষ্ট লীনাদের হয় নিলীনা এখনােতার স্বামীর প্রতি তীব্র ভালবাসা বােধ করেভালবাসা কখনাে একপক্ষীয় হয় নাআসিফও নিশ্চয়ই তার প্রতি সমপরিমাণ ভালবাসা লালন করেকিন্তু সত্যি কি করে

সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ

লীনা উঠে পড়লআবার মাথায় কিছু পানি দিলপাশের ঘরে ভিসিপি চলছেযুগল সংগীতসুর বেশ সুন্দরকথাগুলাের মানে কি কে জানেমেরা পানছেরি। 

পানছেরি শব্দের মানে কি? হাশমত সাহেবকে কাল একবার জিজ্ঞেস করতে হবেমনে থাকলে হয়আজকাল কিছু মনে থাকে না। 

বেনুর বাচ্চা জেগে উঠেছেকাঁদছে ট্যাট্যা করেবেনু তাকে নিয়ে বারান্দায় হাটছে আর বলছে, খুকি কান্দে নাখুকি কান্দে না। 

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *