সাতকাহন পর্ব-(১১)-সমরেশ মজুমদার

সাতকাহন

থানায় দারােগার সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার ? “হ্যাঁ। এস ডি ও-ব অফিসে। কেন বলুন তাে?’ ‘লােকটার চাকরির বাবােটা বেজে গেল। মিনিস্টাব বললেন, অর্জুন তুমি খবব পেয়ে আমাৰ সঙ্গে দেখা করতে এলে আব আমাবই দারােগা একবাব আসার সময় করতে পারলাে 

ডি এম, এস ডি ও খবর পায় আর সে কোথাকার বাদশা ?’ ‘আপনি কি বললেন ?’। ‘আমি পাবলিক। মন্ত্রী সেনাপতিদেব যুদ্ধে কথা বলব কেন ? ‘এই খবর শুনে আমি কি করব ? 

পকেট থেকে একটা ছােট্ট পেতলেব কৌটো বের করে দুই আঙুলের মাঝখানে কিছু গুডাে তুলে মুখে ফেলল অর্জুন, ম্যাডাম, বৃষ্টি হবার আগে পিপডেরা ঠিক টের পেয়ে যায় । আপনাব এখান থেকে সার্কিট হাউসে ফিরে যাওয়ার পবেই যারা জানার তারা জেনে গেল মিনিস্টার আপনাকে খুব পছন্দ করেছেন। নইলে তিনি এই রােদে গরমে নেখালির মানুষদের দেখতে আসতেন না। ম্যাডাম, এই দেশে নেখালির মত হাজার হাজার গ্রাম, লক্ষ লক্ষ মানুষ ধুকছে। ক’জন মন্ত্রী ভুল করেও সেখানে পা দিয়েছেন বলুন তাে? 

‘আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।’ খােলা দরজার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলাে বলল দীপাবলী । তার অস্বস্তি হচ্ছিল। 

‘খুব সহজ। এটা আপনার বােঝা উচিত ছিল ! ‘মানে?’ ‘ম্যাডাম’, মিনিস্টার যতদিন থাকবেন ততদিন আপনার ডিম্যান্ড থাকবে। মানে, যার যা প্রয়ােজন মেটাতে আপনাকে এসে ধরবে। সবার ধারণা মিনিস্টার আপনার কথা ফেলতে পারবেন না। 

সাতকাহন পর্ব-(১১)

‘আপনার আসার উদ্দেশ্যটা কি বলুন তাে?’ ‘দাবােগা এসে আপনাকে ধরবে মিনিষ্টারকে বলে দেবার জন্যে। হয়তাে চাইবে আপনি ওর হয়ে রাইটার্সে গিয়ে দরবার করুন। আপনাকে শুধু বলে রাখি লােকটা অত্যন্ত ফেরোজ । মন্ত্রী আসবে এদিকে তা জানতাে না। কেই বা জানতাে। তাই দারােগা গিয়েছিল নিজের ধান্দায়।’ 

‘আপনার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কেমন ? চট করে জিজ্ঞাসা করল দীপাবলী ! 

হাসল অর্জুন, ‘জলে যারা বাস করে তারা পরস্পরকে সামলে চলে মাডাম। “ঠিক আছে, কিন্তু অর্জুনবাবু, আপনি এটা কি করলেন ? 

কোনটা ?’ চোখ ছােট করল অর্জুন। এই যে নেখালিতে আজ সকাল থেকে কুয়াে খুঁড়তে লােক পাঠালেন ?’ ‘এটা তাে আপনারই হুকুম ম্যাডাম ! তাই না ?’ 

কিন্তু এব ফলে মন্ত্রী তাে হাত গুটিয়ে নিতে পারেন । ‘পারেন। তবে আদৌ যে হাত খুলতেন এই গ্যাবান্টি কি ছিল ? ‘ছিল না । কিন্তু উনি যখন এসেছিলেন তখন একটা কিছু হতই। 

‘সেটা এখনও হতে পারে। ম্যাডাম, লােকে আমাকে ভাগ্যবান বলে। ভাগ্যবানের বােঝা সবসময় ভগবান বয়ে থাকেন। নইলে আপনি বললেন আর লােক পাঠালাম কুয়াে খুঁড়তে, এমনটা হয় না। মানে কারাে কথা আমি চট করে শুনি না। তা শুনে দেখুন বিরাট লাভ হল। মিনিস্টাবের গু6 বুকে চলে গেলাম। জিপে করে যাওযাব সময় কত গল্প । সব ঠিকঠাক হলে আগামী বছর–।’ জিভে শব্দ করল অর্জুন! ‘আব এসব হয়েছে আপনার জন্যে ! 

সাতকাহন পর্ব-(১১)

‘আমার জন্যে ?’ দীপাবলী অবাক। ‘সত্যি কথা বলতে আমি দ্বিধা করি না। আপনার কথা শুনেছি বলেই আজ ডি এম পর্যন্ত আমাকে খাতির করবেন । লােকটা আগে আমাকে ঠিক পাত্তা দিত না। এবার বলুন, আপনার কি সেবা করতে পারি ?’ অর্জুনের ঠোঁটে সেই চটচটে হাসি চলকে উঠল। তার চোখ দুটো দীপাবলীর মুখের ওপর স্থির।

আপনি কি মিন করছেন ? আচমকা মাথায় রক্ত উঠে এল। ‘মাডাম, একটা কথা শুনেছি, রােমে গেলে নাকি রােমানদের মত ব্যবহার করতে হয় । রাগ করবেন না, আপনি তাে নিয়মের বাইরে যেতে পারেন না। 

‘অর্জনবাবু, আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন। দীপাবলী উঠে দাঁড়াল। 

এবার অর্জুন উঠল, “অনেক ধন্যবাদ মনে করিয়ে দেবার জন্যে । অপরাধ হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন। আপনি এরকম কথা বলবেন তা আমি আন্দাজ করেছিলাম। ঠিক হায়, নেখালিতে না হয় আরও দুটো কুয়াে আর একটা নলকূপ করে দেব দিন চারেকের মধ্যে। তাতে নিশ্চয়ই আপনি আপত্তি করবেন না ! চলি।’ নমস্কার করে খােলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল অর্জুন। একধাপ নেমে সে ঘুরে দাঁড়াল, ‘আপনার এখানে যে মেয়েটা কাজ করে তাকে বলে দেবেন আমি মানুষ, ভয় পেয়ে ওইভাবে ছুটে যাওয়ার কোন কারণ নেই। 

সাতকাহন পর্ব-(১১)

দীপাবলী কেটে কেটে বলল, “কি করবেন বলুন, আপনার মত মানুষদেরই ওর ভয়। 

অর্জুন হাসল, ও যখন নেখালিতে থাকত তখন নিশ্চয়ই ওর ভয় ছিল । কিন্তু এই কোয়াটার্সে আসার পর থেকে আর কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি নিশ্চয়ই। কারাে বাগানে ঢুকে ফুল ঘেঁড়ার ইচ্ছে আমার এখনও হয়নি ম্যাডাম। কথা শেষ করে অর্জুন চলে গেল। জিপের আওয়াজটা চারপাশ মাতিয়ে দূরে সরে গেল হেডলাইটের আলােয় অন্ধকার কাটতে কাটতে। দরজাটা বন্ধ করল দীপাবলী। লােকটা যতক্ষণ এই ঘরে বসেছিল ততক্ষণ এক ধরনের আড়ষ্টতা তাকে ঘিরে রেখেছিল। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না সে। লােকটা কেন এল ? একটা অসৎ বদ লম্পট মানুষ কোন প্রয়ােজনে তার কাছে আসতে পারে ? এই জেলার বড় কর্তারা যার কথায় ওঠে বসে তার কোন দরকার নেই তাকে খাতির 

করার ? মন্ত্রীর নেকনজরে পড়ে লােকটা আরও রােজগার করবে। কিন্তু সেই কারণে তাকে ঘুষ দিতে আসবে কেন ? সে রেগে উঠতেই নেখালির মানুষদের উপহার হবে এমন কাজ করার কথা বলল। দীপাবলীর পক্ষে সম্ভব ছিল না লােকটাকে ওই কাজ করা থেকে বিরত করা। কিন্তু অর্জুন নাযেক যতক্ষণ ছিল তাকে অসম্মান কবার চেষ্টা করেনি। বরং যথেষ্ট বিনয় দেখিয়েছে। সে যে খারাপ মানুষ তা স্বীকার করতে দ্বিধা করেনি। অবাক লাগছে এখানেই। 

‘দিদি, চা।’ 

দীপাবলী দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়েছিল। তিরির গলা শুনে মুখ তুলল । চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ‘শােন, আমার এখানে তার কোন ভয় নেই। কেউ এলে ওইভাবে দৌড়ে পালাবি না। . “তুমি জানাে না দিদি, লােকটা একেবারে শয়তানের বাচ্চা। নতুনতুন মেয়ে না পেলে ওর চলে না। ওর সঙ্গে বেশি কথা বলাে না।’ তিরি উত্তেজিত। 

সাতকাহন পর্ব-(১১)

‘তিরি! দীপাবলী ধমকে উঠল, ‘এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবি না।। 

তিরি মাথা নিচু করল। আর তখনই দরজায় খুটখুট শব্দ হল। দীপাবলী বন্ধ দরজা দিকে প্রথমে তারপরে তিৱিব দিকে তাকাল। তিরি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আমি কি দরজা খুলব ? 

দীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল। এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় রাত্রের অন্ধকারে কিছু মানুষ যদি মতলব নিয়ে আসে তা হলে দুটি মেয়ের পক্ষে কোন প্রতিরােধ তৈরি করা সম্ভব হবে !

সতীশবাবু অবশ্য বলেছেন তেমন বিপদ এই তল্লাটে এখনও কারাে হয়নি। তবু । সে নিচু গলায় বলল, ‘জিজ্ঞাসা কব, কে ? তারপর খুলবি। একটু আগে অর্জুনকে দরজা খােলার আগে তার এই কাজটাই কবা উচিত ছিল বলে মনে হল। 

তিরি গলা তুলে জানতে চাইলে, কে ? বাইরে থেকে আওযাজ এল, আমি। দীপাবলী ফিরেছে ? সােজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাে দীপাবলী । তারপর তিরিকে বলল, “ঠিক আছে, তুই ভেতরে 

তিরি পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল ভেতরের ঘরের দরজা পর্যন্ত। দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই আধা অন্ধারে দাঁড়ানাে শমিতকে দেখতে পেল। শমিত হাসল, ‘চমকে গেলে ? 

সাতকাহন পর্ব-(১১)

একটু, এসাে, ভেতরে এসাে।’ কথাগুলাে কামাত্র দীপাবলীর খেয়াল হল কলকাতায় শেষবার দেখা হওয়ার সময়েও সে শমিতকে আপনি বলেছে । মনে মনে তৎক্ষণাৎ কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলল। শমিত ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তার কাঁধে ঝােলা, হাতে ব্যাগ। পরনে সেই একই পােশাক। দাড়ি রেখেছে। ‘বসাে। দরজা বন্ধ করল দীপাবলী ।

চেয়ারে বসে শমিত বলল, আমি বিকেলের দিকে এসেছিলাম।

শুনলাম তুমি নাকি মাননীয় মন্ত্রীমহাশয়ের সঙ্গে কাজে বেরিয়েছ।

কখন ফিরবে তা তােমার মেইড সার্জেন্ট জানে না।

ফলে আমাকে একটা আস্তানার সন্ধানে যেতে হয়েছিল।

কিন্তু এই জায়গা এমন পাণ্ডববর্জিত যে রাত কাটানাের কোন ব্যবস্থাই নেই।

ভয়ে ভয়ে ফিরলাম যদি তােমার দেখা পাই! আমি ভাবছি বেশ ভাগ্যবান, কি বল ? 

চুপচাপ কথাগুলাে শুনল দীপাবলী। তারপর চুপচাপ উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। 

 

Read more

সাতকাহন পর্ব-(১২)-সমরেশ মজুমদার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *